শাহ সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.)’র সিলসিলা চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যাপক বিকশিত
ভারতে পশ্চিমবঙ্গের বান্ডেলে শায়িত রয়েছেন মহান আওলাদে রাসূল (স.) হযরত শাহ সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী। কঠোর শরীয়ত ভিত্তিক তাঁর এই তরিকতের সিলসিলা ভারতবর্ষে ব্যাপকতা রয়েছে। তৎমধ্যে চট্টগ্রাম অন্যতম।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের গারাংগিয়া, চুনতী, হালিশহর, কুতুবদিয়াসহ অনেক তরিকতের দরবার তাঁর সিলসিলাভুক্ত। তাঁর পূর্ব পুরুষ পবিত্র আরব থেকে দিল্লি হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আসেন। শিশুকালেই তিনি আধ্যাত্মিক আলোতে আলোকিত হয়ে যান। শ্রদ্ধাভাজন মাকে নিয়ে আর্থিক প্রতিকূলতায় অনাহারে অর্ধাহারে পড়েন। মা চরকা চালিয়ে কোন রকমে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। মায়ের কষ্ট দেখে হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর শিশুকালে কিছু পয়সা পেতে ইট বহন করেন। পরে রেলে চাকুরী পান। দুনিয়ার সৌভাগ্যবান এ চাকুরী মরহুম পিতার স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে পরিত্যাগ করেন। এতে রেলের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা হতবাক হয়ে যায়। অনাহারে অর্ধাহারে তাঁর জীবন চলমান। কিন্তু তাঁর এবাদত রেয়াজত চালু থাকে।
চিশতিয়া সিলসিলায় ভারতের উত্তর প্রদেশে আজমগড়ের প্রখ্যাত সুফি দরবেশ হযরত আবু হামেদ মিয়া করিম বক্স (রহ.) (আজমগড়ী হযরতের পিতা) তাঁর মহান পীর।
অপরদিকে মোজাদ্দেদীয়া তরিকার পীর হচ্ছেন ফুরফুরার অপর সুফি দরবেশ সামশুল ওলামা হযরত সুফি গোলাম সালমানী আব্বাসী (রহ.)। যৌবনের প্রারম্ভে থেকে তাঁর ভিতর আধ্যাত্মিক আলো ব্যাপক বিকশিত হতে থাকে। ফলে এ মহান আউলাদে রাসূলকে তরিকতের মহান ইমামগণ একে একে আধ্যাত্মিকভাবে সরাসরি খেলাফত দানে ভূষিত করেন।
তিনি মাঝে মধ্যে উত্তর প্রদেশ আজমগড়ের কুহন্ডায় নিজের পীর ছাহেবের বাড়ীতে গমন করতেন। কাজেই তাঁর পীর ছাহেব তাঁর মহান একমাত্র পুত্র হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান (রহ.) ( আজমগড়ী হযরত) কে তাঁর পিতা নিজের খলিফা হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুরের নিকট মুরিদ করিয়ে দেন।
আজমগড়ী হযরত এর বোন ও স্ত্রী হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর (রহ.)’র মুরিদ। এ কুহন্ডায় হযরত শাহ মাওলানা আবদুস ছমদ (রহ.)সহ আরও কয়েকজন মুরিদ রয়েছেন।
হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর (রহ.) নিজেকে গোপন রাখতেন। কুহন্ডা গমন করলে আজমগড়ী হযরতকে বলতেন তিনি যাতে স্থানীয়দেরকে বলেন ইনি (হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর) আমাদের ঘরে মেহমান এসেছেন। তিনি তরিকত জগতের মহান শেখ তা কেউ যাতে বুঝতে না পারেন।
বান্ডেলের মাটিতে বসবাস করছেন। কিন্তু বান্ডেলবাসী জানে না তিনি কে। অনাহারে অর্ধাহারে থাকতেন। তারপরও তাঁর ইবাদত রেয়াজত বন্ধ ছিল না।
মহান আল্লাহ পাকের মহিমা তাঁর সহধর্মিনী ধৈর্যধারণ করে সকাল বিকাল পাত্রে পানি রেখে চুলায় দিয়ে রান্নার ভান করতেন। যাতে মহল্লাবাসিরা তাদের উ্লপোস থাকার কথা টের না পায়। এভাবে তারা ২দিন উপোস রইলেন। ইফতার ও সেহেরী পানি দিয়ে করা হত। এই সময় তাদের ঘরের ছাউনি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানি পড়ত। তাতেও হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর নিরাশ হতেন না। বরং উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে আল্লাহর এবাদত চালিয়ে যেতে থাকেন।
হযরত সৈয়দ ছাহেব (রহ.)’র উক্তি অনুসারে অন্য কোন কাজ, এমনকি খাওয়া–দাওয়া, প্রশ্রাব–পায়খানা পর্যন্ত ছিল না। আর ধারণা করতেন যে, সম্ভবত মৃত্যুর সময় আসন্ন। যত বেশি পারা যায়, আল্লাহকে ডেকে লও। এমতাবস্থায় যখন বৃষ্টি হচ্ছিল ঘরের ছাউনি নষ্ট হওয়ার কারণে উপর দিয়ে একাধিক স্থানে টপ টপ বৃষ্টির পানি পড়তে ছিল। তখন তিনি মাথার উপর থালা রেখে দন্ডায়মান অবস্থায় যিকিরে মশগুল থাকতেন। যখন বৃষ্টি থেমে যায় তখন থালা হতে পানি ফেলে দেন এবং পুনরায় বসে আল্লাহপাকের এবাদতে মশগুল হয়ে যেতেন।
বস্তুতঃ হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর (রহ.) শিশুকাল থেকে মহান আল্লাহপাকের সান্নিধ্য পেতে অস্থির হয়ে উঠেন। তিনি নিজে বর্ণনা করেন, কেন জানি দিন দিন আমার কান্না পেতে থাকে। এ কান্না বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বসে বসে শুধু কান্না করতাম।
লজ্জাবশত জনগণের কাছ থেকে বারে বারে দূরে সরে থাকতাম। জনগণ থেকে দূরে গিয়ে মন ভরে কাঁদতাম। অবস্থা স্বাভাবিক হলে ঘরে ফিরে আসতাম। পুনঃ এরকম অবস্থা হলে লোকালয় থেকে দূরে জঙ্গলের দিকে চলে যেতাম। আর নীরবে কাঁদতে থাকতাম। যেন এলাকার কেউ বুঝতে না পারে। এভাবে হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর অন্তরে হাকিকতের সন্ধান পেতে থাকেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, রুহানিয়ত কোন কাহিনী নয়। এতে সত্যের গাঢ় রহস্য নিহিত রয়েছে এবং এর সঠিক ধারতের সন্ধান নিতে হবে।
অনাহারে যিকিরে রেয়াজতে তাঁর শরীর পর্যায়ক্রমে ভেঙ্গে পড়তে থাকে। ফলে তিনি মাত্র ৪০ বছর বয়সে ইহ জগত ত্যাগ করেন। ১৯০০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ১৩০৭ বাংলার ১৪ পৌষ ১৩৩৮ হিজরি ৬ রমজান তিনি ইন্তেকাল করেন।
সেখানেই তাঁকে শায়িত করা হয়। পরবর্তীতে এখানে তাঁর পুণ্যবতী স্ত্রীও ইন্তেকাল করেন।
ইন্তেকালের সময় উত্তর প্রদেশের কুহন্ডার দু’মহান ব্যক্তিত্বকে খেলাফত দিয়ে যান। ১. নিজের পীর ছাহেবের সন্তান আজমগড়ী হযরত এবং ২. কুহন্ডার–ই বাসিন্দা হযরত শাহ মাওলানা আবদুস ছমদ (রহ.)। তাঁর মাত্র ২৮ জন মুরিদের কথা উল্লেখ রয়েছে। তৎমধ্যে ১৫ জনের তালিকা পাওয়া যায়। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। লোকজনের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলতেন তাঁর আউলাদে বাতিনী তথা তরিকতের সন্তান বহু হবে।
হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর (রহ.) মানুষকে অত্যধিক সম্মান করতেন। তাঁর কাছে কেউ সাক্ষাত প্রার্থী আসলে তাঁর সম্মান পেয়ে সাক্ষাত প্রার্থী অভিভূত হয়ে যেতেন। এক প্রশ্নের জবাবে হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর (রহ.) বলেন, আমার সম্মান প্রদর্শনে তিনি ত খুশি হলেন। আমার সম্মানের কোন কমতি হল না।
হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর (রহ.) ইন্তেকালের পর তাঁর পীর ছাহেবের একমাত্র মহান সন্তান যিনি ইন্তেকালের সময় খেলাফত পেলেন আজমগড়ী হযরত বান্ডেলের প্রতি অত্যধিক নিবেদিত প্রাণ হয়ে যান। নিয়মিত বান্ডেলে অবস্থান করতেন।
চট্টগ্রাম অঞ্চলেও বৎসরে এক বা একাধিক বার তরিকতের সফর হত। তৎমধ্যে হালিশহর, চন্দনপুরা, গারাংগিয়া হয়ে চুনতী, বাঁশখালী ছনুয়া কম বেশি যাওয়া–আসা হয়। এতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর (রহ.)’র সিলসিলা ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়। আজমগড়ী হযরত ১৯৫৯ সালে উত্তর প্রদেশের বিভাগীয় শহর গোন্ডায় মেয়ের শ্বাশুর বাড়িতে ইন্তেকাল করলে তথায় তাকে শায়িত করা হয়।
আজমগড়ী হযরতের পিতার খলিফা হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর। কিন্তু আজমগড়ী হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুরের প্রতি অত্যধিক নিবেদিত ছিলেন। হযরত সৈয়দ ছাহেব ইন্তেকালের পর দীর্ঘ ৫৯ বছর তথা বৃদ্ধ বয়সে সক্ষম থাকা পর্যন্ত বান্ডেলে হযরত সৈয়দ ছাহেবের হুজুরের যেয়ারতে আসতেন। এখানে আসলে অবস্থান নিতেন।
বিশ্বে তরিকত জগতে তা শিক্ষণীয়, অনুকরণীয়, অনুসরণীয়। যেহেতু পীরের সন্তান বা সন্তানের আওলাদগণের নিকট পীরের খলিফা মুরিদগণের বা তাদের সন্তান সন্ততিগণের প্রতি অনেক অনেক ক্ষেত্রে তাচ্ছিল্যভাব পরিলক্ষিত হয়। আজমগড়ী হযরত, সৈয়দ ছাহেব হুজুরের প্রতি যা করে গেছেন তা তাদের প্রতি শিক্ষণীয়। কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রামের অর্থায়নে বান্ডেল শরীফের মসজিদে ৬ রমজান ইফতারের আয়োজন হয়ে আসছে।
চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে প্রতিনিয়ত মানুষ কলকাতা হয়ে বান্ডেল গমন করছেন হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর (রহ.)’র যেয়ারতের উদ্দেশ্যে।
হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর ও তাঁর পুণ্যবতী স্ত্রী উভয়ের সাদামাটা কবর সংলগ্ন পুনঃনির্মিত ৩ তলা জামে মসজিদ। পশ্চিম সংলগ্ন তরিকতের খানকাহ। এ দুই অবকাঠামোতে চট্টগ্রামবাসীর আর্থিক অনুদান রয়েছে কম বেশি। চট্টগ্রামবাসীর মধ্যে এমন সংখ্যাও কম নয় যারা বাৎসরিক একাধিক বার গমন করতেছেন হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুরের যেয়ারতে। ওখানে আবাসিক হোটেলে বা খানকায় অবস্থান করতেছেন। বিশাল ভারতের পাশাপাশি ইউরোপ, আমেরিকা তথা অন্যান্য দেশ থেকেও অসংখ্য যেয়ারতকারী বান্ডেলে আসতেছেন হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর (রহ.)’র যেয়ারতে।
হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর (রহ.)’র এ সিলসিলা কঠোর শরীয়তের ভিতর তরিকত। ক্ষুদ্রতম শিরক বেদআত ত নয়ই শরীয়তের ভিতর তরিকতের কঠোর বিধি নিষেধের মধ্যে থেকে চলা অনেকটা বাধ্যতামূলক।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুরের সিলসিলার কম করে হলেও কয়েক লাখ মুরিদ হবে। তারা কম বেশি সকলেই মাগরিবের পর হাত তুলে দোয়ার মধ্যে হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুরের নাম উচ্চারণ করে থাকেন। বিশাল ভারতসহ বিশ্বে ন্যূনতম কয়েক কোটি লোকের মাগরিবের পর হাত তুলে দোয়ার মধ্যে অনুরূপভাবে হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুরের নাম উল্লেখ করা পর্যায়ক্রমে চলমান।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট