প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১১ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৪:৩৭ পূর্বাহ্ণ

মসজিদুল হারম: সম্প্রসারণ ও ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ব্যবস্থাপনা: গত ২/৩ দশক থেকে দেখে আসতেছি হজ্ব ও রমজানে মহান আল্লাহ পাকের মেহমানগণ পবিত্র কাবার নিকটে মসজিদুল হারামে আসতে নানান প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। শান্তিতে খোলা মনে আল্লাহর মেহেমানরা এদিকে আসতে নানাভাবে ব্যরিকেডের সম্মুখীন হচ্ছেন। ৫ ওয়াক্ত জামাতের ২০/২৫ মিনিট বা আধা ঘণ্টা আগে বড় বড় গেইটে/দরজায় লালবাতি জ্বালিয়ে মসজিদুল হারামের অভ্যন্তরে সংকুলান হচ্ছে না বলে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ লালবাতির মাধ্যমে জানিয়ে দিলে কি হবে! বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মহান আল্লাহপাকের মেহেমানগণ পবিত্র কাবার আকর্ষণে মসজিদুল হারামের আকর্ষণে এসেছেন।

১০/১৫ বছর থেকে দেখা যাচ্ছে মিসফলায় অবস্থান করা বাংলাদেশসহ বিশ্বের গরীব দেশের আল্লাহর মেহেমানগণকে ব্যরিকেড দিয়ে মূল মসজিদুল হারামে প্রবেশের সুযোগ না দিয়ে সম্প্রসারিত আবদুল্লাহ হারামের দিকে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। যা অমানবিক। প্রায় ১ কি.মি বা তার কম বেশি দূরত্বে হাঁটতে হচ্ছে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে। সাম্প্রতিক ব্যবস্থাপনা: ২০২০ সালের মার্চ থেকে বিশ্বে করোনা মহামারী ব্যাপকতা লাভ করে। এতে সৌদি সরকার হঠাৎ করে ওমরাহ গমন বন্ধ করে দেয়। এতে দুই পবিত্র শহরে বিদেশী যারা অবস্থান করছে তারা পর্যায়ক্রমে দেশে ফিরে আসেন। করোনা মহামারী অবস্থা আরও খারাপের দিকে গেলে মসজিদে নববীর মত মসজিদুল হারামের সমস্ত দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। ইমাম, মুয়াজ্জিনসহ মসজিদুল হারামের কর্মকর্তাকর্মচারী মিলে কয়েক শ’ লোকের ৫ ওয়াক্ত জামাত চলমান থাকে। করোনা মহামারী যেহেতু অত্যধিক ছোয়াছে, পবিত্র কাবাকে কেউ যাতে স্পর্শ করতে না পারে সে জন্য চর্তুদিকে ৪/৫ ফুট উচ্চতায় পার্টিশন দেয়া হয়। পরবর্তীতে নানান বিধি নিষেধের মাধ্যমে মসজিদুল হারাম খুলে দেয়া হয়। সমস্ত জায়নামাজ কার্পেট তুলে ফেলা হয়। আরও তুলে ফেলা হয় জমজমের পানির কন্টেইন, গ্লাস। একজন থেকে আরেকজন দূরত্ব বজায় রেখে অনুমতি সাপেক্ষে মসজিদুল হারামে স্থানীয় সীমিত সংখ্যক লোককে নামাজের অনুমতি দেয়া হয়।

করোনা মহামারী বিশ্বে পর্যায়ক্রমে দুর্বল হয়ে আসলে ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২ জনের মধ্যে দূরত্ব উঠিয়ে দেয়া হয়। এর কিছু দিন আগে থেকে অনুমতি সাপেক্ষে ওমরাহ অনুমতি দেয়া হয়। অর্থাৎ অনুমতি সাপেক্ষে এহরাম পরিহিত অবস্থায় ওমরাহ করা যাবে এবং ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে মোবাইল অ্যাপসে অনুমতি থাকতে হবে।

এহরাম পরিধান করে ওমরাহ এর উদ্দেশ্যে মাতাফে গমন করা বর্তমানেও চলমান। তবে এই একটি শর্ত রেখে করোনা মহামারীর সমস্ত শর্ত উঠিয়ে দেয়া হয়। সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী ওমরাহ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিনের শর্ত ওমরায় ১ মাসের স্থলে ৩ মাস থাকা যাবে। সমস্ত সৌদি আরবে গমন করা যাবে।

বাস্তবতা নিরিখে গত ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ বিমানে চট্টগ্রাম থেকে পবিত্র মদিনায় যাওয়া হয়। ২০ দিন অবস্থান করে পবিত্র মদিনা থেকে ওমরাহ এহরাম পরিধান করে ট্রেনে পবিত্র মক্কায় আসি। এহরাম পরিহিত ওমরাহ করব, স্বভাবতই মাতাফে চলে যাই। মাগরিব এশা নামাজের পাশাপাশি তাওয়াফ ও সায়ী করে বের হয়ে যাই।

এরপর ১৩ দিন ছিলাম (পবিত্র) মক্কা হোটেলে। কিন্তু ২ তলায় বা ছাদে বা আন্ডার গ্রাউন্ডে ৫ ওয়াক্ত জামাত পড়া বাদে মাতাফে গমন করতে পারছি না। পারছি না তাওয়াফ করতে। পবিত্র কাবায় আল্লাহর মেহেমানগণের প্রধান আকর্ষণ তাওয়াফ করা এবং সময় থাকলে পবিত্র কাবা দেখে মনে প্রশান্তি আনা। কিন্তু লাখ লাখ আল্লাহর মেহেমান আমার মত এ নিয়ামত থেকে বঞ্চিত।

এহরাম পরিহিত বাদে সাধারণ তাওয়াফ করতে হবে শুধু মাত্র ২ তলায়, যা আমার মত দুর্বল বৃদ্ধ বয়সের লোকদের পক্ষে সম্ভব নয়। ছাদেও তাওয়াফ করা যাচ্ছে না, ওখানে একাধিক স্থানে উন্নয়ন কাজ চলমান। যদিওবা এ সব চলমান কাজ বন্ধ রয়েছে দেখলাম। মহিলাগণের এহরামের কাপড় নিয়ে বিভিন্নতার বড় শর্ত নেই। আছে পুরুষের ক্ষেত্রে। অপরদিকে তাওয়াফ করে সায়ীতে গেলে উল্টো মাতাফে আসার সুযোগ নেই। কিন্তু ৫ ওয়াক্ত নামাজের পর হাজার হাজার নরনারী বিভিন্ন গেইট দিয়ে মাতাফ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে না আসার কথা নয়। যেহেতু যারা ওমরাহ এর উদ্দেশ্যে ঢুকবে তারা তাওয়াফ করে সায়ীতে যাবে এবং ঐদিক দিয়ে বের হয়ে যেতেই হবে। কিন্তু ৫ ওয়াক্ত নামাজের পর হাজার হাজার নরনারী যে মাতাফ থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন তারা শুধু তাওয়াফ ও মাতাফে গিয়ে জামাত পড়বে, পবিত্র কাবা দেখে মনে প্রশান্তি লাভ করবে সে লক্ষ্যেই গমন করেছে তা সহজেই অনুমেয়। কর্তৃপক্ষের শৃংখলাকে সম্মান দেখানো, মেনে নেয়া তাও ধর্ম। যদিওবা তারা বুঝতেছে না।

কর্তৃপক্ষ বাস্তবতা দেখার জানার কথা তাদের এ সিদ্ধান্ত অকার্যকর। কিন্তু তাদের অকার্যকর সিদ্ধান্তটি উঠিয়ে নিচ্ছে না। ৫ ওয়াক্ত জামাতের পর যে হারে নরনারী মাতাফ থেকে বের হয়ে আসছে দেখতে পেলাম তখন মনে আশা জেগেছিল কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত উঠিয়ে নিবে। চাপ হলেও মাতাফে গমন করব। সুযোগ বুঝে তাওয়াফ করব। বসে বসে পবিত্র কাবা দেখে মনে প্রশান্তি লাভ করব।

শেষ পর্যন্ত অনন্যোপায়ে বাধ্য হয়ে মাতাফে গমন পবিত্র কাবা দেখে প্রশান্তি লাভ করতে বৃদ্ধ বয়সে দুর্বল শরীর নিয়ে সহযাত্রীসহ এহরাম পরিধান করে জোরানা মসজিদে চলে যাই ওমরাহ এর উদ্দেশ্যে। ওখান থেকে ওমরাহ নিয়তে এসে মাতাফে গমন করলাম তাওয়াফ সায়ী করলাম।

২ ডিসেম্বর শুক্রবার সকাল ১০ টার কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে উঠলাম। (পবিত্র) মক্কা টাওয়ারের ২৪ তলায় পশ্চিম দিকে আমাদের কক্ষ। পর্দা নাড়িয়ে নিচে দেখতে পাচ্ছিলাম মিসফলাহ এর দিক থেকে স্রোতের মত নামাজীরা আবদুল্লাহ হারামের দিকে যাচ্ছেন। তখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে মসজিদুল হারামের ২য় তলায় চলে যাই। গিয়ে দেখি মসজিদুল হারামে ৩০৪০% জায়গা খালি। মূল মসজিদুল হারামে জায়গা থাকতে আল্লাহর মেহেমানগণকে ১ কি.মি কম বেশি হাঁটায়ে মিসফলাহ বা ঐ দিক থেকে আবদুল্লাহ হারামে যেতে বাধ্য করা অমানবিক নয় কি!

সুপারিশ: মসজিদুল হারাম সম্প্রসারণ সময়ের দাবি। তুর্কি দুর্গের উপর সম্প্রতি নির্মিত ক্লক টাওয়ার বা জমজম টাওয়ার, ১৯৮০ এর দশকে নির্মিত মক্কা হোটেল বা শরীকা মক্কা এবং মসজিদুল হারামের পশ্চিম পার্শ্বে দারআল তৌহিদ ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল অবশ্যই ভেঙ্গে ফেলতে হবে। জবলে আবু কুয়াইসে নির্মিত ৫/৭ টি প্রাসাদ ভেঙ্গে দক্ষিণ দিকে সরিয়ে নিতে হবে। বর্তমান মসজিদুল হারামকে চর্তুদিকে সম্প্রসারণ করতে হবে। যা ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি লোক এক সাথে জামাত পড়তে পারে। সাথে তাওয়াফ ত আছেই। মসজিদুল হারামের চর্তুদিকে মসজিদে নববীর মত চত্বর তথা উঠান থাকা উচিত। এখানে অত্যাধুনিক ছাতা থাকবে মসজিদে নববীর চত্বরের মত। অতঃপর বিভিন্নমানের অসংখ্য হোটেল, মার্কেট, প্যালেস হবে। এখানে বয়স্ক, অসুস্থদের আসার জন্য আধুনিক ব্যবস্থা রাখতে হবে। যেখানে স্ক্যালেটারে হাজার হাজার নামাজীকে ২য় তলা ও ছাদে তুলে দেয়া হচ্ছে, সেখানে বয়স্ক অসুস্থদের জন্য মাতাফে পবিত্র কাবার নিকটে আসতে নানা রকম প্রযুক্তি ব্যবহার করা যাবে। অতএব সৌদি সরকারের নিকট বিনীত নিবেদন তারা যাতে পবিত্র মদিনার মত মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে মসজিদুল হারাম বিশালভাবে সম্প্রসারণ করে, যাতে দূর থেকে হলেও আল্লাহপাকের মেহেমানগণ পবিত্র কাবা দেখতে পান। মাতাফ সম্প্রসারণ করেন যাতে কয়েক লাখ লোক একসাথে তাওয়াফ করতে পারে। আগামী হজ্বের পরপর মসজিদুল হারামের সম্প্রসারণের কাজ শুরু করতে অনুরোধ রাখছি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম মহানগরীর উন্নয়ন : সিডিএ-সিটি কর্পোরেশনের দায়বদ্ধতা