প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৬ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ

তুরস্কের জাতীয় দিবসে শুভেচ্ছা

২৯ অক্টোবর শনিবার তুরস্কের জাতীয় দিবস। মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর সুলতানী শাসন থেকে প্রজাতন্ত্রে প্রবর্তিত হয়। তুরস্কের সংসদে অটোম্যানদের স্থলে নতুন সংবিধান প্রতিস্থাপিত হয়।
সামরিক জেনারেল মোস্তফা কামাল পাশা সুলতানী শাসনের স্থলে তুরস্ককে প্রজাতন্ত্রে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে নিজে আতাতুর্ক পদবী ধারণ করেন। তুর্কি ভাষায় আতাতুর্ক অর্থ তুর্কি জাতির পিতা। তার নাম মোস্তফা কামাল পাশা হলেও তুর্কি জনগণের কাছে কামাল আতাতুর্ক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
বিশ্বের বুকে আরব আজমের বিশাল অঞ্চল নিয়ে তুর্কি সালতানাত শত শত বছর শাসন করে গিয়েছিল। খোলাফায়ে রাশেদ্বীনের আমলে তুরস্কে ইসলামের আগমন হয়। পরবর্তীতে উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলে ইসলাম প্রসার লাভ করে। খালাকু খান কর্তৃক আব্বাসীয় খেলাফতের রাজধানী বাগদাদ ধ্বংস হয়। তখন হতে তথা ১২৮৮ সাল হতে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত ৩৭ জন খলিফা ৬৩৬ বছর ব্যাপী ওসমানিয় খেলাফত পরিচালনা করেন।
আনাতুলিয়ার ছোট একটি জায়গীর ছিল সুগোত। এর অধিপতি ছিলেন আত্‌তুগরীল। ১২৫৮ সালে আত্‌তুগরীলের এক পুত্র সন্তান জন্ম নিলে তাঁর নাম রাখা হয় ওসমান। তাঁরই নামানুসারে তুরস্ক সালতানাত অধিপতিদের ওসমানিয় খলিফা হিসেবে আখ্যায়িত হতে থাকে। এ সুলতান তার রাজ্যের সীমানা দ্রুত সমপ্রসারিত করতে থাকে। ৩৮ বছর ব্যাপী শাসন কার্য পরিচালনা করে ওসমানিয় খেলাফতের ভিড় দৃঢ় করে। ৭০ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করলে তার পুত্র ওরহানও পিতার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে দীর্ঘ ৩৩ বছর শাসন কার্য পরিচালনা করেন। তিনি প্রথম ইউরোপ দখলের দিকে এগিয়ে যান। তারই পুত্র মুরাদও খুবই যোগ্যতার প্রমাণ রেখে গেছেন শাসন কার্য পরিচালনায়। তিনিও দীর্ঘ ৩০ বছর শাসন কার্য পরিচালনা করেন। শত্রু বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন। তার পুত্র প্রথম বায়েজিদও দৃঢ় হস্তে এ সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। তিনি কনস্ট্যান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) জয়ের লক্ষ্যে অবরোধ করেন। কিন্তু অন্যত্র রণাঙ্গনের দিকে প্রয়োজন পড়ায় এ অবরোধ তুলে নেন। মুহাম্মদ (২য়) ১৪৫১ সাল শাসন ক্ষমতায় বসেন। তার পূর্ব পুরুষ দীর্ঘ প্রায় ১৬৩ বছর ওসমানিয় খেলাফত পরিচালনার পর ১৪৫৩ সালে সুলতান ২য় মুহাম্মদ কনস্ট্যান্টিনোপল জয় করে তার নামকরণ করেন ইস্তাম্বুল। তার আগে এর নামকরণ ছিল বাইজানটিয়ান। ঐ সময় আরবীয়গণের কাছে এর নামকরণ ছিল কুস্‌তুনতুনিয়া।
নবী পাক (স.) এ কুস্‌তুনতুনিয়া জয়ের লক্ষ্যে যারা এগিয়ে আসবে তাদের জন্য সুখবর দিয়ে যান। ফলে আমিরে মুয়াবিয়ার আমলে এ কুস্‌তুনতুনিয়া জয়ের লক্ষ্যে দু’বার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। শেষের বার দীর্ঘ প্রায় ৬ বছর এ কুস্‌তুনতুনিয়াকে অবরোধ করে রাখা হয়েছিল। এ যুদ্ধে অনেক সাহাবা অংশগ্রহণ করেন। এখানে দীর্ঘ অবস্থানকালে হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (র.) সহ অনেক সাহাবা ইন্তেকাল করেন বা শহীদ হন।
দীর্ঘ সময় পর ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ এ কুস্‌তুনতুনিয়া তথা কনস্ট্যান্টিনোপল জয় করতে সক্ষম হন এবং এর নামকরণ করেন ইস্তাম্বুল। সে এক ইতিহাস। তিনি ওসমানিয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্তাম্বুলে স্থানান্তর করেন। তারই উত্তরসূরি সোলাইমান ১ম যোগ্যতম সুলতানগণের মধ্যে অন্যতম। তিনি বিশাল তুর্কি সালতানাত সুন্দর শৃঙ্খলভাবে শাসন করে যান। পারস্যের জবর দখল থেকে তিনি ইরাক ছিনিয়ে নেন। এ সুলতান সোলাইমানের সমসাময়িক বিশ্বের প্রখ্যাত শাসকগণ হচ্ছেন, জার্মানের পঞ্চম চার্লস, ফ্রান্সের প্রথম ফ্রান্সিস, ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ, রাশিয়ার জার আইভানোভিচ, পোল্যান্ডের সিজিসমান্ড, ইরানের শাহ ইসমাইল এবং ভারতের মোঘল সম্রাট আকবর। তিনি দীর্ঘ ৪৬ বছর তুর্কি সালতানাত শাসন করে গেছেন।
১৫৬৬ সালে এ সুলতান সোলাইমানের ইন্তেকালের পর পরবর্তী যোগ্য অযোগ্য অনেক সুলতান তুরস্ক শাসন করলেও তার সাথে তুলনা হবার নয়। পরবর্তীতে অযোগ্য শাসকগণের কারণে বিশাল সাম্রাজ্যে সুলতানি শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের মাঝে ক্ষোভের সূচনা হয়ে যায়। তা পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে। অপরদিকে, ব্রিটিশ, ফ্রান্স, পর্তুগীজদের এ বিশাল সাম্রাজ্যের দিকে লোলুপ দৃষ্টি পড়তে থাকে। জনগণের মাঝে সুলতানি শাসনের বিরুদ্ধে জাগরণ বাড়তে থাকে।
এদিকে ১৮৮১ সালে জন্ম নেয়া পরবর্তীতে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল পাশা সাম্রাজ্যের প্রতিকূল বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে ভূমিকা পালন করতে থাকেন। এদিকে বিশাল সাম্রাজ্যের আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গোত্র প্রধান তথা সাবেক শাসকের উত্তরসূরিরা তুর্কি সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এমনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। স্বভাবতই তুরস্ক ব্রিটেন, ফ্রান্সের দিকে না থেকে জার্মানির সাথে থাকে। ফলে এ যুদ্ধে জার্মানির সাথে সাথে তুরস্কেরও পরাজয় বরণ করতে হয়। এমনি প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এ বিশাল সাম্রাজ্যকে বহির্শত্রুরা ভাগ বাটোয়ারা করতে থাকে। এ অবস্থায় সামরিক বাহিনীর ক্ষমতাধর মোস্তফা কামাল পাশা দ্রুত ওসমানিয় সালতানাতের শীর্ষে এসে যায়। এর আগের বছর তিনি প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯২৩ সালে ২৭ সেপ্টেম্বর ইস্তাম্বুলের স্থলে আনকারাকে তুরস্কের রাজধানী ঘোষণা করেন। ১৯২৩ সালের ১৩ অক্টোবর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। একই বছর ২৮ অক্টোবর দিবাগত রাত তুরস্ককে সালতানাতের স্থলে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। এরপরেও সুলতান আবদুল মজীদ (দ্বিতীয়) প্রতীকীভাবে খলিফার পদে ছিলেন। কিন্তু ১৯২৪ সালে এসে এ ৩৭তম সুলতান আবদুল মজীদ নাম মাত্র সুলতান ও খলিফার পদ থেকে পদচ্যুত হয়ে ওসমানিয় সালতানাত প্রথা চিরতরে বিলুপ্তি সাধিত হয়।
ওসমানিয় খেলাফতের প্রথম ৩শ’ বছরকে স্বর্ণ যুগ বলা চলে। যেমনি যোগ্যতম খলিফাগণ ছিলেন তেমনি বিশাল সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি জয় জয়কার অবস্থা বিরাজ করছিল। কিন্তু এ সালতানাতের পরবর্তী সোয়া ৩ শ’ বছর পতনের যুগ বলা চলে। কয়েকজন যোগ্য খলিফা বাদে অধিকাংশই অযোগ্য ভোগ বিলাসে মত্ত থাকতেন। এতে সাম্রাজ্যের বিশাল বিশাল অংশ যেমন হাতছাড়া হয়ে যায় তেমনি মূল তুরস্কের অভ্যন্তরে সুলতানগণের অযোগ্য শাসনের কারণে সালতানাত প্রথার প্রতি ব্যাপক বিরূপ ভাবের প্রতিফলন হল বর্তমান তুরস্কের এ প্রজাতন্ত্র। ১৯৩৪ সালের ২৪ নভেম্বর তুরস্কের জাতীয় পরিষদ কর্তৃক আইন পাস করে তাদের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা কামাল পাশাকে আতাতুর্ক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। আতাতুর্ক অর্থ তুর্কি জাতির পিতা। ১৯৩৮ সালে ১০ নভেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন।
১০ লক্ষ ১ হাজার ৫ শত বর্গ কি. মিটারের দেশ আজকের তুরস্ক। বর্তমানেও আমাদের দেশ থেকে ৬ গুণ বড়।
বস্তুত তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে প্রাচীনকাল থেকে সুসম্পর্ক। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনা তুর্কি সালতানাতের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অপরদিকে, চট্টগ্রাম বন্দরের তুরস্কের বন্দর সমূহের সাথে সেকালেও যোগাযোগ ছিল। এমনকি তুর্কি নিয়ন্ত্রিত মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় শীপ ইয়ার্ড থাকলেও তুরস্কের সুলতানগণ সামুদ্রিক নৌযানের জন্য চট্টগ্রাম শীপ ইয়ার্ড থেকে জাহাজ নির্মাণ ও খরিদ করতেন। যেহেতু এখানকার কাঠ ও নির্মাণ প্রযুক্তি তথাকার চেয়ে মজবুত, টেকসই ও সস্তা।
মুসলিম বিশ্বের মধ্যে তুরস্কের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক দীর্ঘ যুগ যুগ ধরে। চট্টগ্রামে দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছরের কাছাকাছি তুরস্কের হয়ে অনারারী কনসাল জেনারেল হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন জনাব সালাহউদ্দিন কাশেম খান।
ঢাকার সাথে ইস্তাম্বুলের নিয়মিত ফ্লাইট রয়েছে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানান প্রয়োজনের পাশাপাশি বাংলাদেশীরা তুরস্কে ভ্রমণ করতে উৎসাহী হচ্ছে। যেহেতু ইস্তাম্বুলে রয়েছে বিশ্বখ্যাত তোপকাপি জাদুঘর প্রখ্যাত সাহাবা হযরত আবু আইয়ুব আনসারীসহ অনেক ইসলামী তীর্থস্থান। হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র জন্মস্থানও তুরস্কের সিরিয়া সীমান্তে উর্ফায়। তুরস্কের কোনিয়ায় শায়িত আছেন আল্লামা জালাল উদ্দিন রুমি ও শামস তাবরেজী। এতে বাংলাদেশের হৃদয়েও রয়েছে তুরস্কের জনগণের প্রতি ভালবাসা। তুরস্কের জাতীয় দিবসে সে দেশের কল্যাণ কামনা করছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধইতিহাস গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর স্মৃতি