জেরুজালেম নগরী ও প্রাণকেন্দ্র মসজিদে আক্সা
বিশ্বের প্রাচীন বরকতময় নগরী জেরুজালেম। এই নগরীকে কেন্দ্র করে অসংখ্য নবী রাসূলগণের ইতিহাস। বিশ্বের প্রাচীন জনপদ মূলকে শাম ও হেজাজ। বর্তমান জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, তুরস্কের পূর্ব দক্ষিণ অঞ্চল, মিশরের সিনাই উপদ্বীপ, ইরাকের আংশিক পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে এই প্রাচীন জনপদ মূলকে শাম তথা শাম দেশ বলে গণ্য করা হয়। যার কেন্দ্রস্থল জেরুজালেম।
জেরুজালেম নগরীর প্রাণকেন্দ্রে মসজিদে আকসার অবস্থান। যাকে বায়তুল মোকাদ্দাস বলা হয়ে থাকে। উঁচু পাহাড়-পর্বত নিয়ে জেরুজালেম নগরী। তৎমধ্যে বর্তমান কাবা শরীফের দিকে একদম শেষপ্রান্তে মূল মসজিদে আকসা। একতলা বিশিষ্ট এ মসজিদে আকসার দৈর্ঘ্য ৮০ মিটার, প্রস্থ ৫৫ মিটার। যাতে ৪/৫ শত মুসলমান এক সাথে নামাজ আদায় করতে পারে। মূল মসজিদে আকসা তথা ১ লাখ ৪০ হাজার ৯ শত বর্গমিটার এরিয়ার মধ্যখানে মসজিদে গম্বুজে সাখরা। সাখরা অর্থ পাথর। বিশ্বের বুকে মুসলমানগণের তিনটি বরকতময় পাথর রয়েছে। ১. মকামে ইব্রাহীম ২. হাজরে আসওয়াদ ৩. এই মসজিদে আকসায় সাখরা। এই পাথরের সম্মানার্থে সোনালী এক গম্বুজ বিশিষ্ট বিশ্বের দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো নির্মাণ করা আছে। আটভাঁজে গোলাকৃতির এই মসজিদে গম্বুজে সাখরা বিভিন্ন ক্যালেন্ডারে হরহামাশায় নজরে আসে। মূলত ইহা মসজিদে গম্বুজে সাখরা। এখান থেকে ৮০/৯০ মিটার দূরত্বে মূল মসজিদে আকসা। এখানকার এই পাথরকে শূন্যে ভাসমান পাথর বলে বিভিন্ন বর্ণনায় রয়েছে। বাস্তবেও তাই বলা যাবে।
অর্থাৎ পাথরটি শূন্যের উপর ভাসমান দেখা যাবে। যদিওবা একপাশে অল্প পরিমাণ দেয়ালের সাথে লাগানো আছে। বাকী পাথরের নিচে ৭দ্ধ৫ মিটার আয়তন বিশিষ্ট গুহা আকৃতির। এখানে কার্পেট বিছানো আছে। ইচ্ছা করলে ৪০/৫০ জন মানুষ নামাজ পড়তে পারে। তেমনিভাবে মসজিদে গম্বুজে সাখরার অভ্যন্তরে পাথরের চারদিকে নামাজের সুবিধার্থে কার্পেট দেয়া আছে। এখানেও ২ শত মত মানুষ নামাজ পড়তে পারে।
বর্তমানকালে দুই মসজিদে এক আজান দুই একামতে দুই জামাত হয়। একটি জামাত মূল মসজিদে আকসায়, অপর জামাত মসজিদে গম্বুজে সাখরায়। শুক্রবার জুমা ও দুই ঈদ মূল মসজিদে আকসায় খতিব সাহেব ইমামতি করবেন। ঐ সময় মসজিদে গম্বুজে সাখরা মহিলা নামাজের জন্য বরাদ্দ থাকবে।
ফিলিস্তিনি আরবি মুসলমানেরা শুক্রবার জুমা ও দুই ঈদকে অত্যধিক দূরত্ব দিয়ে থাকে। দূর-দূরান্ত থেকে এখানে এসে থাকে সপরিবারে। ফলে লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়। ফলে এই জামাতে ১ লাখ ৪০ হাজার ৯ শত বর্গমিটার বায়তুল মোকাদ্দাসের প্রকাণ্ড এরিয়া পূর্ণ হয়ে গলিতে, রাস্তায়, দোকানে, দালানে এই জামাত সম্প্রসারিত হয়।
কয়েকটি পথ দিয়ে মসজিদে আকসায় পৌঁছতে উপরের দিকে উঠতে হয়। এতে দুই দিকে ফিলিস্তিনীদের দোকানাদি। এই প্রবেশপথে ৮/১০ জন সশস্ত্র ইসরাইলী সৈন্য ২৪ ঘণ্টা পাহারায় থাকে। তার বিপরীতে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনী যুবকেরা পাহারায় থাকে। যাতে জবর দখলী ইহুদিরা এখানে আসতে না পারে।
হযরত ইব্রাহীম (আ.) মক্কা মোকাররমায় তাঁর সন্তান হযরত ইসমাইল (আ.)কে নিয়ে পবিত্র কাবা পুননির্মাণ করেন। এর ৪০ বছর পর মসজিদে আকসা তথা বায়তুল মোকাদ্দাস নির্মাণ করেন। নবী হযরত সুলায়মান (আ.) এই মসজিদে আকসার পূর্ণ নির্মাণ করেন।
নবী পাক (স.) ইসলামের প্রাথমিক যুগে মক্কা মোকাররমা থেকে আল্লাহ পাকের সান্নিধ্য পেতে মেরাজে গমনকালীন এই মসজিদে আকসায় যাত্রা বিরতি করেন। নবী রাসূলগণকে নিয়ে ২ রাকাত নামাজের ইমামতি করেন। পবিত্র মেরাজ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন মাজীদে বলেন, “সেই পূত পবিত্র সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে স্বীয় নির্দেশনা দেখানোর উদ্দেশ্যে কোন এক রাত্রে মসজিদুল হারম থেকে মসজিদে আকসায় ভ্রমণ করান। যার চারপার্শ্বকে তিনি বরকতময় করেছেন। নিশ্চয় তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।” সূরা- বনি ইসরাইল, আয়াত-১।
মেরাজ শব্দটি আরবি ঔরশ থেকে আগত। এর আভিধানিক অর্থ উপরে আরোহণ করা, উর্দ্ধ গমন করা ইত্যাদি।
এই মসজিদে আকসার দিকে কেবলা হিসেবে নবী পাক (স.) ১৭ মাস নামাজ আদায় করেন। অতঃপর কেবলা পরিবর্তন হয়ে পবিত্র কাবা হয়। সে এক বর্ণনা।
মূল মসজিদে আকসা, মসজিদে গম্বুজে সাখরা, মসজিদে নেসা, একাধিক মাদ্রাসা ও বিভিন্নপ্রান্তে বড় বড় খোলা চত্তর। এর সবটুকুই মসজিদে আকসা তথা বায়তুল মোকাদ্দাস হিসেবে বিবেচিত হবে।
মসজিদে গম্বুজে সাখরায় রয়েছে নির্মাণ পুনঃনির্মাণের বর্ণনা। সাথে সাথে এ সাখরা তথা পাথরের রয়েছে নানান বর্ণনা।
জেরুজালেম নগরী উঁচু একাধিক পাহাড়ের সমষ্টি নিয়ে। এখানকার মাটি মরুভূমি বালুকাময়ও নয়, আমাদের দেশের মত সবুজের সমারোহ নয়। তবে মাটি খুবই উর্বর। এখানকার ত্বীন, জয়তুন, আঙ্গুরের জন্য প্রসিদ্ধ। জেরুজালেম নগরীতে শায়িত রয়েছেন হযরত সুলায়মান (আ.) ও হযরত দাউদ (আ.)সহ একাধিক নবী রাসূল। বায়তুল মোকাদ্দাস পাহাড়ের নিচে নবী রাসূলগণের কবরস্থান রয়েছে। জেরুজালেম নগরী থেকে মাত্র ৮/৯ কি.মি দূরত্বে বেথলেহেম যা হযরত ঈসা (আ.)’র জন্মস্থান। জেরুজালেম নগরী থেকে আম্মানের পথে ১৫/২০ কি.মি ব্যবধানে পাহাড়ের ভিতর হযরত মূসা (আ.)’র কবর। অর্থাৎ ফিলিস্তিনসহ মূলকে শামে বহু নবী রাসূল শায়িত। ফিলিস্তিনীদের বাড়ি ঘরের আঙ্গিনায় ত্বীন, জয়তুন গাছ পরিলক্ষিত হয়। তেমনিভাবে মসজিদে আকসার বিশাল বিশাল খোলা চত্তরে বড় বড় পাথরে মাঝে মাঝে ত্বীন ও জয়তুন গাছ দেখা যাবে, যা গরমকালে জুমা ও ঈদের নামাজের জন্য সহায়ক।
মসজিদে আকসা পাহাড়ের নিচে দোকান বাদে প্রায় চারদিকে রাস্তা। রাস্তার অপরপ্রান্তে হোটেল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি ঘর ইত্যাদি।
জেরুজালেম নগরী শীতকালে অত্যধিক শীত, মাঝে মধ্যে হালকা বরফ পড়ে। গরমকালে অত্যধিক গরম। জেরুজালেম নগরী থেকে ৯০ কি.মি পূর্বে জর্ডানের রাজধানী আম্মান। জেরুজালেম থেকে ৩০ কি.মি দূরত্বে হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র পবিত্র কবর ও মসজিদ নিয়ে হেবরনের অবস্থান। হেবরনে ইব্রাহীম (আ.)’র পাশাপাশি আরও শায়িত হযরত ইসহাক (আ.) তাঁর মাতা হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র স্ত্রী সায়েরা (আ.) এবং হযরত ইউসুফ (আ.)। জেরুজালেম থেকে ৩২৬ কি.মি দূরত্বে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। জেরুজালেম থেকে ৭৪ কি.মি দূরত্বে ভূমধ্যসাগর। জেরুজালেম থেকে গাজার দূরত্ব ১২৫ কি.মি।
১৯৪৮ সালে জবর দখলী ইসরাইলী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার সময় তারা পবিত্র নগরী জেরুজালেমকে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলে। তথা পশ্চিম জেরুজালেম দখল করে নেয়। মসজিদে আকসাসহ পূর্ব জেরুজালেম জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের যুদ্ধে জবরদখলী ইসরাইল মসজিদে আকসাসহ পূর্ব জেরুজালেম ছিনিয়ে নেয় এবং পূর্ব জেরুজালেম সহ জর্ডান থেকে ৪৫ কি.মি দখল করে নেয়। আরও দখল করে নেয় মিশর থেকে সিনাই উপদ্বীপ এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমি। ১৯৭৩ সালে মিশর-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল প্রতিকূল অবস্থায় পড়ে। আমেরিকার মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বিরতি হয়। ক্যাম্প ডেভিট চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইল সিনাই উপদ্বীপ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
জেরুজালেমের প্রাণকেন্দ্র পাহাড়ের উপর অবস্থিত মসজিদে আকসা তথা বায়তুল মোকাদ্দাস মুসলমানগণের জন্য তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। তথা প্রথম পবিত্র মক্কায় মসজিদুল হারম, অতঃপর পবিত্র মদিনার মসজিদে নববী। এরপর জেরুজালেমে মসজিদে আকসা বা বায়তুল মোকাদ্দাস।
জবর দখলী ইসরাইলী উচ্ছেদ এবং জেরুজালেম রাজধানী হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, গবেষক