প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২১ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:২৫ পূর্বাহ্ণ

খলিফা ওমর (র.)’র বৈশিষ্ট্য
আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর ফারুক (র.)। তাঁর বিষয়ে কম বেশি জানেন না উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে এমন সংখ্যা কম। তবে ভিন্নভাবে তাঁর জীবনের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য দৈনিক আজাদীর মাধ্যমে সম্মানিত পাঠক মহলে উপস্থাপন করলাম।
তিনি কুরাইশ বংশে বনু আদী গোত্রের সন্তান। নবুওয়াতরে ষষ্ঠ বছর যিলহজ্ব মাসে তথা হিজরতের ৭ বছর পূর্বে ২৬/২৭ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি অসাধারণ সাহসী ছিলেন। বাম হাত দ্বারা ডান হাতের মত কাজ করতে পারতেন, ধাবমান ঘোড়ার পিঠে লাফ দিয়ে আরোহণ করতে পারতেন। জাহেলী যুগে মেলায় কুস্তিও লড়তেন। তিনি ছিলেন দীর্ঘ দেহী, শারীরিকভাবে শক্তিশালী, ছিলেন সুবক্তা। বাবার মৃত্যুর পর গোত্রের প্রতিনিধিত্ব করতেন, বিরোধ মীমাংসা করতেন। সে সময় তিনি ইরাক ও সিরিয়া অনেক বার ভ্রমণ করেন। তথাকার শাসকগণ এবং আঞ্চলিক শাসকগনের সাথেও সাক্ষাৎ করেন। তাঁর কন্যা হযরত হাফসা (র.) নবী পাক (স.)’র স্ত্রী তথা উম্মে খাতুন মুমেনীন ছিলেন। তিনি প্রথম সন্তান তথা কন্যা বিধায় হযরত ওমরকে আবু হাফস বলা হত। তাঁর একাধিক স্ত্রী ছিল। তিনি নয় ছেলে ও চার মেয়ের পিতা ছিলেন। তৎমধ্যে হযরত আবদুল্লাহ সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী।
তাঁর ইসলাম গ্রহণে দুইটি মত রয়েছে। গ্রহনযোগ্য মত হল নবী পাক (স.) কে হত্যার উদ্দেশ্যে বের হলেন, প্রতিমধ্যে এক আত্নীয়ের সাক্ষাৎ হয়, তার কথায় নিজ ভাগিনীর ঘরে যান। সেখানে বাদানুবাদ অতঃপর পবিত্র কুরআনের আয়াত শুনেন, ইসলাম গ্রহণ করেন। চরম রোষের সময়ও যদি কেহ তার সম্মুখে কুরআন মজিদের আয়াত পড়ত সাথে সাথে তাঁর ক্রোধ দূরীভূত হত। তিনি ৪৫ জন পুরুষ ও ১১ জন মহিলার পর মুসলমান হন। এতদিন ইসলাম গ্রহণকারীরা গোপনীয়তা বজায় রাখলেও, তিনি ইসলাম গ্রহণ করার পর থেকে প্রকাশ্য ঘোষণা আরম্ভ হয়ে যায়। নবী পাক (স.)’র হত্যার ষড়যন্ত্রকালীন তাঁর গোত্রের (বুন আদী) কোন অমুসলিম ইহাতে অংশ গ্রহণ করেনি। হিযরতের পর বদর যুদ্ধে শত্রু সৈন্যদের মধ্যে তাঁর গোত্রের কোন লোক ছিল না। তাঁর এক স্ত্রী ইসলাম গ্রহণ না করায় পবিত্র কুরআনের নির্দেশ মতে তালাক দেন। তিনি প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে নবী পাক (স.)’র সাথে ছিলেন। ৭ম হিজরিতে একবার তিনি সেনা নায়ক হিসেবে তুরাবায় নামক স্থানে গমন করেন।
তিনি সব সময় নবী পাক (স.)’র নিকটে থাকতেন। নবী পাক (স.) হযরত আবু বকর (র.) ও হযরত ওমর (র.) কে নিকটে রাখতে সাচ্ছন্দবোধ করতেন। নবী পাক (স.) ওফাতের পর পর হযরত ওমরের প্রচেষ্টায় হযরত আবু বকর (র.) খলিফা হন। হযরত ওমরের প্রস্তাবে খলিফা হন হযরত আবু বকর (র.)। কুরআন মজিদ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। তাঁর খেলাফতকালে কোরআন প্রচার ও শিক্ষাদানে ভাতা প্রদান শুরু করেন। হযরত আবু বকরের খেলাফতকালে তিনি পবিত্র মদিনায় বিচারক নিযুক্ত হন। জনগণের উন্নত চরিত্র বিধায় মাসে একটি বিচারও আসত না। খলিফা হযরত আবু বকরের সাথে মতানৈক্য হত। ইহাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হত। হযরত আবু বকরের অছিয়তে হযরত ওমর (র.) খলিফা হন। তিনি খেলাফতকালে তাঁর বংশীয় গোত্রীয়গণকে দূরে রেখেছিলেন। তাঁর আমলে মতানৈক্য সমাধান করে অধিকৃত সমস্ত অঞ্চল ওয়াল্লাযীনা মিস বা’দিহিম অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত যা আসিবে তারা ইহার মালিক হবে। কাজেই সমস্ত ভূ-খন্দ ওয়াক্‌ফের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কৃতিত্ব থাকবে। তিনি সরকারী সম্পদ ব্যয়ে অপচয় না হওয়ার ব্যাপারে কঠোর থাকতেন। গভর্নরদের প্রতি কঠোর দৃষ্টি রাখতেন। গভর্নররা থাকত ভীতসন্ত্রস্ত, কোন সময় বরখাস্ত হয় আতংকে থাকতেন। গভর্নর বা কর্মকর্তাদের নিয়োগে শর্ত দেয়া হত জাঁকজমকপূর্ণ তুর্কি ঘোড়ায় আরোহন করবে না। চালায় করা আটা রুটি খাওয়া যাবে না। ভাল পোশাক পরিধান করা যাবে না। দরজা বন্ধ করে প্রহরী রাখা যাবে না। জনগণের জন্য সাক্ষাৎ উম্মুক্ত রাখতে হবে। জনৈক গভর্নর বা সেনা নায়কের মান সম্পন্ন ঘরে বাহক পাঠান আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে। বিজয়ী কর্মকর্তা/ সেনা প্রধান দামী কাপড় পরে পবিত্র মদিনায় আসলে তিনি তাদের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করতেন। পোশাক পরিবর্তন করে আসলে সাদরে গ্রহণ করতেন। এক গভর্নরকে দামী পোশাক পরিধান করার কারণে বরখাস্ত করেন।
এক কবি কাব্যে মদের বর্ণনা দেয়ায় তাকে শাস্তি দেন। তিনি খেলাফতকালে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিগণকে সম্মান দেখাতেন। তিনি নব প্রতিষ্ঠিত বিশাল মুসলিম জাহানে কঠোর আইন শৃংখলা এবং শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। তিনি হজ্বের সময় শাসনকর্তা/গভর্নরের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনতেন।
হিজরি ১৬ সনে তিনি হিজরি সন গণনা শুরু করেন। তাঁর শাসনামলে স্বর্ণ দুর্লভ হওয়ার জন্য কাপড়, চামড়ার মুদ্রা প্রচলন করেন। মিসরের নীল নদে পানি প্রাপ্তির জন্য কুমারী পূজা প্রত্যাখ্যান করেন। পবিত্র মদিনা থেকে নীল নদের প্রতি চিঠি পাঠান আল্লাহর হুকুমে যাতে পানি প্রাপ্ত হয়। কুফা নগরীকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠা করেন গভর্নর ভবন, সেনানিবাস, জামে মসজিদ। এখানে ব্যাপক শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। এতে ১৮০ জন শিক্ষক পাঠ দান করাতেন। এখানে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। তিনি মুসলিম চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবদান রাখেন। পরবর্তীতে প্রতি রাজ্যে/ প্রদেশে কার্যকর পদক্ষেপ নেন। গভর্নর হযরত আবু মুসা খলিফার স্ত্রীর নিকট কার্পেট হাদিয়া তথা উপটৌকন পাঠান। গভর্নরকে ডেকে গভর্নরের মাথার উপর কার্পেটটি তুলে দিয়ে ফেরত দেন। বিবি হযরত উম্মে কুলসুমের নিকট রোম সাম্রাজ্ঞী হাদিয়া পাঠান। হযরত ওমর জেনে অপছন্দ করেন। তিনি এটা সরকারি কোষাগারে জমা দেন। তিনি বায়তুল মালের শাখা প্রতিষ্ঠা করেন, কর্জ দেয়ার ব্যবস্থা করেন। তিনি বায়তুল মাল থেকে খাদ্য বহন করে অভাবীর কাছে পৌঁছে দিতেন। প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর পর জনগণের অভিযোগ, সাহায্য প্রার্থনার সুযোগ দিতেন। জন সাধারণের মধ্যে কাপড় বন্টন করা হল একটি করে। খলিফার ব্যবহারে দুইটি দেখে প্রশ্নোত্তরে বললেন-তাঁর পুত্রের ভাগেরটি ব্যবহার করতেছেন বায়তুল মাল থেকে নয়। দুপুরে কোথাও গেলে দুপুরে গাছের নিচে বিশ্রাম নিতেন। রোম সম্রাটের দূত এ অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে যান। তিনি দূর যাত্রায় রাস্তার ধারে পথিক বাণিজ্যিক কাফেলার কল্যাণে সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করেন। তিনি ইন্তেকালের পূর্বে অন্যতম অছিয়ত রাখেন,‘তোমরা অমুসলিম প্রজাদের সহিত উত্তম ব্যবহার করিও।’
হযরত ওমরের আরও বৈশিষ্ট্য হল:
অনেক সাহাবা গোপনে রাতে পবিত্র মদিনায় হিযরত করলেও তিনি ২০ জন সাহাবী নিয়ে প্রকাশ্যে দিনের বেলায় জন্মভূমি পবিত্র মক্কা থেকে পবিত্র মদিনা হিযরত করেন।
যাওয়ার বেলায় প্রকাশ্যে বলেন, ‘কে আছ, নিজের স্ত্রীকে বিধবা করবে! কে আছ, নিজের সন্তানকে এতিম করবে! কে আছ, আমার সাথে মোকাবেলা করবে।”
তিনি পবিত্র মদিনায় পৌঁছে নবী পাক (স.) পৌঁছা পর্যন্ত নেতৃত্ব দেন।
হজ্বের সময় অভিযোগ শুনতেন প্রাদেশিক গভর্নর, সেনাপতিগণ, কর্মকর্তাগণের বিরুদ্ধে।
তিনি ইন্তেকালের পূর্বে তাঁর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (র.)’র মাধ্যমে এবং ইন্তেকালের পর ২য় বার সেই একইভাবে নবী পাক (স.)’র পাশে কবর পেতে হযরত আয়েশা (র.)’র অনুমতি আবেদন করেন। নিজের আকাঙ্ক্ষার স্থলে খলিফা ওমরকে প্রদান করেন এবং সে হতে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (র.) আমৃত্যু পর্দা রক্ষা করে গেছেন।
তিনি প্রায় ৩৬ হাজার শহর বা দুর্গ জয় করেন। বিজিত অঞ্চলে ১৪ শত মত প্রকান্ড মসজিদ নির্মাণ করেন।
তাঁর চিন্তার প্রতিফলনে আল্লাহ পাকের নির্দেশে নবী পাক (স.) মদ পান হারাম হওয়ার ঘোষণা দেন।
নবী পাক (স.)’র মাধমে মকামে ইব্রাহীমে নামাজ পড়ার বিধান হযরত ওমরের আগ্রহের প্রতিফলন।
আজান প্রথা তার চিন্তা চেতনার প্রতিফলন।
আল্লাহ পাকের নির্দেশে নবী পাক (স.) পর্দা প্রথার বিধান দেন হযরত ওমরের মতামত বা আগ্রহের উপর।
এক বর্ণনায় হযরত ওমর (র.)’র সমর্থনে পবিত্র কুরআন মজিদের ২২ স্থানে আয়াত বা আয়াতের অংশ রয়েছে।
বস্তুতঃ আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর (র.) আদর্শ, শাসন, অবদান নবী পাক (স.)’র পরে অতুলনীয়। তিনি ছিলেন সাহসী, শাসনে কঠোর, স্বজনপ্রীতির অনেক অনেক ঊর্ধ্বে। নিজের ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রতায় থাকতেন। তাঁর উপর অনেক প্রবন্ধ সংবাদপত্রে ছাপানো হয়েছে, হবে স্বাভাবিক। তাঁর জীবনের অসংখ্য বৈশিষ্ট্য থেকে কতেক এখানে পেশ করলাম মাত্র।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর শিশুপ্রীতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠা
পরবর্তী নিবন্ধরনির দীর্ঘশ্বাস