প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৪ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:১৯ পূর্বাহ্ণ

নবী পাক (সা.)’র লোমহর্ষক হিযরত যেভাবে হল
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
এদিকে হযরত আলী (র.)কে কম্বল দ্বারা ঘুমানোর নির্দেশ দেয়া হয়। যে কম্বলটি নবী পাক (স.) ঘুমানোর সময় ব্যবহার করতেন। যাতে কেউ ঘরের ভিতর উঁকি দিলে মনে করে যে নবী পাক (স.) ঘুমাচ্ছেন। হযরত আলী (ক.) কে আরও নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তিনি যেন নবী পাক (সা.) চলে যাওয়ার পর তাঁর নিকট গচ্ছিত রাখা ধনরত্ন, মূল্যবান দ্রব্যাদি ঐসবের মালিকদেরকে যথাযথভাবে ফেরত দেন। মহান আল্লাহ পাকের একত্ববাদ প্রচারের জন্য শত্রুত্য হলেও সাধারণ মক্কাবাসীগণের নিকট অতি বিশ্বস্ত হিসেবে বিবেচনা উঠে যায়নি। ফলে অমুসলিমরাও নবী পাক (সা.)’র নিকট ধনরত্ন আমানত রাখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেছিলেন। এ সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করে নবী পাক (সা.) ঘাতকের দৃষ্টি এড়িয়ে চলে যান।
নবী পাক (সা.) অতি গোপনে হযরত আবু বকর (রা.)কে সাথে নিয়ে ছওর গুহায় গমন করেন। কিভাবে গমন করেন এ বিষয়ে পাঁচটি বর্ণনা পাওয়া যায়। ইহা এমন সময়ে ঘটেছিল যখন সফর মাস শেষ হতে আরও ৩ রাত বাকী।
এ প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা (রা.) বলেন, “এ ঘটনার পর পর নবী পাক (সা.) ও হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (রা.) ছওর গুহায় গমন করেন। সেখানে তিন রাত্রি অতিবাহিত করেন। তার ভ্রাতা আবদুল্লাহ, সে ছিল একজন অতি তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন অত্যন্ত সুচতুর তরুণ, তাদের সাথে রাত্রিযাপনের পর অতি প্রত্যুষে গুহা ত্যাগ করে (পবিত্র) মক্কা প্রত্যাবর্তন করতেন। এ কথা বিশ্বাস করানোর জন্য যে, তিনি (পবিত্র) মক্কায় রাত্রিযাপন করেছেন। আবদুল্লাহ দিনের বেলায় কুরাইশ নেতাদের কথাবার্তা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে যতটা বেশি সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করতেন এবং রাত্রিতে নবী পাক (সা.) ও হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (রা.) কে অবগত করাতেন। অপরদিকে, বিশ্বস্ত কাজের লোক আমের গুহার নিকটবর্তী স্থানে তাঁর মালিকের (আবু বকর ছিদ্দিক (রা.)’র) ছাগলের পাল চরাতে নিয়ে যেত। ঐ এলাকায় সন্ধ্যায় অন্ধকার নেমে আসলে ছাগলের পাল গুহার নিকটে উঠিয়ে আনত এবং উহাদের দুধ দহন করিয়ে পান করাত। এভাবে আবদুল্লাহ ও আমের পালাক্রমে নবী পাক (সা.) ও হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (রা.)’র যত্ন নিতেন।
কুরাইশ নেতাগণ সকালে নবী পাক (সা.) তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে চলে গেছেন দেখে প্রথমে হযরত আলী (রা.)কে পাকড়াও করে এবং নবী পাক (সা.) সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করে। তিনি নবী পাক (সা.)’র অবস্থান সম্পর্কে কোন সূত্র প্রদান করলেন না। অতঃপর তারা দ্রুত বেগে হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (রা.)’র গৃহে গিয়ে উপস্থিত হন। তার কন্যা আসমাকে তার পিতার অবস্থান সম্পর্কে কড়াভাবে জানতে চায়। তিনি তার পিতার অবস্থান সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করলে, আবু জাহল এমন জোরে চপেটঘাত (থাপ্পড়) করে যে, তার কানের দূল খসে পড়ে। বাস্তবপক্ষে হত্যাকারীদের ক্রোধ তাদের হতাশার গগণচুম্বী ছিল। কারণ তারা এ ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে কষ্ট করেছিল যে, তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে নবী পাক (স.) অজ্ঞ ছিলেন। কাজেই তারা নবী পাক (সা.) কে আকস্মিকভাবে তাদের হাতের নাগালে পাবে। হযরত আলী কিংবা হযরত আসমা (রা.) নিকট হতে নবী পাক (সা.) সম্পর্কে কোন তথ্য না পেয়ে কুরাইশ নেতাগণ নবী পাক (সা.) ও তাঁর সঙ্গীকে খুঁজে বের করার জন্য সশস্ত্র যুবকের দল বিভিন্ন দিকে প্রেরণ করে। রাত্রিকালে নবী পাক (সা.) কোন পথ দিয়ে যেতে পারেন সে সম্পর্কে যতটুকু সম্ভব অনুমান করে তারা শহর হতে বাহির হওয়ার রাস্তাগুলোতে অনুসন্ধান করতে থাকে। তারা তাদের হিযরতের দিকে খুঁজে পেতে পদচিহ্ন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে। আল-ওয়াকিদীরের বর্ণনা মতে কুরায়য ইবনে আলকামা নামক এক ব্যক্তিকে এ উদ্দেশ্য কুরাইশ নেতাগণ এ ধরনের একজন বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে।
কুরাইশ নেতাদের অনুসন্ধানের দলগুলোর একটি বাস্তবে ছওর গুহার মুখের নিকট অগ্রসর হয়। তা সত্ত্বেও গুহায় প্রবেশ করে নাই। ঐ সংকটময় সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে হযরত আবু বকর (রা.) বলেন যে, তিনি উপরের দিকে তাকান এবং কিছু সংখ্যক কুরাইশ ব্যক্তির পা দেখতে পান। ভীতিকর অবস্থায় তিনি নবী পাক (সা.) কে বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! যদি তাদের কেউ নিচের দিকে তাকায় তবে সে আমাদেরকে দেখতে পাবে। নবী পাক (সা.) বললেন, ধৈর্য্যধারণ করুন। আমরা ২ জন, ৩য় জন হিসেবে আল্লাহ আমাদের সাথে আছে।”
সূরা তওবা আয়াত ৪০ এ বর্ণনা আছে যে, “যদি তোমরা তাকে (রসূলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখ, আল্লাহ তাঁর সাহায্য করেছিলেন, যখন তাকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিল, তিনি ছিলেন দু’জনের একজন, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন, বিষণ্ন হইওনা, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর প্রতি স্বীয় সান্তনা নাযিল করেছেন এবং তাঁর সাহায্যে এমন বাহিনী পাঠালেন, যা তোমরা দেখনি। বস্তুতঃ আল্লাহ কাফেরদের মাথা নীচু করে দিলেন, আর আল্লাহর কথাই সদা সমুন্নত এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”
কিছু কিছু বর্ণনা রয়েছে গুহার মুখে একটি গাছ জন্মানো, দুইটি ঘুঘু পাখির বিশ্রাম গ্রহণ, গুহার মুখে মাকড়সার জাল বিস্তার, যা দেখে কুরাইশগণ মনে করল সম্প্রতি এতে কেউ প্রবেশ করে নাই বিধায় গুহার ভিতর উঁকি না দিয়ে ফিরে গেল।
৩ রাত গুহায় অবস্থানের পর চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তি আবদুল্লাহ তার নিজের বাহন ও উট দুইটিসহ গুহায় বা নিকটে উপস্থিত হয়। আমেরও সঙ্গে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসে। ৪ জনের কাফেলাটি তখন উপকূলের পথ ধরে গুহা হতে যাত্রা শুরু করে। হযরত আবু বকর (রা.) বলেন যে, তারা রাত্রিতে যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং সারা রাত্রি ও পরদিন দুপুর পর্যন্ত ভিন্ন পথে পবিত্র মদিনার দিকে অগ্রসর হন। রৌদ্রে ও মরুভূমির তাপ অসহনীয় রূপ ধারণ করায় তিনি একটি উপযুক্ত স্থান খুঁজছিলেন যেখানে বিশ্রাম নেয়া যাবে। অতঃপর একটি শৈলী ভূমি পরিষ্কার করে নবী পাক (সা.) কে নিদ্রা করানোর জন্য অনুরোধ জানান। তিনি সর্বক্ষণ পাহারায় থাকবেন। এখানে এক মেষ পালকের দুধ পান করেন। সে এক ঘটনা প্রবাহ। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর সূর্য ঢলে পড়লে তাঁরা মরু পথে যাত্রা শুরু করেন। (চলবে)
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলাম লেখক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু : একটি আদর্শের নাম
পরবর্তী নিবন্ধবড়পুলে তিন চাঁদাবাজ আটক