প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

| বুধবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২০ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

নবী পাক (স.)’র লোমহর্ষক হিযরত যেভাবে হল
মহান রবিউল আউয়াল মাস। এ মাসে নবী পাক (স.)’র শানে এ ক্ষুদ্র প্রয়াস। নবী পাক (স.) পবিত্র মক্কায় জন্ম থেকে নবুওয়াত প্রাপ্তি পর্যন্ত দীর্ঘ ৪০ বছর তাঁর কুরাইশ বংশীয়সহ সর্বমহলে অতীব গ্রহণযোগ্য ছিলেন। ছিলেন ভালবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক। এক কথায় আদর্শ চরিত্রে আল-আমিন হিসেবে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য ছিলেন।
নবুওয়াত প্রাপ্ত হয়ে আল্লাহপাকের একত্ববাদ তথা দাওয়াত দেয়া আরম্ভ করলে কুরাইশ বংশ মেনে নিতে পারেনি। কুরাইশ বিশ্বে অদ্বিতীয় সম্ভ্রান্ত বংশ। যার অবস্থান পবিত্র মক্কায়, এ বংশই নেতৃত্বে। বংশের বিভিন্ন ধারার বাঘা বাঘা ব্যক্তিরা বারে বারে প্রচেষ্টা চালায় নবী পাক (স.) যাতে আল্লাহ পাকের একত্ববাদ প্রচার তথা দাওয়াত বন্ধ রাখে, থাকে কুরাইশদের সাথে সহাবস্থানে। কিন্তু না, তা কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয়। তিনি আখেরী নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন আল্লাহ পাকের একত্ববাদ প্রচারের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্তে। কুরাইশরা নিস্ফল হয়ে নবী পাক (স.) নিজে এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত মহান সাহাবাগণের উপর দমন নিপীড়ন অত্যাচার শুরু করে দেয়। এর মাত্রা দিন দিন বাড়তে থাকে। ফলে বাধ্য হয়ে নব দীক্ষিত মুসলমানগণের বড় অংশকে দুই বারে আফ্রিকার আবিসিনিয়ার (ইথিওপিয়া) হিযরত করাতে বাধ্য হয়েছেন। সে দেশের মহান বাদশাহ নাজ্জাশী তাদের সাদরে গ্রহণ করেন, ঈমান আনেন। তাঁর ইন্তেকালে নবী পাক (স.) পবিত্র মদিনায় গায়েবী জানাযা পড়ান। সে এক ঘটনা প্রবাহ।
মহান আল্লাহ পাকের মহিমা পবিত্র মদিনায় বসবাসরত বনু আওস ও বনু খাযরাজ সম্ভ্রান্ত গোষ্ঠী। পবিত্র মদিনায় আরও বসবাসরত ছিল ইহুদিরা। খাযরাজ জানতে পারে যে একজন আখেরী নবী আসবে। তাঁর আসার সময় হয়ে গেছে। ইহুদী পণ্ডিতরাও তা স্বীকার করে। বিশ্বে মানবের শুরু থেকে হজ্বের প্রচলন ছিল এবং তা বন্ধ ছিল না। ফলে পবিত্র মদিনা শরীফ থেকে আসা নেত্রীস্থানীয় ব্যক্তিরা প্রথম বার ৬ জন, ২য় বার ৭৩ জন হজ্ব উপলক্ষে পবিত্র মক্কায় এসে মিনায় গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেন। আনুগত্যের শপথ নেন, শপথ নেন মুসলমানগণের কল্যাণে নবী পাক (স.)’র নিরাপত্তায় জানমাল দিয়ে সহায়তায় থাকবেন।
এরপর থেকে পর্যায়ক্রমে নবী পাক (স.) মুসলমানগণকে মদিনা মুনাওয়ারায় হিযরত করতে আদেশ পরামর্শ দেন। এ দিকে কুরাইশ সর্র্দারগণ কর্তৃক নবী পাক (স.)’র প্রতি তাদের জুলুম অত্যাচার দিন দিন বাড়তে থাকে।
মহান সাহাবীগণের অধিকাংশ পবিত্র মদিনায় হিযরতের পর নবী পাক (স.) স্বয়ং তাঁর হিযরতের জন্য আল্লাহ পাকের সুনির্দিষ্ট নির্দেশের অপেক্ষা করতে ছিলেন। অপরদিকে হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (র.) তার প্রতি কুরাইশ নেতৃবৃন্দের বিরোধিতা এবং চাপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখে তার নিজের জন্য নবী পাক (স.)’র নিকট হিযরতের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ পাক তাঁর জন্য একজন উত্তম সঙ্গীর ব্যবস্থা করবেন এ কথা বলে নবী পাক (স.) তাকে অপেক্ষা করতে বলেন। অর্থাৎ হিযরতের সময় নবী পাক (স.) তাকে সঙ্গী হিসেবে পেতে ইচ্ছুক ছিলেন। এতে হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (র.) জানতে চান, তার হিযরতের জন্যও আল্লাহ পাকের অনুমতির প্রত্যাশা করতেছেন কিনা? নবী পাক (স.) উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, প্রত্যাশা করতেছেন। এতে হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (র.) অপেক্ষা করতে ছিলেন। বর্ণিত আছে যে, ধর্ম প্রচারের চতুর্দশ বছরের রবিউল আউয়ালের প্রথম দিকে নবী পাক (স.)’র সাথে তাঁর হিযরতের ৪ মাস পূর্ব হতে হিযরতের জন্য দুইটি উটকে তিনি বিশেষভাবে প্রতিপালন করতে ছিলেন।
নবী পাক (স.) কে হত্যা করার জন্য কুরাইশ নেতৃবৃন্দ ষড়যন্ত্র পাকা করার সাথে সাথে আল্লাহ পাক এ প্রসঙ্গে তাঁকে অবগত করালেন। বাস্তবিকই এ ঘটনা সম্পর্কে ইঙ্গিত করে সূরা আনফাল ৩০ নং আয়াতে আল্লাহ পাক উল্লেখ করেছেন-
“আর কাফেরেরা যখন প্রতারণা করত আপনাকে বন্দী অথবা হত্যা করার উদ্দেশ্য কিংবা আপনাকে বের করে দেয়ার জন্য তখন তারা যেমন ছলনা করত, তেমনি আল্লাহও ছলনা করতেন। বস্তুতঃ আল্লাহর ছলনা সবচেয়ে উত্তম।” অর্থাৎ আল্লাহ পাক উত্তমরূপে জানতেন কিভাবে ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে হবে।
এদিকে কুরাইশ নেতাগণ তাদের গোপন সভা হতে চলে যাওয়ার সাথে সাথে জিবরাইল (আ.) নবী পাক (স.)’র নিকট আগমন করেন এবং সভার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাকে অবগত করান ও সতর্ক করেন যে, তিনি যেন ঐ রাত্রিতে তাঁর নিজের শয্যায় নিদ্রা না জান। জিবরাইল (আ.) তাকে হিযরতের জন্য মহান আল্লাহ পাকের অনুমতির সংবাদও প্রকাশ করেন। ইবনে আব্বাস (র.) বর্ণনা অনুযায়ী নবী পাক (স.)’র হিযরতের জন্য ঐশী আদেশ সূরা বনী ইসরাইল ৮০ নং আয়াতে উল্লেখ করেন-
”বলুন: হে পালনকর্তা! আমাকে দাখিল করুন সত্যরূপে এবং আমাকে বের করুন সত্যরূপে এবং দান করুন আমাকে নিজের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় সাহায্য।”
এ দিকে ইবনে আবু বকর (র.) আবদুল্লাহ ইবনে উরায়কিতের সঙ্গে একটি চুক্তি করে রাখেন হিযরতকালীন সহযোগিতা পেতে। তিনি অমুসলিম হলেও অতি বিশ্বস্ত লোক ছিলেন। তাকে কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে হিযরতের সময়ে উট দুইটির দায়িত্ব গ্রহণ করতে, নির্ধারিত স্থানে ও সময়ে সেগুলিকে আনতে, পবিত্র মদিনার যাত্রাপথে মানচিত্রে অপ্রদর্শিত ও অব্যবহৃত অংশের মধ্যে দিয়ে যেপথে যাত্রা করার জন্য নবী পাক (স.) পরিকল্পনা করতেছিলেন এবং যাহা স্পষ্ট তার বা হযরত আবু বকর (র.) পরিচিতি ছিল না। ছিল না বিধায় প্রদর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করতে, সর্বোপরি এ সমস্ত ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কুরাইশ শত্রুদের উত্তাপ প্রশমিত ও অনুসরণ কার্যক্রম না থামা পর্যন্ত লুকায়িত থাকার স্থান হিসেবে ছওর গুহা তথা জবলে ছওরকে নির্ধারণ করা হয়। এটি পবিত্র মক্কার ৩/৪ কি.মি দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিল তথা পবিত্র মদিনার বিপরীত দিকে। পবিত্র মক্কায় জবলে নূর অর্থাৎ যেখানে নবী পাক (স.) নিয়মিত গমন করতেন, ধ্যান করতেন, নবুওয়াত প্রাপ্তি তথা পবিত্র কুরআন মাজীদের আয়াত নাযিল হয়। এ বরকতময় পাহাড়টি পবিত্র মদিনার দিকে তথা পবিত্র কাবার ৪/৫ কি.মি উত্তর-পূর্ব দিকে। গারে ছওর তথা ছওর গুহা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে।
হিযরতের লক্ষে আল্লাহ পাকের অনুমতি পাওয়ার সাথে সাথে হযরত আবু বকর (র.)’র পুত্র আবদুল্লাহ ও বিশ্বস্ত কাজের লোক আমের ইবনে ফুহায়রা কে নির্দেশ প্রদান করা হয় যে, ১ম দিবাকালে কুরাইশদের নেতাদের কার্যক্রম ও কথাবার্তার উপর নজর রাখার জন্য পবিত্র মক্কায় অবস্থান করবে। গভীর রাতে ছওর গুহায় গিয়ে নবী পাক (স.) ও হযরত আবু বকর (র.) অবগত করাবে। ২য় ছাগলপালক আমের গুহার নিকটবর্তী এলাকায় ছাগল চরাবে এবং সন্ধ্যার দিকে অন্ধকার নেমে আসলে তাদেরকে ছাগলের দুগ্ধ পান করাবে।
এসব পরিকল্পনা প্রস্তুতি পবিত্র মক্কা ত্যাগের সামান্যকাল পূর্বে চূড়ান্ত হয়। আমেরকে গুহা সম্পর্কে অবগত করানো হয় নাই। পরবর্তী আবদুল্লাহ ইবনে হযরত আবু বকর (র.) কে জানান হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ইবনে ইসহাক খুব গুরুত্ব সহকারে বলেন, হযরত আবু বকর (র.) তাঁর পরিবার হযরত আলী (র.) ব্যতীত নবী পাক (স.)’র ছওর গুহায় যাত্রা সম্পর্কে আর কেউ জানত না।
কুরাইশ নেতাগণও তাদের পরিকল্পনা মত অগ্রসর হয়। কিন্তু তারা জানত না যে, তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে নবী পাক (স.) জ্ঞাত ছিলেন। তাদের ষড়যন্ত্র মতে, তাদের নির্ধারিত ঘাতকদল নবী পাক (স.)কে হত্যা করার আবাসস্থলের বাহিরে সুযোগের অবস্থায় থাকে। বর্ণনা মতে দলে ১২ জন ঘাতক ছিল। যেমন- আবূ জাহল, আল-হাকাম ইবনে আবিল-আস, উকবা ইবনে আবী মু’আয়ত, আন-নাদর ইবনুল হারিছ, উমাইয়্যা ইবনে খালাফ, ইবনুল গায়তালা, যাম’আ ইবনুল আসওয়াদ, তু’আয়মা ইবন আদিয়্যি, আবু লাহাব, উবায়্যি ইবনে খালাফ, নুরায়হ ইবনুল হাজ্জাজ এবং তার ভাই মুনাববিহ ইবনুল হাজ্জাজ। তারা ইচ্ছা করতেছিল নবী পাক (স.)’র ঘরে প্রবেশ করবে এবং আঘাত করবে। কিন্তু তাকে আঘাত করতে কে প্রথমে প্রবেশ করবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারে নাই। নবী পাক (স.) সকালে বাহিরে আসবেন এ লক্ষ্যে তারা বাহিরে অপেক্ষমাণ থাকে। (চলবে)
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামলেখক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্বনবীর (সা.) জীবনদর্শন
পরবর্তী নিবন্ধবুলবুলের গল্প