অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে পাচারকারীরা বড্ড বেকুব
শিক্ষা, জ্ঞান গরিমা ও মানব সেবার মাধ্যমে মানুষ সমাজে সম্মান পেয়ে আসছে। শত বছরের এই ধারা ভেঙ্গে মানুষ বর্তমানে ছুটছে শুধু অর্থের পেছনে। শুধু তাই না অর্থ উপার্জনের এই প্রতিযোগিতায় বৈধ, অবৈধ বাছ বিচার করছে না অনেকেই।
মনে হয় দেশে অবৈধ আয়ের প্রতিযোগিতা চলছে। আরও প্রতিযোগিতা চলছে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার। বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের কথাও মাননীয় অর্থ মন্ত্রী স্বীকার করছেন। বিদেশ থেকে দেশে এ টাকা কিভাবে সুযোগ সুবিধা দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনা যায় তা নিয়ে সরকার ভাবছে কয়েক বছর ধরেই। যদিও বাস্তবে কোন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকা পাচার করা বিষয় দেশ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোচিত সমালোচিত।
সেই ১৯৮০ এর দশক থেকে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংক তথা সুইস ব্যাংকে টাকা পাচার করার কথা শুনে আসছিলাম। এখানে অর্থ নাকি যেমনি নিরাপদ তেমনি গোপনীয়তা থাকে। এতে ২০০৪ সাল থেকে গত বছর ২০২১ সাল পর্যন্ত টাকা পাচারের একটি পরিসংখ্যান জানা যায় বিভিন্ন টিভি ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি সাল বাদে বাকী সালগুলোতে টাকার অংক বাড়তেই আছে। মনে হয় দেশ থেকে টাকা পাচার করার প্রতিযোগিতা চলছে। যেখানে ২০২০ সালে ৫৩৪৮ কোটি টাকা পাচার হয়েছিল সেখানে ২০২১ সালে টাকা পাচার হয় ৮২৭৬ কোটি টাকা। যা সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলে। এত গেল টাকা পাচারের কথা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাড়ি ঘর প্রাসাদ বানানোর প্রতিযোগিতাও চলছে। দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডায় মনে হয় হাজার হাজার লোক অতি সম্প্রতি ঘর-বাড়ী বানিয়ে রেখেছেন। নিউইয়র্ক ও কানাডার টরন্টো বেগমপাড়ার কথা গত কয়েক মাস আগে সাধারণ জনগণের মাঝে আলোচনা সমালোচনার খোরাক হয়। অর্থাৎ স্বামীরা দেশে অবৈধ আয় করছে, আর স্ত্রীরা তথায় গিয়ে ঘর-বাড়ী তৈরি করে বসবাস করছে, করছে বিলাসবহুল জীবনযাপন। স্ত্রীরা বসবাসের কারণে এ এলাকার নাম হয়েছে বেগমপাড়া। এখন বিশ্বে আরামদায়ক সহজ আকাশপথে যাতায়াত ব্যবস্থা। বিমানের গতিও বেশি। অতএব বেগমরা ঘন ঘন দেশে সাহেবের কাছে আসবে অথবা সাহেবরা নানা অজুহাতে বেগমের কাছে যাবে।
দেশে এমন কোন অফিস আদালত বা সরকারী বেসরকারী স্বায়ত্তশায়িত অফিস প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে দুর্নীতি ব্যাপকতা লাভ করেনি। দুর্নীতি বর্তমানে দেশে সাধারণ ব্যাপার। সাগরে, বড় দীঘিতে মানুষ জালের কোপ ফেলে মাছ ধরার জন্য। দুদকও এদিক সেদিক দুর্নীতি ধরার জন্য কোপ ফেলে। শহরে ওয়ার্ড ভিত্তিক, গ্রামে ইউনিয়ন ভিত্তিক দুদকের কার্যালয় খোলা হলেও কতটুকু লাভ হবে? দুর্নীতি কি ন্যূনতমও কমবে! দুদকের সদিচ্ছা ও স্বচ্ছতা নিয়েও মাঝে মধ্যে প্রশ্ন শুনা যায়।
দেশে ব্যাপক দুর্নীতির উৎপত্তি মনে হয় ১৯৮০ এর দশকের শুরু থেকে। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ঐ অঞ্চল থেকে জাহাজে করে কর্ণফুলী মোহনার দক্ষিণ দিকে পারকিতে সিগারেট, টিভি, রেডিও, সুট প্যান্টের কাপড়, ক্রোকারিজ সহ বিদেশী দামি দামি জিনিস নিয়ে এসে থামত। শীপ থেকে সাম্পানে করে নামিয়ে ঐ এলাকার বাড়ী ঘরে রাখা হত। বড় বড় ব্যবসায়ীরা জাহাজ রিজার্ভ করে আনত। ছোট ব্যবসায়ীরা ঐ এলাকার বাড়ী ঘর থেকে এসব কিনে আনত। এ সব জিনিস চট্টগ্রাম শহরের শত শত দোকানে কিনতে পাওয়া যেত। দেশের বিভিন্ন শহরেও পাচার হত। জানি না আগ্রাবাদ সিঙ্গাপুর মার্কেটের নাম ঐকালের উৎপত্তি কিনা।
দেশে যে ১৯৮০ এর দশকের শুরু থেকে দুর্নীতিতে দ্রুত ব্যাপকতা লাভ করতে থাকে তা কোন সরকারের পক্ষে দমন করা, লাগাম টানা মনে করিনা সম্ভব হয়েছে। একাধিক সচেতন ব্যক্তি আমার সামনে আলাপ করতে শুনি গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার সাথে সাথে হঠাৎ করে দেশের দুর্নীতি অনেকটা থেমে গিয়েছিল। কিন্তু বছর যেতে না যেতে আবারও দেশ সাবেক অবস্থানে ফিরে যায়।
শত শত বা হাজার হাজার কোটি টাকা কামায় করার পর অনেকের মাঝে ভয় এসে যায়; মরণের পর কি হবে! কাজেই টুপি দাড়ি রাখা, নামাজ পড়া, নফল রোজা রাখা শুরু করে দেয়া হয়। হজের পাশাপাশি ঘন ঘন ওমরাহ করতে যাওয়া হয় পরিবার নিয়ে। শুধু তাই নয় ২জন, ৫ জন, কেউ ২০/৫০ জন বা আরও বেশি সংখ্যক লোককে হজে পাঠায়। দেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি মসজিদ মাদ্রাসা হাসপাতালও করা হচ্ছে। যাতে আল্লাহর কাছে অবৈধ সম্পদ আয়ের বিনিময় হয়ে যায়।
হারামের বীজ বপন যদি অবৈধ অর্জন নামক গাছে হয় তবে তার শাখা প্রশাখাও হারাম হয়ে যায়। শুকরের মাংস খাওয়া যেমন হারাম, অবৈধ হারাম আয়ের টাকায় কেনা গরু-ছাগলের গোশতও একইভাবে হারাম। শরীরের ভিতর যদি অবৈধ আয়ের রক্ত মাংস গড়ে তাও হারাম। নানানভাবে ১৭ কোটি মানুষের হক মেরে দিয়ে নিজেরা অর্থশালী ধনী বনে গেলেন।
দেশে তাদের প্রধান চাহিদা বউ বাচ্চার জন্য একটি দালান নির্মাণ করা। তারপর গাড়ি, তারপর আরও দালান। তারপর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাড়ানো। তা করা হয় প্রথমত স্ত্রীর নামে অতঃপর সন্তান-সন্ততি। অতঃপর শ্যালক শ্যালিকার নামে। তারপরও সম্পদ আরও বাড়লে ভাই বোনদের নামে।
সরাসরি বা বিভিন্ন শাখা প্রশাখার মাধ্যমে দেশের ১৭ কোটি জনগণের হক গজব করা হয় তা ক্ষমা পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। এ নিয়ে চিন্তা ত নয়ই বরং অবৈধ সম্পদের মাধ্যমে বাড়ি গাড়ি করে নিজে নিজে অতি সম্মানি বনে গেছেন। হয় সমাজসেবক, দেশদরদী, রাজনীতিবিদ, অনেকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেয়র, এমপি হয়ত মন্ত্রীও হচ্ছেন। ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের মধ্যে নাম দেয়া হয় গ্রুপ অব কোম্পানী, গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। কিন্তু মাত্র ২০/৩০ বছর বা ৩০/৪০ বছর আগে যাচাই করলে এ ধনীর বা ক্ষমতাবানের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যাবে না। ১৭ কোটি জনগণের হক ক্ষমা পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। অনুতপ্ত হলেও কোন কাজ হবে না। ইহার একমাত্র পথ অর্জিত সম্পদগুলো বিলিয়ে দেয়া, যা এমনহীন মানসিকতার মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়।
মহান আল্লাহ পাক হাশরের ময়দানে ক্ষমা চাওয়ার কারণে হয়ত সমস্ত পাপ মাফ করে দিবেন; কিন্তু ২টি পাপ ক্ষমা করবেন না। (১) শিরক (২) মানুষের হক।
এসব বিষয়ে মহান আল্লাহ পাক বলেন: হে মানুষ? তোমরা খাও, পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র বস্তু রয়েছে তা থেকে এবং তোমরা অনুসরণ করবে না শয়তানের পদচিহ্ন। নিশ্চয় সে ত তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৬৮)
আর তোমরা খাও, সে সব হালাল উৎকৃষ্ট জীবিকা থেকে, যা আল্লাহ তোমাদের দিয়েছেন। আর ভয় কর আল্লাহকে, যার প্রতি তোমাদের ঈমান রাখ। (সূরা মায়িদা, আয়াত-৮৮)
মহান আল্লাহ পাক পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র জিনিসই কবুল করেন। পবিত্র বস্তু ব্যতীত মহান আল্লাহ পাক কোন কিছু গ্রহণ করেন না বিধায় হাশরের ময়দানে শিরক করার পাশাপাশি বান্দার হককে মাফ করবেন না। যদিও জীবিত অবস্থায় খাস দিলে তাওবা করলে শিরকের গুনাহ মাফ হবে বলে আশা করা যায়।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেছেন, হারাম পথে সম্পদ উপার্জন করে বান্দা যদি তা দান করে দেয় আল্লাহ সে দান গ্রহণ করেন না। প্রয়োজন পূরণের জন্যে সে সম্পদ ব্যয় করলেও তাতে কোন বরকত হয় না। সে ব্যক্তি যদি সে সম্পদ রেখে ইন্তেকাল করে তা জাহান্নামের সফরে তার পাথেয় হবে। আল্লাহ অন্যায় দিয়ে অন্যায়কে মিটান না। বরং তিনি নেক কাজ দিয়ে অন্যায়কে মিটিয়ে থাকেন। নিশ্চয়ই মন্দ মন্দকে দূর করতে পারে না। (মিশকাত)
আল্লাহর রাসূল (স.) আরও বলেন, হারাম দ্বারা পুষ্ট দেহ জান্নাতে যেতে পারবে না। (মুসনাদে আহমাদ ও দারামী)
হালাল উপার্জন অন্যতম ফরজ এবাদত। আল্লাহ রাসূল (স.) বলেন, হালাল জীবিকা সন্ধান করা নির্ধারিত ফরজ সমূহের বিশেষ একটি ফরজ। (আবুল ইমান, বায়হাকি)
এসব লাখ লাখ লোককে মনে করি বড্ড বেকুব, বোকা, নির্বোধ। আত্মঘাতী কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষ যে মরণশীল, অবৈধ আয়কারীরা জানেন। তারা এও জানেন এ রেখে যাওয়া সম্পদ তার কোন কল্যাণে আসতেছে না। তিনি হয়ত অভিশপ্ত হিসেবে মৃত্যুবরণ করবেন। তার স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি অল্প ক’দিন কাঁদবেন, গরু জবাই করে মানুষকে খাওয়াবেন, তা হবে সপ্তাহ, ১০ দিন বা মাস। অতঃপর এ সম্পদ বড্ড বেকুব অভিশপ্ত ব্যক্তির সন্তান-সন্ততিরা মালিক হবে। মালিক বনার পর এখন অবৈধ সম্পদের মালিকানা পাওয়া সন্তানেরা তাদের সন্তান-সন্ততির জন্য বিভোর হয়ে যাবে। তেমনিভাবে ভুলে যাবে মুল মালিক পিতাকে, যা অনেকটা স্বাভাবিক বলা যায়।
দৈনিক আজাদীর মাধ্যমে যাদের যাদের কাছে এ কথাগুলো পৌঁছতেছে তারা গভীর রাতে একাকি ভাববেন নিজে কত বেকুব, বোকা, নির্বোধ ছিলেন মৃত্যুর আগে আত্মঘাতী কাজ করে অভিশপ্ত হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিবেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট