প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২০ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:১৩ পূর্বাহ্ণ

অধীনস্থদের প্রতি নবী পাকের (স.) দয়া

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আগেই উল্লেখ করেছি বহুকাল পূর্ব হতে বিশ্বে দাসপ্রথা চলে আসছিল। দাস-দাসীদের প্রতি যথেষ্ট দুর্ব্যবহার করা হত। তাদেরকে মানব সমাজের মধ্যেই গণ্য করা হত না, অতি ইতর শ্রেণী হিসাবে তাদের সহিত পাশবিক আচরণ করা হত। তাদের ব্যাপারে মানবাধিকারের কোন প্রশ্নই উঠত না। ঘটনাচক্রে কেউ একবার দাস হলে পরবর্তীকালে সে ‘আযাদ’হয়ে গেলেও কলংকের তিলক তার ললাট হতে মুছত না। কারও পূর্ব পুরুষের কেউ ক্রীতদাস হলে পরবর্তী বংশধররাও দাসরূপে গণ্য হত। দাস-দাসীগণকে ভোগ্যপণ্য হিসাবে ব্যবহার করা হত। তারা ছিল মনিবগণের মনোরঞ্জনের পাত্র। মাতা এবং কন্যা উভয়েই দাসী হলে মাতৃত্ব ও সন্তানত্বের ভেদাভেদটুকুর প্রতি মর্যাদাও প্রদর্শন করা হত না। দাস-দাসীদের খোরপোষ দানও ছিল মনিবের একান্ত অনুগ্রহের বিষয়। মনিবরা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বিভোর রইলেও দাস-দাসীদের ভাগ্যে জুটিত অর্ধাহার অনাহার। মানবতার এই গ্লানিকর যুগে সাম্যের অনুপম এক আহ্বান নিয়ে এই ধরাধামে আর্বিভূত হয়েছিলেন নবী পাক (স.)। তাঁর আহ্বান ছিল মানবাধিকার,সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের। মনিব ও দাস,শুধু এই পার্থক্যের কারণে একজন অন্যজন হতে তুচ্ছ বা মর্যাদাশালী হবার অধিকার রাখে না। তাঁর শিক্ষা ছিল মনিবরা যা ভক্ষণ করবে দাস-দাসীদিগকে সেই আহার্যই দিতে হবে, মনিবরা যা পরিধান করবে দাস-দিগকে তা পরাবে। শ্রেণী ভেদ নিয়ে ঠাট্টা ও বিদ্রুপ করার অধিকার নেই।

ইসলামের বৈপ্লবিক ঘোষণা: বিশ্বমানবতার এই অধঃপতনের যুগেই ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম দাসদিগকে তাদের হারানো মানবিক মর্যাদা পুনরায় ফিরিয়ে দিল। প্রভু ও দাস উভয়কে সম্বোধন করে ইসলাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করল

“ তোমরা একে অপরের সমান”
ইসলাম স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিল, যে ব্যক্তি আমাদের কোন দাসকে হত্যা করবে তাকে উহার বদলা হিসাবে হত্যা করা হবে। কেউ তার নাক কর্তন করলে, তার নাকও কর্তন করা হবে। যে তাকে খাসী (পুরুষত্বহীন) করবে তাকেও তদ্রুপ তারা হবে। (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী ও নাসাঈ)
“তোমরা সকলেই আদমের সন্তান এবং আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি হতে”। (মুসলিম, আবু দাউদ)। ইসলাম মনিবকে কখনও প্রভু হিসাবে মর্যাদা দেয় নাই, বরং মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদানের জন্য তাকওয়া এবং আল্লাহ ভীতিকেই ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেছে।

বলা হয়েছে: “তাকওয়া ছাড়া কোন আরব কোন আজমীর (অনারব) চেয়ে, কোন শ্বেতাঙ্গের চেয়ে কোন কৃষ্ণাঙ্গ কিংবা কৃষ্ণাঙ্গের চেয়ে, কোন শ্বেতাংগ মর্যাদায় উন্নত হতে পারে না। (বুখারী)

ইসলাম মনিবগণকে তাদের অধীনস্থ দাস -দাসীর সহিত ইনসাফপূর্ণ ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন: “মাতা-পিতার সহিত সত্যবহার কর। তোমাদের অধীনস্থ দাস-দাসীদের প্রতি বদান্যতা প্রদর্শন কর। নিশ্চয় আল্লাহ অহংকারী ও গর্বিত ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না।

ইসলাম মানুষের নিকট এই সত্যও পেশ করেছে যে, মনিব ও দাসের মূল সম্পর্ক মনিব ও গোলাম কিংবা হুকুমদাতা ও হুকুমকারীর নয়; বরং তা হল ভ্রাতৃত্ব ও ঘনিষ্ঠার সম্পর্ক। অতএব ইসলাম মনিবকে তার অধীনস্থ দাসীকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছে। আল্লাহ বলেন:
‘তোমাদের মধ্যে কারও স্বাধীন ঈমানদার নারী বিবাহের সামর্থ্য না থাকিলে তোমরা তোমাদের অধিকারভুক্ত ঈমানদার দাসী বিবাহ করিবে; আল্লাহ তোমাদের ঈমান সম্বন্ধে পরিজ্ঞাত। তোমরা একে অপরের সমান; সুতরাং তাদিগকে বিবাহ করিবে তাদের মালিকের অনুমতিক্রমে এবং তাহাদিগকে তাদের মাহ্‌র ন্যায়সংগতভাবে দিবে।

দাসদের সম্পর্কে মানবীয় ধারণা
ইসলাম মানবদিগকে এই ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে যে, দাসগণ তাদের ভাই। বিশ্বনবী (স.) বলেন:“ তোমাদের দাসগণ তোমাদের ভাই। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যার অধীনে তার কোন ভাই থাকবে সে যেন তার জন্য সেইরূপ খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করে যেরূপ সে নিজের জন্য করে এবং যে কাজ করার মত শক্তি তার নাই সেই কাজ করার হুকুম যেন সে তাকে না দেয়। একান্তই যদি সে সেইরূপ কাজের হুকুম দেয় তবে সে নিজে যেন তার সাহায্য করে। (বুখারী)
ইসলাম দাসদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অনুুভূতি-উপলব্ধির প্রতিও যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করেছে। নবী পাক (স.) বলেন: তোমাদের কেউ যেন (দাসদের সম্বন্ধে) এরূপ না বলে, সে আমার দাস এবং সে আমার দাসী। এর পরিবর্তে বলতে হবে, ঐ আমার সেবক এবং এই আমার সেবিকা।

হাদিসের এই শিক্ষা অনুযায়ী হযরত আবু হুরায়রা (র.) যখন দেখতে পান, এক ব্যক্তি ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে এবং তার গোলাম তার পেছনে পদব্রজে যাচ্ছে তখন তিনি ঐ ব্যক্তিকে বললেন, তাকে ঘোড়ার পিঠে তোমার পেছনে বসিয়ে দাও। কেননা সে তোমার ভাই। তোমার ন্যায় তাহারও একটি প্রাণ আছে।
ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর দাসদের জীবনে যে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয় তার ফলে তারা আর বেচাকেনার পণ্য থাকল না। মানব ইতিহাসে এই প্রথমবারই তারা স্বাধীন মানুষের মর্যাদা ও অধিকার লাভের সৌভাগ্য অর্জন করল। ইহার পূর্বে তাদেরকে মানুষ বলে গণ্য করা হত না। তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য হল,তারা অন্যদের সেবা করবে এবং মনিবের অত্যাচার-উৎপীড়ন ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনা নীরবে সহ্য করবে। দাসদের সম্পর্কে এইরূপ ন্যক্কারজনক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাদেরকে বেধড়ক হত্যা করা হত। বর্বরোচিত ও পাশবিক শাস্তির চর্চাস্থল গণ্য করা হত। চরম ঘৃণা মনে করা হত এবং কঠিন কাজ করতে বাধ্য করা হত। কারও অন্তরে তাদের জন্য সামান্যতম দয়া বা সহানুভূতির উদ্রেক হত না। ইসলামে নবী পাক (স.) দাসদিগকে এই করুণ অবস্থা হতে উদ্ধার করে স্বাধীন মানুষের সহিত একই কাতারে দাঁড় করিয়ে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। ইসলামে নবী পাক (স.)’র এই কীর্তি কোন মুখরোচক ঘোষণা মাত্র নয়, বরং মানব ইতিহাসের এক অমোঘ সত্য, উহা পাতায় পাতায় ইহার সাক্ষ্য বর্তমান।

ঐতিহাসিক বিদায় হজ্বের ভাষণে নবী পাক (স.) সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে দাস-দাসীদের প্রতি সদাচরণ করতে, তাদেরকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে এবং তাদের প্রতি দয়াপরবশ হতে নির্দেশ প্রদান করেন:
“তোমাদের দাসগণ, তোমাদের দাসগণ। তোমরা যা ভক্ষণ কর তা তাদেরকে ভক্ষণ করতে দিবে। তোমরা যেরূপ কাপড় পরিধান করবে তদ্রুপ কাপড় তাদেরকেও পরিধান করতে দিবে। সমাপ্ত
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধসড়কে আর কত লাশের মিছিল দেখতে হবে