২৭ রজব তথা ২৬ রজব দিবাগত রাত পবিত্র মেরাজের রাত।
গ্রহণযোগ্য মতে এই রাতে নবী পাক (স.) পবিত্র মসজিদুল হারম থেকে মসজিদে আকসা হয়ে আল্লাহ পাকের সান্নিধ্যে গমন করেন। মেরাজ শব্দটি আরবি ‘ওরশ’ শব্দ থেকে আগত। এর আভিধানিক অর্থ উপরে আরোহণ করা, উর্ধ্ব গমন করা ইত্যাদি। নবী পাক (স.) ঐ রাতে মসজিদে আকসা হয়ে উর্ধ্বজগতে বিভিন্ন স্তরে গমন করেন। সপ্তম আকাশ বায়তুল মামুর, সিদরাতুল মুনতাহা এবং তা থেকে উচ্চতর অতিক্রম করে মহান আল্লাহ পাকের অলৌকিক নিদর্শন সমূহ অবলোকন করেন। পবিত্র মক্কায় মসজিদুল হারম থেকে বিদ্যুতের চেয়েও দ্রুতগতি সম্পন্ন বাহন (বোরাক) সহযোগে নবী পাক (স.) প্রথমে জেরুজালেমে মসজিদে আকসায় যাত্রা বিরতি দেন।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘সেই পূতঃ পবিত্র সত্তা, যিনি তার বান্দাকে স্বীয় নিদর্শনাদি দেখানোর উদ্দেশ্যে কোন এক রাতে মসজিদুল হারম থেকে মসজিদে আকসায় ভ্রমণ করান যার চারপার্শ্বকে তিনি বরকতময় করেছেন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।’
মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) পবিত্র মক্কা মোকাররমায় পবিত্র কাবা নির্মাণের ৪০ বছর পর জেরুজালেমে মসজিদে আকসা নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে হযরত সুলায়মান (আ.) এ আল আকসা মসজিদ পুনঃ নির্মাণ করেন।
১ লাখ ৪০ হাজার ৯ শত বর্গমিটার এরিয়া নিয়ে মসজিদে আকসা বা বায়তুল মোকাদ্দাস। এখানকার পবিত্র মক্কার দিকে শেষ প্রান্তে মসজিদে আকসা বা বায়তুল মোকাদ্দাসের অবস্থান। যা প্রকৃত দৈর্ঘ্য ৮০ মিটার প্রস্থ ৫০ মিটার। নবী পাক (স.) উর্ধ্বাকাশে গমনের আগে এখানে সমস্ত নবী রাসূলগণকে নিয়ে ২ রাকাত নামাজ আদায় করেন। অতঃপর অলৌকিক পাথর হয়ে উর্ধ্বাকাশে গমন করেন।
এটা বিশ্বে একটি বরকতময় পাথর। বিশ্বের বুকে তিনটি বরকতময় পাথর রয়েছে। পবিত্র কাবায় হাজরে আসওয়াদ ও মকামে ইব্রাহীম দুই পাথর, ৩য় পাথর বায়তুল মোকাদ্দেসে। উম্মতে মুহাম্মদী ইহা শূন্যের উপর ঝুলন্ত পাথর হিসেবে মনে করে থাকে। বাস্তবেও মসজিদে আকসার এরিয়ার মধ্যখানে এ পাথরের অবস্থান। যার দৈর্ঘ্য প্রস্থ ৭ী৫ মিটার। নবী পাক (স.) এ পাথরের উপর উঠে উর্ধ্বকাশে গমন করেছিলেন। বর্তমানেও সিঁড়ি দিয়ে এ প্রকান্ড পাথরের নিচে ৩০/৪০ জন মানুষ নামাজ পড়তে পারে।
এই পাথরের সম্মানার্থে সোনালী আবরণে প্রকান্ড এক গম্বুজের দৃষ্টিনন্দন ইমারত নির্মাণ করা হয়। যাকে মসজিদে গম্বুজে সাখরা বলে। সাখরা অর্থ পাথর। আমরা পত্র পত্রিকার ক্যালেন্ডারে ৮ ভাজে গোলাকৃতির সোনালী আবরণে এক গম্বুজে এ মসজিদে গম্বুজে সাখরা প্রায় দেখে থাকি। এখান থেকে মাত্র দেড় শত মিটার দূরত্বে মূল মসজিদে আকসা। তার পশ্চিম পাশে বোরাকের স্থান। যেখানে বোরাক বাহনকে রাখা হয়েছিল।
ঝুলন্ত এই পাথরের রয়েছে তাৎপর্যময় ইতিহাস। মানবজাতির পিতা হযরত আদম (আ.) এ পাথরের উপর আগুনের স্তম্ব দেখে এখানে মসজিদ নির্মাণ করেন। নবী হযরত ইউশা (আ.)’র উপর গম্বুজ নির্মাণ করেন। নবী হযরত দাউদ (আ.) এর কাছে মেহেরাব এবং নবী পাক সুলায়মান (আ.) পবিত্র ইবাদত বা হাইকেলে সুলায়মানী নির্মাণ করেছেন। আর এ পাথরের উপর নবী পাক (স.) বসেন এবং বোরাকে ছড়ে আল্লাহপাকের সান্নিধ্যে গমন করেন।
পরবর্তীতে ওমাইয়া খলিফা আবদুল খালেক বিন মারওয়ান এ পাথরের সম্মানার্থে গম্বুজে সাখরা নির্মাণ করেন। যুগে যুগে এ ইমারত নির্মাণ পুনঃ নির্মাণ হয়ে আসছিল। সর্বশেষ বর্তমান ইমারত তুর্কি সুলতানগণের নির্মিত বলে ধারণা করা হয়।
মসজিদে গম্বুজে সাখরা মুসলিম স্থাপত্যের মধ্যে একটি দৃষ্টিনন্দন আকর্ষণীয় ইমারত।
নবী পাক (স.) গভীর রাতে মসজিদুল হারমের উম্মে হানি মতান্তরে হাতিম থেকে মসজিদে আকসায় আসেন। এখানে সমস্ত নবী সমস্ত রাসূলগণ নিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। অতঃপর উর্ধ্বকাশে মহান আল্লাহ পাকের সান্নিধ্যে গমন করেন। আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে নবী পাক (স.) তাঁর উম্মতগণের জন্য দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামাজ নিয়ে আসেন। যা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য ফরজ। এ মেরাজ বিষয়ে রয়েছে দীর্ঘ বর্ণনা।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, নবী পাক (স.)’র মেরাজের পর এ ঘটনা ইসলাম বিদ্বেষীরা সম্পূর্ণ মিথ্যা অবান্তর বলে আখ্যায়িত করতে থাকে। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর নবী পাক (স.) বিভিন্ন রাজা বাদশাহ গোত্র প্রধানগণের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চিঠি প্রেরণ করেন। তেমনিভাবে রোম সম্রাট হিরা ক্লিয়াসের কাছে পত্র পাঠান। ঐ সময় তিনি জেরুজালেমে অবস্থান করেছিলেন। পত্র বাহক মহান সাহাবা হাদিয়া ইবনে কালবী (র.) জেরুজালেম পৌঁছেন। সম্রাট দোভাষীর মাধ্যমে চিঠি পড়ে আরব ও নবী পাক (স.)’র অবস্থা জানতে জেরুজালেমে কোন আরবীয় বণিক থাকলে তাদেরকে দরবারে হাজির করতে নির্দেশ দেন। ঐ সময় ব্যবসায়িক প্রয়োজনে কয়েকজন সাথীসহ আবু সুফিয়ান জেরুজালেম অবস্থান করছিলেন। আবু সুফিয়ান গংকে সম্রাটের দরবারে হাজির করা হয়।
সম্রাটের ১০/১২ টি প্রশ্নের মধ্যে আবু সুফিয়ান অন্য সব প্রশ্নের উত্তর সঠিক দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু মেরাজের ঘটনাকে টেনে এনে এ অলৌকিক সফর নবী পাক (স.)’র মুযাজা হিসেবে মেরাজের এ সফর মিথ্যা, বানোয়াট ও কাল্পনিক অগ্রহণযোগ্য বলেন সম্রাটকে। এ সময় সম্রাটের পেছনে দাড়ানো লাট পদবী প্রধান যাজক ও পন্ডিত মেরাজের ঘটনা সত্য বলে দৃঢ় কণ্ঠে বলেন। এতে সম্রাট হতচকিত হয়ে বিষয়টি জানতে চান। ফলে প্রধান যাজক মেরাজের রাতে মসজিদে আকসার সমস্ত দরজা বন্ধ করতে পারলেও কোন যৌক্তিক কারণ ছাড়া একটি দরজা বন্ধ করতে অক্ষম হন। শেষ পর্যন্ত দরজা খোলা রাখতে হয়েছিল। ধর্ম জাযক ভোরে এসে অবাক হন দরজায় কোন ত্রুটি নেই। স্বাভাবিকভাবে খোলা বন্ধ বরা যাচ্ছে।
ধর্মযাজক এও অনুধাবন করেন এখানে রাতে অনেকের আগমন হয়েছে এবাদতের উদ্দেশ্যে অতএব তিনি পবিত্র মক্কা থেকে আগত আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (স.) বাদে আর কেউ নন। মুযাজার বিষয় দৈনিক আজাদীতে অন্য প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলাম। ধর্মযাজকের কথা শুনে আবু সুফিয়ান লজ্জিত হন, সম্রাট অভিভূত হন। প্রকৃতপক্ষে নবী রাসূলগণের নানান মুযাজা থাকবে স্বাভাবিক। আল্লাহর রাসূল (স.)’র অনেক মুযাজার মধ্যে ইহা অন্যতম একটি। যা ২৬ রজব দিবাগত রাতে ঘটেছিল। উম্মতে মুহাম্মদী এই রাতকে পবিত্রতম মনে করে মূল্যায়ন করে থাকে। মেরাজের যাত্রাপথে নবী পাক (স.) ১ম আসমানে হযরত আদম (আ.), ২য় আসমানে হযরত ইয়াহিয়া (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.), ৩য় আসমানে হযরত ইউসুফ (আ.), ৪র্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস (আ.), ৫ম আসমানে হযরত হারুন (আ.), ৬ষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (আ.) এবং ৭ম আসমানে হযরত ইব্রাহীম (আ.)’র সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। তাঁরা সকলেই নবী পাক (স.) কে শ্রদ্ধাভরে সালাম ও মোবারকবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনিও তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম জানান। তাঁদের নব্যুওয়াতের স্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।
সিদরাতুল মুনতাহার নিকট পৌঁছলে হযরত জিব্রাইল (আ.)’র যাত্রা বিরতি হয়। অতঃপর নবী পাক (স.) অনাদি, অনন্ত, অবিনশ্বর, অসীম শক্তি, সার্মথ্য ও প্রজ্ঞার অধিকারী মহান আল্লাহ পাকের একান্ত সান্নিধ্যে এলেন। পর্দার এক পার্শ্বে বিশ্ব জাহানের মালিক চির অরাধ্য এক ও অদ্বিতীয় মাবুদ স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহ, অন্যপাশে তাঁর একান্ত অনুগ্রহ ভাজন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও প্রিয়তম রাসূল হযরত মুহাম্মদ (স.)। তাঁদের মধ্যখানে ধনুকের মত জায়গা বা তার চাইতেও কম ব্যবধান। অনুষ্ঠিত হল স্রষ্টা ও সৃষ্টির অভূতপূর্ব সাক্ষাতকার। মহান পরাক্রমশালী আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীর উদ্দেশ্যে সালাম, রহমত ও বরকতের বাণী পৌঁছালেন। তোহফা স্বরপ বরাদ্দ করা ৫০ ওয়াক্ত সালাত অনুরোধক্রমে কমিয়ে ৫ ওয়াক্ত মঞ্জুর করে নেন। পবিত্র শরে মেরাজ পবিত্রতম রাত, আল্লাহর রাসূল (স.)’র মুযাজা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট












