প্রবাহ

প্রধান বিচারপতি সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসীর আওলাদ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ

বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী প্রধান বিচারপতি হলেন। গত রবিবার (২৮ ডিসেম্বর) বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ হয়। তিনি হচ্ছেন রসূলনোমা সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.)’র আওলাদ। তথা বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর সরাসরি নানা এডভোকেট সৈয়দ জানে আলম। তাঁরই আপন দাদা হযরত ওয়াইসী (রহ.)। হযরত ওয়াইসীর জন্মস্থান চট্টগ্রামে। মাজার কলকাতা মানিকতলায়।

বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী প্রখ্যাত বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরীর পুত্র। আবদুর রহমান চৌধুরী বরিশালের বিখ্যাত জমিদার খান বাহাদুর আবদুল লতিফ চৌধুরীর পুত্র।

সপ্তাহখানেক আগে বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী প্রধান বিচারপতি হওয়ার সিদ্ধান্তে ফেসবুকে একাধিক ব্যক্তির আলোচনা আমার দৃষ্টিতে পড়ে। তৎমধ্যে তাঁর পৈতৃক পরিচিতি তুলে ধরা হচ্ছিল। যেহেতু তিনি খান বাহাদুর আবদুল লতিফ চৌধুরীর নাতি বৃহত্তর বরিশালের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। জনকল্যাণে নানান অবদান রয়েছে তাঁর। তাঁরই সাহসী সন্তান বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী।

বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নানার সরাসরি দাদা রসূলনোমা সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.) তরিকতের মহান শেখ। ভারতবর্ষে রসূলনোমার মধ্যে তিনি অন্যতম ও প্রসিদ্ধ। যেহেতু তাঁর রেখে যাওয়া ৩৫ জন খলিফার মধ্যে বেশ কয়েকজন বিশ্বখ্যাত। তৎমধ্যে ফুরফুরা সুফি গোলাম সালমানী আব্বাসী, হযরত আবু বকর সিদ্দিকী, কলকাতায় শায়িত ফরিদপুরের সৈয়দ ওয়াজেদ আলী, কুচবিহারের সুফি একরামুল হক ভারতবর্ষ পেরিয়ে তাসাউফ জগতে বিশ্বখ্যাত বলা যাবে।

১৯৬০ এর দশকে ছাত্রজীবনে দক্ষিণ চট্টগ্রামের গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুরের নিকট মুরিদ হওয়ার সৌভাগ্য হয়। আমার পীর হযরত বড় হুজুরের ৪৩২ পৃষ্ঠাব্যাপী জীবনীগ্রন্থ লেখা হয় ২০০২ সালের দিকে। গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসীর উপর অনেকটা ধারণা লাভ করি। যেহেতু আমার দাদা পীর হচ্ছেন ভারতে উত্তরপ্রদেশের আজমগড় জিলার বাসিন্দা হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হামেদ হাসান আলভী প্রকাশ আজমগড়ী হযরত। তাঁর পীর হচ্ছেন ভারতের বান্ডেলে শায়িত হযরত সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী। তাঁরই মুজাদ্দেদিয়া তরিকার পীর হচ্ছেন ফুরফুরা সুফি গোলাম সালমানী আব্বাসী (রহ.)। তাঁরই সরাসরি পীর রসূলনোমা সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.)। তিনি কলকাতা ও মুর্শিদাবাদে জীবন অতিবাহিত করেন।

মুর্শিদাবাদের পুনাশিতে বিবি ফাতেমাকে শাদী করেন। এতে তাঁর পুত্র সৈয়দ গোলাম মোস্তফা আলী ও কন্যা সৈয়দা জোহরা খাতুন। সৈয়দা জোহরা খাতুনকে মুর্শিদাবাদের শাহপুরে জমিদার বাড়ীতে বিয়ে দেয়া হয়। তাঁকে রাবেয়ায়ে বাঙ্গাল তথা বাংলার রাবেয়া বসরী বলা হয়। তিনি দূররে মাখনুন বা গোপ্তমতী নামে অভিহিত। হযরত ওয়ায়েসী (রহ.)’র খলিফাগণ তাঁকে সমীহ করতেন।

হযরত ওয়াইসীর পুত্র সৈয়দ গোলাম মোস্তফা আলী উচ্চ শিক্ষিত কামেল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। পিতার স্থলে কলকাতাতে ঐ চাকুরীতে যোগদান করেন। কলকাতা সংবাদপত্রে লেখালেখি করতেন। তিনি ইন্তেকাল করলে মুর্শিদাবাদ পুনাশিতে শায়িত করা হয়। সৈয়দ গোলাম মোস্তফা আলীর তৃতীয় পুত্র এডভোকেট সৈয়দ জানে আলম। ১৯০২ সালে মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হন। কলকাতা আলীপুর জজ কোর্টে ১৯৩০ সাল হতে উকালতি শুরু করেন। তথায় ১০ বছর উকালতি করার পর কলকাতা জজ কোর্টে যোগদান করেন ১৯৪০ সালে। তাঁর স্ত্রী সৈয়দা সাদেকা খাতুন ১৯৪৫ সালে ইন্তেকাল করলে কলকাতা গোবরা কবরস্থানে শায়িত করা হয়। এডভোকেট সৈয়দ জানে আলমের কন্যা সৈয়দা সেতারা খাতুন এবং পুত্র ব্যারিষ্টার শাহীদ আলম। দু’সন্তানকে নিয়ে এডভোকেট সৈয়দ জানে আলম ১৯৫১ সালে ভারত থেকে ঢাকায় স্থায়ীভাবে চলে আসেন। ঢাকা হাইকোর্টে আইন পেশায় যোগ দেন। পরে এটর্নি জেনারেল ছিলেন। তাঁরই কন্যা সৈয়দা সেতারা খাতুনের সাথে বিয়ে হয় খ্যাতনামা বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরীর সাথে। বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী ও সৈয়দা সেতারা রহমান চৌধুরীর সংসারে দুই পুত্র, দুই কন্যা। তৎমধ্যে একপুত্র বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশের ২৬ তম প্রধান বিচারপতি হলেন।

তিনি ১৯৮৫ সালে জজ কোর্টে এবং ১৯৮৭ সালে হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০৩ সালে ২৭ আগস্ট জুবায়ের রহমান চৌধুরী অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে হাইকোর্টে নিয়োগ পান। এর দু’বছর পর তিনি হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি হন। ২০২৪ সালের ১২ আগস্ট আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি ও এল.এল.এম করেন। যুক্তরাজ্য থেকেও আন্তর্জাতিক আইনে এল.এল.এম করেন।

উল্লেখ করা আছে, ১৯৬০ এর দশকে ছাত্র জীবনে গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুরের জীবনী লেখার সুযোগ হয়। বছরব্যাপী সময় দিয়ে জীবনীগ্রন্থকে সমৃদ্ধ করতে নানান তথ্য তালাশ করতে থাকি। এতে রসূলনোমা সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসীর উপর অনেক ধারণা লাভ করি। পরে মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসীর উপর জীবনীগ্রন্থ রচনা করতে আগ্রহ জাগে। যেহেতু তাঁর উপর বিচ্ছিন্ন তথ্য বাদে ধারাবাহিক কোন জীবনীগ্রন্থ মনে হয় বাংলাদেশে ছিল না। ফলে জীবনীগ্রন্থ লিখতে তৎপর হই। কলকাতা গমন করা হয়। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পুনাশি ও শাহপুর গমন করি। পুনাশিতে রাত্রিযাপন করা হয়।

গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁর আওলাদ বিধায় বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর সাথে ন্যূনতম যোগাযোগ হয়। তাঁর স্থলে তাঁর মায়ের একমাত্র ভ্রাতা তথা মামা ব্যারিষ্টার সৈয়দ শাহীদ আলমকে প্রধান অতিথি করে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ হলে ২০০৫ সালে ব্যাপক সমাগমে প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়। গ্রন্থের নামকরণ করা হয় “শানে ওয়াইসী”। মনে হয় সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসীর উপর বাংলাদেশে প্রথম জীবনীগ্রন্থ। শানে ওয়াইসী কলকাতা থেকে ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। পরবর্তীতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গ্রন্থটি ২০১২ সালে পুনঃমুদ্রণ করে জেলাওয়ারী সরবরাহ করে। ফলে রসূলনোমা সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসীর মোবারক জীবনের উপর দেশের অসংখ্য নরনারী ধারণা লাভ করতে সক্ষম হন।

সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসীর পীর হচ্ছেন বালাকোটের গাজী সুফি নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী। তাঁর পীর হচ্ছেন বালাকোটের সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ.)। তাঁর পীর হচ্ছেন শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দেস দেহলভী। তাঁর পীর ও পিতা হচ্ছেন শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী।

সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসীর জন্ম চট্টগ্রাম লোহাগাড়া উপজেলার মল্লিক সোবহানে। এখানে তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে গেইট ও মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সকলের সহযোগিতা নিয়ে এই মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন মাওলানা মুহাম্মদ সামশুদ্দীন (রহ.)। আমারও এখানকার গেইট ও মহিলা মাদ্রাসার সাথে ন্যূনতম সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ হয়েছে। এই মাদ্রাসায় দীর্ঘদিন থেকে সভাপতি বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর সহোদর বড় বোন রোশেলী রহমান চৌধুরী। তিনি চট্টগ্রামের প্রখ্যাত চিকিৎসক মঈনুল ইসলাম মাহমুদের স্ত্রী।

বস্তুত প্রধান বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী বিশ্বে তাসাউফ জগতের মহান ব্যক্তিত্ব রসূলনোমা সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.)’র সরাসরি আউলাদ তথা বংশধর। তিনি পিতার দিক দিয়েও প্রখ্যাত জমিদার সমাজসেবক মানবকল্যাণে নিবেদিত প্রাণ খান বাহাদুর আবদুল লতিফ চৌধুরীর নাতি। দেশে সুষ্ঠু সুন্দর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তাঁর সাফল্য কামনা করছি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা বেগম খালেদা জিয়া : এক অপরাজেয় ইতিহাস
পরবর্তী নিবন্ধকুতুবদিয়ায় বৃত্তিপ্রাপ্তদের পুরস্কার প্রদান ও গুণীজন সম্মাননা