প্রবাহ

খলিফা হিসেবে হযরত আলীর জীবনপ্রবাহ

আহমদুল ইসরাম চৌধুরী | বুধবার , ৫ নভেম্বর, ২০২৫ at ১০:৪৬ পূর্বাহ্ণ

আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (.) মাত্র ৯/১০ বছর বয়সে মুসলমান হন তথা ঈমান আনেন। হযরত খাদিজাতুল কোবরার পর দ্বিতীয় মুসলমান। বদরের যুদ্ধসহ বড় বড় যুদ্ধে ইসলামের জন্য প্রথম যে ব্যক্তি তলোয়ার হাতে নিয়েছিলেন তিনিই হলেন হযরত আলী। যিনি ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। আহলে বায়েত তথা নবী পরিবার বলতে চার জনকে বুঝায়। হযরত আলী, মা ফাতেমা, ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন। তিনি মুসলিম জাহানের ৪র্থ খলিফা। ৪ বছর ৯ মাস খেলাফতের দায়িত্বরত ছিলেন। মুসলিম জাহানের খেলাফতের দায়িত্ব পালনকালেও তাঁর জীবনের কোন পরিবর্তন আসেনি।

তিনি আড়ম্বরহীন অতি সাধারণভাবে জীবন যাপনের পাশাপাশি খেলাফতের দায়িত্বও সমানভাবে পালন করে জীবনের শেষ সময়টুকু কাটিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল (.) এর অন্য তিন খলিফার চেয়ে হযরত আলীর আলাদা মর্যাদা রয়েছে। ছিলেন আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত। তাঁর জ্ঞানগরিমা ছিল অসাধারণ। তিনি ছিলেন বীরত্বে সেরা, যুদ্ধে হার মানেন নি কোনদিন। ছিলেন তাসাউফের প্রধান ইমাম। মা ফাতেমার স্বামী এবং ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন এর গর্বিত পিতা।

এ মহান খলিফা শ্রম দিয়ে উপার্জন করে কালাতিপাত করতেন। কোন কোন সময় খাদ্যশূন্যতায় অনাহারে থাকতেন । হযরত আলী বৃহত্তর স্বার্থ মনে করে মুসলিম জাহানের রাজধানী মদিনা মুনাওয়ারা থেকে কুফায় স্থানান্তর করেছিলেন। আজ পর্যন্ত গত ১৪০০ বছরের ইতিহাসে এ খেলাফতের রাজধানী মক্কা মোকাররমা বা মদিনা মুনাওয়ারা তথা হেজাজে ফিরে আসেনি। খলিফা হযরত আলী ৪০ হিজরীর রমজানে এক খারিজী বিদ্রোহীর ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয়ে শাহাদাতবরণ করেন এবং বর্তমান ইরাকের কুফা নগরীর ১০ কি.মি. দূরত্বে নজফে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ।

হযরত আলীর খেলাফত জীবনের কয়েক খণ্ড চিত্র পাঠ করলেই অনায়াসে বুঝে নিতে পারব আমরা উম্মতে মোহাম্মদী দাবী করেও কিভাবে জীবন যাপন করছি। বিশেষ করে ৫৫ বা ৫৬ টি মুসলিম রাষ্ট্রের রাজাবাদশাহ প্রেসিডেন্টপ্রধানমন্ত্রীদের শিক্ষণীয় অনুকরণীয় অনুসরণীয়। আর মহান খলিফা ও আহলে বাইতের প্রধান কি রকম জীবনচিত্র ছিল।

্ম কুফা নগরীর প্রসিদ্ধ জামা বিক্রেতা হযরত আবু নুজিয়া বর্ণনা করেন, একদিন হযরত আলী (.) তার দোকান হতে দুটি জামা খরিদ করেন। অপেক্ষাকৃত ভাল জামাটি তিনি ভৃত্যকে প্রদান করেন এবং সস্তা দামের মোটা জামাটি তিনি নিজের জন্য রাখেন।

্ম হযরত ওমর ইবনে কায়েস খলিফা হযরত আলীকে প্রশ্ন করেন, তালি দেওয়া জামা পরিধান করার কারণ কি?

উত্তরে তিনি বল্লেন, হে ওমর! এরূপ তালি দেওয়া পোশাক হৃদয়কে কোমল করবে এবং গর্ববোধ বিদূরিত হবে। আর এ পোশাকই তো এদেশের দরিদ্র মুসলিম জনগণ পরিধান করে থাকেন।

্ম ইবনে নোয়াজা নামক এক খারেজী কুফা নগরীতে বসবাস করতেন। তিনি খলিফা হযরত আলীকে তালি দেওয়া পোশাক পরিধান সম্বন্ধে ব্যঙ্গোক্তি করায় হযরত আলী উত্তরে বললেন, তুমি আমার পোশাকে আপত্তিকর কি দেখতে পাচ্ছ? এর চেয়ে ভাল পোশাক তো এদেশের সাধারণ মানুষ পরিধান করতে পারে না। তুমি সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার এবং পোশাক পরিচ্ছেদের মানদণ্ডে আমার বিচার করছোনা কেন? আমি সাধারণ জনগণের পোশাক পরিচ্ছেদের চেয়ে উন্নত পোশাক পরিধান করতে পারি না।

্ম ইবনে আবি রাফে (.) বর্ণনা করেন, কোন এক ঈদের দিনে আমি হযরত আলী (.) এর নিকট গমন করি। আমি তথায় থাকাকালীন খলিফার নিকট একটি সীলমোহর করা থলে আনা হল। খলিফা হযরত আলী (.) সীলমোহর করা থলেটি খুলে কয়েকটি শুকনো রুটি বের করলেন এবং পানিতে ভিজিয়ে রুটিগুলো নরম করলেন। আমি বললাম, এ জাতীয় খাদ্য সীলমোহর করার কি বা প্রয়োজন থাকতে পারে। কোন চোরও তো এসব রুটি চুরি করতে চাইবে না।

আমিরুল মোমেনিন মৃদু হেসে বললেন, আমি যত্নপূর্বক রুটিগুলো বন্ধ করে রাখি। কারণ আমার পরিবার তৈল বা মাখনযুক্ত নরম রুটি দিতে চেষ্টা করে!

আমি পুনঃ প্রশ্ন করলাম, মহান আল্লাহ কি আপনার জন্য ভাল খাবার হারাম করে দিয়েছেন?

উত্তরে খলিফা শেরে খোদা বললেন, ঐ খাদ্যই খাওয়া আমার পক্ষে সঙ্গত যা খেলাফতের দরিদ্রতম ব্যক্তি অন্ততঃ দিনে একবার খেতে পারে। জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নত করা সম্ভব হলে আমিও আমার জীবনযাত্রার মান উন্নত করব। আমি চাই তাদের ন্যায় জীবন যাপন করতে, তাদের আনন্দ অনুভব করতে এবং তাদের দুঃখে দুঃখ অনুভব করতে।

্ম হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (.) বলেন, আমি কোন এক ঈদে খলিফা হযরত আলী (.) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই। তিনি আমাকে তার সাথে নাস্তা করতে আহ্বান জানালে আমি সম্মত হই। কিন্তু খুবই নিম্নমানের খাবার আমাদের সামনে পরিবেশন করা হল।

আমি হযরত আলী (.)-কে প্রশ্ন করলাম, আপনি একজন ক্ষমতাশালী খলিফা তথা রাষ্ট্রপ্রধান। আশা করেছিলাম, অন্য কিছু না হোক, অন্ততঃ গোস্ত আমাদের সম্মুখে আসবে। কিন্তু আমাদের সম্মুখে কি দেখতে পাচ্ছি?

উত্তরে খলিফা বললেন, আমি একজন অতি সাধারণ শ্রমিকের ন্যায় জীবন যাপন করতে চাই।

্ম হযরত সোয়াইদা (.) বলেন, একদিন আমি হযরত আলী (.) এর সঙ্গে দারুল ইমারতে (প্রেসিডেন্ট হাউস) সাক্ষাৎ করতে যাই। তখন ছিল নাস্তার সময়। আমি খলিফার সম্মুখে কয়েকটি যবের রুটি এবং এক পেয়ালা দুধ দেখতে পাই। রুটিগুলো ছিল মোটা, শক্ত এবং কঠিন। তাতে ছিল না তৈল বা মাখন। ঐ শক্ত রুটিগুলো অনায়াসে ভাঙ্গাও কষ্টসাধ্য ছিল। তখন আমি খলিফার ভৃত্যকে বললাম, তোমার কি কোন দয়ামায়া নেই যে, তোমরা খলিফাকে কিছু নরম রুটি দিতে পারনা? সামান্য একটু তৈল বা মাখন কি তোমাদের জোটে না? উত্তরে ভৃত্য বলল, খলিফার যখন নিজের প্রতি দয়ামায়া নাই তখন আমাদের করার কি থাকতে পারে। তিনি কড়া নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর রুটির সাথে যেন তৈল, ঘি, মাখন মিশানো না হয়। এমনকি আটা হতে তুষ এবং ভূষি পৃথক না করতে বলেছেন। আমি ভৃত্য হয়েও তাঁর থেকে অনেক ভাল খাবার খেয়ে থাকি। এ কথাগুলো আমি (সোয়াইদা) খলিফাকে বললাম, নিজের প্রতি জুলুম না করতে এবং আরও বললাম বয়স, দায়িত্ব ও পরিশ্রমের কথা চিন্তা করে নিজের খাদ্য সম্বন্ধে একটু ভেবে দেখতে। আমিরুল মোমেনিন হযরত আলী (.) উত্তরে বললেন, ও হে সোয়াইদা ! আল্লাহর রাসুল (.) কি খাবার খেতেন সে সম্বন্ধে কি আপনার ধারণা নেই?

্ম হযরত হারুন ইবনে আজমা বলেন, আমি একদিন আব্বার সাথে আমিরুল মোমেনিন হযরত আলী (.) এর সাথে দেখা করতে যাই। তখন শীতকাল ছিল। খলিফার শরীরে পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় কাঁপতেছিলেন। খলিফাকে কাঁপতে দেখে আমার পিতা বললেন, আমিরুল মোমেনিন! বাইতুল মালে আপনি ও আপনার পরিবারের অধিকার মহান আল্লাহ পাক কর্তৃক স্বীকৃত। আপনি কেন বাইতুল মাল হতে আপনার অধিকার গ্রহণ করছেন না?

উত্তরে হযরত আলী (.) বললেন, আমি অতি সাধারণ জনগণের মত জীবন যাপন করতে চাই। আর আমার পরিধেয় কাপড়চোপড় মদিনা মুনাওয়ারা হতে এনেছি।

মুসলিম জাহানের মহান খলিফা মা ফাতেমার স্বামী আল্লাহর রাসূল (.)’র সরাসরি আপন চাচাতো ভাই শিশুকালে ইসলাম গ্রহণকারী, ইসলামের প্রারম্ভে প্রতিকূল অবস্থায় প্রতি যুদ্ধে প্রথম তলোয়ার হাতে নিয়ে জীবনকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যকারী, ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের গর্বিত পিতা হযরত আলী (.)। আমিরুল মোমেনীন হিসেবে খেলাফত সময়ের কয়েকটি মাত্র খন্ড চিত্র এখানে উপস্থাপন করা গেল। এমনিভাবে খেলাফত পরিচালনা করে গেছেন তাঁর অগ্রজ তিন খলিফাও।

আজ মুসলিম জাহানের দিকে দৃষ্টি দিলে কি দেখতে পাই। বিশেষ করে রাজাবাদশাহ প্রেসিডেন্টপ্রধানমন্ত্রী যারা আছেন তারা কি বিবেকে তাড়িত হন না। আহলে বায়েতের প্রধান হযরত আলী (.) যার সম্মান মহান আল্লাহ পাক স্বীকৃত। আর আপনারা দুনিয়ার রাজাবাদশাহ, প্রেসিডেন্টপ্রধানমন্ত্রীরা কিভাবে জীবনযাপন করছেন। কিভাবে আপনাদের মন্ত্রী উপদেষ্টারা সচিবেরা সরকারী উচ্চপদস্থ আমলারা জনগণের টাকায় কিভাবে আরাম আয়েশ ভোগ বিলাসে বউ বাচ্চা নিয়ে জীবনযাপন করছেন। রাজাবাদশাহ দেশের মালিক হতে পারে না, দেশের মালিক জনগণ। আরবের রাজাবাদশাহদের অতি আয়েশী বিলাসী জীবনযাপন বিশ্বব্যাপী সমালোচিত। আপনারা বুঝতে পারতেছেন না বিশ্ব জনমত আপনাদের বিলাসী জীবনযাপন নিয়ে কি ভাবতেছে কি বলতেছে।

তেমনিভাবে আমাদের বাংলাদেশেও ক্ষমতা পেলে ঘুষ দুর্নীতি লুটপাট করে যেভাবে হোক অর্থ সম্পদের মালিক হলেই দামি বাড়ি গাড়ি নিয়ে বিলাসী জীবনযাপন পরিত্যাগ করতে পেরেছে হাজারে কয়জন আছে। বাংলাদেশে ঢাকা চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরে লাখ লাখ পরিবার অনাহারে অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন কাটাচ্ছে। আজ ক্ষমতা অবৈধ অর্থ সম্পদে বলীয়ান হয়ে আমরা আল্লাহ ও রসূলের সাবধানতাকে দুনিয়ার মোহে মোহিত হয়ে বেমালুম ভুলে গিয়ে বেপরোয়া হয়ে গেছি।

মুসলিম জাহানের রাজাবাদশাহ প্রেসিডেন্টপ্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপদেষ্টা, আমলা, ধনীরা তাদের বিলাসী জীবন নিয়ে ভাববেন আশা করি। আরও ভাববেন, আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (.) সহ তাঁর অগ্রজ আরও তিন খলিফা বিশাল মুসলিম জাহানের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর হয়েও কীভাবে জীবনযাপন করে গেছেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের এক বছর পূর্তি : একটি মূল্যায়ন
পরবর্তী নিবন্ধআইনজীবী তৌফিকার আয়কর নথি সিআইডিকে দেওয়ার নির্দেশ