কুত্বে মাদার শাহ সুফি আলহাজ্ব হযরত মাওলানা আবদুর রশিদ হামেদী সিদ্দিকী (রহ.)। প্রকাশ গারাংগিয়া হযরত ছোট হুজুর কেবলার ৪ নভেম্বর ইন্তেকাল বার্ষিকী। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাবান বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। জীবনের বড় অংশ নিজ বাড়িতে অবস্থান করে গারাংগিয়া মাদ্রাসার খেদমত করে গেছেন। এই মাদ্রাসার হেড মাওলানা তথা আউয়াল ছাহেব হুজুর হিসেবে সর্বমহলে শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন।
চট্টগ্রাম দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে ফাজিল পাস করেন। ১৯২৮ সালে ভারতে উত্তর প্রদেশের হযরত শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী (রহ.) প্রকাশ আজমগড়ী হযরতের নিকট তরিকতে দাখিল হন। সেই হতে গারাংগিয়া নিজ বাড়িতে অবস্থান করে গারাংগিয়া মাদ্রাসার খেদমতের পাশাপাশি রেয়াজতে দৈনিক দীর্ঘ সময় দেন।
যেহেতু তাঁর বড় ভাই ও অভিভাবক হযরত বড় হুজুর কেবলা গারাংগিয়া মাদ্রাসা প্রধানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি হযরত পীর ছাহেব আজমগড়ী হযরতের নির্দেশে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক তরিকতের সফর করতেছিলেন। ১৯৭০ এর দশকের আগ পর্যন্ত হযরত বড় হুজুর কেবলা সুপারিন্টেনডেন্ট ছাহেব হুজুর এবং হযরত ছোট হুজুর কেবলা আউয়াল ছাহেব হুজুর হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
১৯৫৫ সালে আজমগড়ী হযরত মাত্র সপ্তাহ খানেকের জন্য চট্টগ্রামে সফরে আসলে চন্দনপুরা প্রখ্যাত জমিদার এয়ার আলী খানের বাসভবনে কয়েকজন বুজুর্গ মুরিদকে খেলাফত দান করেন। তৎমধ্যে হযরত ছোট হুজুর কেবলা অন্যতম।
হযরত ছোট হুজুর কেবলা ছিলেন খুবই উন্নত চরিত্রের অধিকারী। গারাংগিয়া মাদ্রাসায় আউয়াল ছাহেব হুজুর হিসেবে দায়িত্ব পালন থেকে তাঁর বহুমুখী প্রতিভা বিকশিত হতে থাকে। তরিকত ও মাদ্রাসার কল্যাণে বড় ভাই হযরত বড় হুজুর সফরে থাকতেন বিধায় হযরত ছোট হুজুর বাড়ীতেই অত্যধিক অবস্থান করতেন। ফলে রেয়াজতে দীর্ঘ সময় দিতে সুযোগ লাভ করেন।
হযরত ছোট হুজুর কেবলা ৩ বার হজ্বব্রত পালন করেন। ১ম বার ১৯৫৬/৫৭ সালে সাগরপথে। দ্বিতীয়বার ১৯৭৪ সালে, ৩য় বার ১৯৭৮ সালে বিমানে হজ্বে গমন করেছিলেন।
হযরত ছোট হুজুর কেবলা থাকতেন বাড়ীতে; সময় দিতেন রেয়াজতে; খেদমত করতেন গারাংগিয়া মাদ্রাসায়। কিন্তু বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী বড় হুজুর কেবলা প্রতিকূল যোগাযোগে সফরে অবস্থান করতে করতে কাহিল হয়ে পড়েন।
ফলে তরিকতের লোকজনের আবদার রক্ষার্থে বড় ভাইয়ের আগ্রহে হযরত ছোট হুজুর কেবলার তরিকতের সফর শুরু হয়ে যায়। ঐ সময় দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা তত উন্নত হয়নি। কাঁচা রাস্তা টু স্ট্রোক ভাঙ্গাচোড়া বেবি টেক্সী, নয়ত পুরানো জীপ তথা চাদের গাড়ি যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম।
১৯৭৩/৭৪ সাল থেকে হযরত ছোট হুজুর কেবলা বাঁশখালীতে বারে বারে সফর করেছিলেন কাঁচা রাস্তা টু স্ট্রোক পুরানো বেবী টেক্সি করে। পাশে খাদেম বসতেন সামনে চালকের পাশে বসতেন আয়োজক।
এভাবে বৃদ্ধ বয়সে অতীব কষ্ট স্বীকার করে তরিকতের দ্বীনের খেদমত করতে থাকেন বড় ভাই বড় হুজুর কেবলার আগ্রহে। বাঁশখালীর উত্তর–দক্ষিণ প্রধান সড়কের অবস্থা ছিল ঐ সময় খুবই নাজুক। বিশেষ করে উনিশ শত সালের ৬০/৭০/৮০ এর দশকে বর্ষাকালে জায়গায় জায়গায় অত্যধিক কাঁদা হয়ে গেলে সড়ক বিভাগ তথা জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ট্রাকে করে ইটের টুকরা এনে ফেলা হত। বর্ষার পর শুষ্ক মৌসুমে রিক্সা, ভাঙ্গাচোড়া বেবী টেক্সী এসব এলাকা অতিক্রম করা কত কঠিন ছিল বলার অপেক্ষা রাখে না। ঝাঁকুনিতে সক্ষম মানুষও কাহিল হয়ে যেত।
কিন্তু হযরত ছোট হুজুর কেবলা ভাঙ্গাচোড়া টু স্ট্রোক বেবী টেক্সী করে বিভিন্ন স্থানে তরিকতের সফর করতে প্রত্যক্ষ করি।
১৯৬০ এর দশকে ছাত্র জীবনে আমার হযরত বড় হুজুর কেবলার নিকট মুরিদ হওয়ার সৌভাগ্য হয়। সে হতে ৯/১০ বছর ব্যাপী হযরত বড় হুজুর কেবলার পাশাপাশি হযরত ছোট হুজুর এর ছোহবত লাভ করতে থাকি। ঐ সময় উভয় হুজুর কেবলা বাঁশখালী আমাদের বাড়ীতে তশরীফ রাখতে থাকেন। হযরত বড় হুজুর কেবলা চেচুরিয়ায় বাঁশখালী কেন্দ্রীয় খানকাহ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লিখিতভাবে অনুমোদন দেন ১৯৭৪ সালে। হযরত ছোট হুজুর কেবলা নিজে তাশরীফ নিয়ে স্বহস্তে লিখিত ২৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি অনুমোদন দেন।
যাতে হযরত বড় হুজুর কেবলা সভাপতি, মাওলানা আবদুস সালাম ছাহেব সহ–সভাপতি আমি সেক্রেটারী। অতঃপর খানকাহ এর প্রথম বার্ষিক মাহফিল আয়োজন করা হয় হযরত বড় হুজুর কেবলার সভাপতিত্বে। সভার পরদিন সকালে হযরত শাহ মাওলানা আবদুল কুদ্দুস আল–কাদেরীর আগ্রহে হযরত বড় হুজুর কেবলা নিজ হাতে খানকাহ এর ভিত্তি দেন। পরপর ৩ বছর হযরত বড় হুজুর কেবলার সভাপতিত্বে খানকাহর বার্ষিক মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। তখন মাহফিলে লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত।
১৯৭৭–১৯৯২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৫ বছর বাঁশখালী হামেদিয়া মাদ্রাসায় মুরব্বিয়ানা করে গেছেন হযরত ছোট হুজুর কেবলা। তাঁর সম্মতি ও উপস্থিতিতে বার্ষিক মাহফিল হয়ে আসছিল। তখন বার্ষিক মাহফিলে ব্যাপক সমাগম হত।
আয়েশী ব্যবস্থাপনা ছাড়া একালে শতে হাজারে কয়জন পীর ছাহেবই এ রকম কষ্ট স্বীকার করে তরিকতের সফর করবেন!
১৯৮০ এর দশক থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হতে থাকে। টু স্ট্রোকের স্থলে ফোর স্ট্রোক আরামদায়ক টেক্সি আমদানি শুরু হয়। মানুষের মধ্যে সচ্ছলতা আসে। অনেকেই নিজে কার ক্রয় করে ব্যবহার করা শুরু হয়ে যায়। ফলে জীবনের শেষ প্রান্তে ৮/১০ বছর বেবী টেক্সির স্থলে তরিকতের লোকজনের অতি আগ্রহে হযরত ছোট হুজুর কেবলা কারে যাতায়াত করতে পেরেছিলেন।
হযরত বড় হুজুর কেবলার জীবদ্দশায় ৭/৮ বছর বারে বারে ছবক তওয়াজ্জুহ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়। পরবর্তীতে ১৬/১৭ বছর হযরত ছোট হুজুর কেবলার সান্নিধ্য লাভ করতে থাকি, নিতে থাকি ছবক তওয়াজ্জুহ।
১৯৭৭ সালের ২১ অক্টোবর শুক্রবার সকালে গারাংগিয়া নিজ বাড়ীতে হযরত বড় হুজুর কেবলা ইন্তেকাল করেন। মোবাইল ত নয়ই ল্যান্ড টেলিফোনও সহজলভ্য ছিলনা। কিন্তু সকাল ১০/১১ টার ভিতর সারা দেশব্যাপী হযরত বড় হুজুর কেবলার ইন্তেকালের খবর প্রচার হয়ে যায়। যা সম্পূর্ণ অলৌকিক ব্যাপার। ফলে গারাংগিয়ায় কয়েক লাখ লোকের সমাগমে হযরত বড় হুজুর কেবলার জানাযা পড়ান হযরত ছোট হুজুর কেবলা।
হযরত বড় হুজুর কেবলার ইন্তেকালের পর ১৭ বছর যাবৎ হযরত ছোট হুজুর কেবলার রাতদিন ব্যস্ততার সীমা ছিল না। তিনি ছিলেন দুনিয়া–আখিরাত উভয় দিক দিয়ে সমান্তরালে ধর্মীয় নির্দেশনার বিশাল ভান্ডার। এতে মানুষকে দুনিয়ার বাস্তব জীবনে পরামর্শ উপদেশ দিতেন ।
সেই হতে দীর্ঘ ১৭ বছর হযরত ছোট হুজুর কেবলা গারাংগিয়া মাদ্রাসার পাশাপাশি তরিকতের বিশাল খেদমত করে যান। তেওয়ারি হাট থেকে গারাংগিয়া পর্যন্ত প্রায় ৬ কি.মি দীর্ঘ শাহ মজিদিয়া রোড প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেন বড় ভাইয়ের নামে ‘শাহ মজিদিয়া রোড’। তিনি মহিলা মাদ্রাসা, এতিমখানা পৃথকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত শেষ জীবনে ১৭ বছরের জিন্দেগীতে শুধুমাত্র একটাই শব্দ ছিল “আর বদ্দা, আর বদ্দা” অর্থাৎ যাবতীয় কিছুর অভিভাবক আমার বড় ভাই। মানবের পিতার প্রতি, তরিকতে হলে পীরের প্রতি দুর্বলতা কাজ করে। কিন্তু হযরত ছোট হুজুর কেবলা ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি বড় ভাই অভিভাবক হযরত বড় হুজুর কেবলার প্রতি খোলা মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে কুন্ঠিত হননি।
অপরদিকে হযরত বড় হুজুর কেবলার রেখে যাওয়া বিশাল তরিকত জগত, শরীয়ত তরিকতের যাবতীয় প্রতিষ্ঠানাদি তদারকির দায়িত্ব হযরত ছোট হুজুর কেবলা সুচারুরূপে পালন করে গেছেন।
হযরত বড় হুজুর কেবলার মত যে কোন মাহফিলে গেলে রাত ৯ টা সাড়ে ৯ টার মধ্যে এশার নামাজ ও খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। মাহফিলের কল্যাণে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকা অপছন্দ করতেন। তিনি ইসলামী ঐক্যের পক্ষে কাজ করে গেছেন। এ মহান ব্যক্তিত্ব হযরত ছোট হুজুর কেবলা প্রায় শতের কাছাকাছি বয়সে ১৯৯৪ সালের ৪ নভেম্বর শুক্রবার সকালে গারাংগিয়া নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন। বিকেল বেলা হযরত ছোট হুজুর কেবলার জানাযায়ও কয়েক লাখ লোকের সমাগম হয়। হযরত বড় হুজুর কেবলা ও হযরত ছোট হুজুর কেবলা কঠোর শরীয়তের ভিতর তরিকতের খেদমতে জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। যা একালে আমরা সকলের জন্য অনুকরণীয়–অনুসরণীয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।












