প্রবাহ

মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদীর মাইজভান্ডার গমন প্রসঙ্গ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২২ অক্টোবর, ২০২৫ at ৮:৪১ পূর্বাহ্ণ

২৪ অক্টোবর মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদীর ৭৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। দীর্ঘদিন হল তিনি মৃত্যুবরণ করে গেছেন। তারপরও চট্টগ্রামের জনগণের হৃদয় থেকে হারিয়ে যাননি। তিনি একদিকে ছিলেন আলেম অন্যদিকে ছিলেন সচেতন ও সাহসী ব্যক্তিত্ব। পিতার একমাত্র সন্তান, রয়েছে পিতার আর্থিক সচ্ছলতা। পিতা বা নিজের আগ্রহে তিনি চট্টগ্রাম থেকে সাগরপথে কলকাতা গমন করেন আরও উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে। ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের সাথে কলকাতা, কক্সবাজার, ইয়াঙ্গুন, আকিয়াব নিয়মিত সাগরপথে জাহাজ সার্ভিস ছিল। তিনি হাজী মুহাম্মদ মহসিনের বিখ্যাত হুগলি মাদ্রাসায় ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। থাকতেন হোষ্টেলে। মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী আত্মজীবনীতে নিজেই লিখেন মোল্লা পীর ফকির তথা তাসাউফের প্রতি তিনি বিরূপ ধারণা পোষণ করতেন। নিজেকে নিজে যোগ্য ছাত্র মনে করে আত্মতৃপ্তি লাভ করতেন। অন্যান্য সহপাঠীরা তার চেয়ে পিছিয়ে মনে করতেন।

কয়েক বছরের ব্যবধানে এই মাদ্রাসারই হেড মাওলানা কুতবুল আলম পীরে কামেল হযরত শাহ মাওলানা সুফি গোলাম সালমানী আব্বাসী (রহ.) ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। ছাত্র হলেও তার অভ্যাস রয়ে গেছে। এতে মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী ওস্তাদকে খুঁছাতে পাঠদান বুঝতেছেন না বলে বারে বারে বিরক্ত করতে থাকেন। একাধিকবার এই আচরণের পর ওস্তাদ অন্য ছাত্রদের থেকে জিজ্ঞাসা করলেন তারা পাঠদান বুঝছেন কিনা। এতে অন্য ছাত্ররা পাঠদান বুঝছেন বলায় মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী স্বভাববশত ওস্তাদকে বলে ফেলেন তিনি না বুঝলে অন্য ছাত্ররা বুঝবে কি করে। সেই এক বিক্ষিপ্ত ঘটনা। যা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী তার আত্মজীবনীতে স্বীকার করে গেছেন। ফলে মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদীর মনের মধ্যে পরিবর্তন এসে যায়। শ্রদ্ধা এসে যায় সুফিজম তাসাওউফের প্রতি। এতে তিনি চট্টগ্রাম আসলে ২০ বছর বয়সে তথা ১৮৯৫ সালে চট্টগ্রাম থেকে মাইজভান্ডার গমন করেন হযরত শাহ মাওলানা আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারীর দোয়া পেতে। সাথে নেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শরাবত উল্লাহকে। তাঁরা উভয়ে মাইজভান্ডারের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করেন। তখন দেশে নৌপথে হস্তচালিত নৌকা সাম্পান স্থলপথে পায়ে হাঁটা অথবা গরুর গাড়ি। আরও ১৯ বছর পর ধলই হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা এয়ার মোহাম্মদ (রহ.) হজে গমন করেছিলেন ১৯১৪ সালে। তিনি সন্ধ্যায় গরুর গাড়ি করে কাটির হাট থেকে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে ভোরে চট্টগ্রাম পৌঁছেন। ব্রিটিশ কর্তৃক দু’হাজারী নাজিরহাট ট্রেন সার্ভিস চালু হয় ১৯৩০/৩১ সালে।

আর্থিক সচ্ছল ব্যক্তি হলে নিজেদের ঘোড়া থাকত। তখন আর্থিক সচ্ছল ব্যক্তিরা এখনকার মত কার জীপ স্থলে ঘোড়া, পালকি রাখতেন। থাকত যাতায়াতের জন্য গরুর গাড়িও। নদীপথে যাতায়াতের জন্য নিজস্ব সাম্পান রাখতেন। তারা হাটহাজারী অতিক্রম করার পর সূর্যাস্ত যায়। এতে তারা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। যেহেতু রাস্তার ধারে কেউ তাদেরকে রাত্রিযাপনের সুযোগ দিচ্ছেন না। বিষয়টি বাড়ীর মালিকের জন্য কিছুটা হলেও বিব্রতকর। আতিথেয়তা খবর খরচ এক বিষয় ব্যবস্থাপনা আরেক বিষয়। যারা অতি সচ্ছল বা জমিদার পরিবার তাদের কাছারী ঘর টয়লেট মেহমানের আতিথেয়তা করার লোকজন থাকত। এতে রাস্তারধারের বাড়িঘরের মালিকগণ এই রকম রাত্রিযাপনকারীদের আতিথেয়তা দিতে দিতে খুবই বিরক্ত। বেশ কয়েক ঘরে আশ্রয় না পেয়ে বড় রাস্তা থেকে অনেক ভিতরে চলে যান। এক সচ্ছল পরিবারের খালি কাছারী ঘরে ঢুকে পড়েন। উভয়ে এশারের জামাত শুরু করে দেন। বন্ধু শরাবত উল্লাহর কেরাত ছিল সুমধুর। এতে আন্দর বাড়িতে বাড়িওয়ালার মনমানসিকতায় পরিবর্তন এসে যায়। তাদের জন্য রাতের খাবার ও সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করা হয়। পরদিন বেলা ১০ বা ১১ টার দিকে তারা উভয়ে মাইজভান্ডার পৌঁছতে সক্ষম হন। তখন হযরত শাহ মাওলানা আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী আন্দর বাড়িতে ছিলেন। অনেক লোক হযরত মাইজভান্ডারের মোলাকাত পেতে প্রতীক্ষায়রত। কিছুক্ষণের ব্যবধানে হযরত মাওলানা মাইজভান্ডারী আন্দর বাড়ি থেকে এসে বসেন। ডেকে জন জন করে নাম বাড়ি কোথায় জানতে চাচ্ছিলেন। এখানে অনেকে নানা প্রকার খাদ্যদ্রব্য ব্যবহার উপযোগী সামগ্রী নিয়ে গিয়েছিলেন। মাওলানা ইসলামাবাদী নিয়ে গেলেন ওলা (সাদা চিনি মিশ্রিত)। হযরত মাইজভান্ডারী পানি ভর্তি একটি বাটিতে ওলা পেলে উপস্থিত সকলকে শরবত পান করান। অতঃপর সামনে মাঠের দিকে হাঁটতে থাকেন। তার নিকট সাক্ষাত তথা নানান হাজত প্রাপ্তি জানতে চাইতেন, কিন্তু তিনি প্রশ্নের উত্তর কম দিতেন। মাওলানা ইসলামাবাদী স্বভাববশত কয়েকবার করে জানতে চাইলেন জীবিকা নির্বাহের জন্য মুক্তারী (আইনপেশা) পরীক্ষা দেয়ার ইচ্ছা তার। এতে তিনি হযরত মাইজভান্ডারের উপদেশ কামনা করেন। ইসলামাবাদীর বারে বারে আগ্রহের কারণে হযরত মাইজভান্ডারী কুরআনের একটি আয়াত পাঠ করলেন। এর অর্থ আল্লাহপাকের উপর নির্ভর করা মানুষের কর্তব্য। আল্লাহপাক যাকে ইচ্ছা করেন তাকে রিজিক দান করেন। এতে মাওলানা ইসলামাবাদী নিজে নিজে বুঝতে পারেন রিজিক আল্লাহপাক প্রদত্ত। আল্লাহপাকের উপর নির্ভর করে থাকা মানুষের দায়িত্ব।

হযরত শাহ মাওলানা আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রহ.) কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করা এক মহান আলেম। সাথে সাথে একজন সুফি দরবেশ। তিনি ছিলেন শরীয়তের কঠোর পা বন্দ। মাওলানা আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী ১৪ জানুয়ারী ১৮২৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ২৩ জানুয়ারী ১৯০৬ সালে ইন্তেকাল হলে মাইজভান্ডার দরবারে তাকে শায়িত করা হয়। তিনিই হলেন এই দরবারের মধ্যমণি। তিনি এবং তার পরবর্তীগণের ওছিলায় অজপাড়া গ্রাম মাইজভান্ডার আজ দেশ পেরিয়ে বিশ্বে আলোচিত পরিচিত নাম।

মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদীর ওস্তাদ হযরত শাহ মাওলানা সুফি গোলাম সালমানী আব্বাসী (রহ.) ফুরফুরা। তিনি পরবর্তীতে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার হেড মাওলানা হন। তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ, আকাইদ, মানতিক, হেকমত, বালাগত বিশেষত আরবি ফার্সিসহ ইসলামী অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। ছিলেন সামশুল ওলামা তথা আলেম জগতের সূর্য।

১৮৫৪ সালে ১ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১২ সালের ১ জুলাই মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ফুরফুরাতেই তিনি চির নিন্দ্রায় শায়িত। ফুরফুরাতে অপর মহান ব্যক্তিত্ব হযরত শাহ মাওলানা আবু বকর ছিদ্দিকী (রহ.) উভয়ে আপন মামাতো ফুফাতো ভাই। উভয়ে রসূলনোমা হযরত সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.)’র অন্যততম খলিফা। আমার জানামতে ভারতবর্ষে ৩ জন রসূলনোমা রয়েছেন। একজন মানিকতলায় কলকাতায় শায়িত হযরত সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.) অপরজন বানারসে শায়িত হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ওয়ারেস কাদেরী (রহ.) তৃতীয়জন দিল্লীতে শায়িত হযরত হাসান রাসূলনোমা হেদলভী (রহ.)। অপরদিকে হযরত সুফি গোলাম সালমানী আব্বাসীর মোজাদ্দেদিয়া সিলসিলার মুরিদ হলেন বান্ডেলে শায়িত হযরত শাহ আবদুল বারী আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী (রহ.)। তারই অন্যতম খলিফা ভারতের উত্তরপ্রদেশে শায়িত হযরত শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী (রহ.) (আজমহড়ী হযরত)। চট্টগ্রাম অঞ্চলে গারাংগিয়া, চুনতী, হালিশহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শরীয়ত ভিত্তিক তরিকতের এই সিলসিলার ব্যাপকতা রয়েছে। মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী ২২ আগস্ট ১৮৭৫ সালে জন্ম এবং ২৪ অক্টোবর ১৯৫০ সালে ইন্তেকাল। তিনি ১৯৩১১৯৩৫ সাল পর্যন্ত ৪ বছর সময় দিয়ে আত্মজীবনী লিখে যান। এতে খোলা মনে সবকিছু লিখে যেতে সংকোচ করেননি। মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদী চট্টগ্রামের সন্তান হলেও ভারতবর্ষে একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। তাঁর সাথে আমার পিতা (আমিরুল হজ খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী) এর সাথে নিবিড় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। উভয়ের মধ্যে নিয়মিত ডাকযোগে চিঠি আদানপ্রদান হত। মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদীর ৭৫ তম ইন্তেকাল বার্ষিকীতে পরকালে তাঁর কল্যাণ কামনা করছি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধধর্মাচারী আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলম
পরবর্তী নিবন্ধউন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় একদিন মডেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে