ক’দিন আগে শ্রীমঙ্গল হয়ে সিলেট যাওয়া হয়। শ্রীমঙ্গলের একটি ট্যুরিস্ট স্পটে সহযাত্রীদেরকে ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে আমি এর কাছে প্রবেশ মুখে একটি প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে বসে আছি। কিছুটা দূরত্বে এখানকার পাবলিক টয়লেট এর কেয়ারটেকার তথা এখানকার দায়িত্বশীল ব্যক্তির সাথে আলাপ করতে থাকি। তার অতি অসহায় জীবন নিয়ে ভাবি।
তার বয়স হয়ত ৪৫/৫০ হবে। তার দৈনিক ২ শ’ টাকা হিসেবে বেতন। অর্থাৎ মাসিক প্রায় ৬ হাজার টাকা। স্ত্রী অসুস্থ অপারেশন হয়েছে, ঘরের কাজ করতে পারে না। ঘরে পানির ব্যবস্থা নেই, কিছুটা দূর থেকে পানি আনতে হয়। চাকরী স্থল থেকে নিজ বাসায় যাওয়া–আসা করতে ২০ টাকা করে ৪০ টাকা গাড়ি ভাড়া লাগে। তাদের জীবনটা অনেকটা অনাহারে–অর্ধাহারে। সে ২ সন্তানের জনক। এখন স্ত্রীর অবস্থা খুব নাজুক। স্ত্রীর অসুস্থতা নিয়ে তার টেনশন, স্পষ্টতই বুঝা যায় সে স্ত্রীকে অত্যধিক ভালবাসে। সহযাত্রীরা ভিতরে গেছে, ২০/২৫ মিনিট সময় নেবে, আমিও এই অভাবী লোকের জীবন প্রবাহের উপর জানতে কৌতুহলী হই।
শ্রীমঙ্গল মৌলভীবাজার জেলার অধীন হলেও নিজের পরিচয়ে পরিচিত। দেশে চা–বাগানের জন্য বিখ্যাত এরিয়া। সব সময় হাজার ভ্রমণকারীর আনাগোনা রয়েছে শ্রীমঙ্গলে। সেই লক্ষ্যে একাধিক পাঁচ তারকামানের হোটেলসহ অসংখ্য হোটেল।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে এই শ্রীমঙ্গলে আসছে ভ্রমণ বিনোদনের জন্য। শ্রীমঙ্গলের একটি বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পটে ভ্রমণকারীদের সেবা দিতে এই অভাবী তথা অতী গরীব লোকটির প্রতিদিন এখানে আসা–যাওয়া করতে হয়।
বাংলাদেশে এই রকম পরিবার ন্যূনতম কোটি হবে। স্বামী–স্ত্রী মিলে ৪/৫ জনের সংসারে ৪–৫ কোটি মানুষ অনেকটা অনাহারে না হলেও অর্ধাহারে বলা যাবে। এদের মধ্যে অধিকাংশ ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী। সরকারী আধা সরকারী স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের বেতন খুবই সীমিত। যদি দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার সুযোগ না থাকে বা ঐ জাতীয় ইনকাম করার সুযোগ না আসে তবে তারা বউ–বাচ্চা নিয়ে কিভাবে চলে! ঘরের দারোয়ান, দোকানের কর্মচারী এদের সংখ্যাও বিশাল। এদের বেতন মাসিক ৮/১০ হাজার থেকে ১২/১৪ হাজার টাকা। বউ বাচ্চা নিয়ে কর্মস্থলে থাকে এমন সংখ্যাও কম নয়।
অতি নিম্ন আয় তথা ছোটখাটো পুঁজি দিয়ে রাস্তারধারে ব্যবসা করে এদের সংখ্যাও কম নয়। কেউ আমড়া বিক্রি করে, কেউ পেয়ারা, কেউবা চানাচুর বা ঝালমুড়ি বিক্রি করে। এদের মূলধন বাদ দিয়ে আয়ই বা কি থাকে। অনেক সময় বিক্রিও হয় না। কিন্তু ঘরে স্ত্রী, পুত্র কন্যা রয়েছে তাদের জন্য সন্ধ্যায় চাউলসহ বাজার নিয়ে যেতে হবে। এই স্তরে দেশের কোটি পরিবার, যারা ভিক্ষা করতে পারে না, মানুষের নিকট হাত টানতে পারে না, তাদের মুখে থাকবে না হাসি, তাদের মধ্যে থাকবে না উৎফুল্লতা। তারা বসবাস করে বস্তি এলাকায়। যেখানে থাকেনা সুন্দর পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। অস্বাস্থ্যকর এরিয়া বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।
আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিকট দরদাম বেশি করি। তার কয় টাকায় পুঁজির পর কয় টাকাই বা লাভ থাকছে। তার রয়েছে ঘর ভাড়া, দৈনিক ৩/৪ শ’ টাকা খরচ। অপরদিকে বড় বড় মার্কেটে তেমন কোন দরদামের কথা কমই আসে। কেন জানি না আমাদের দেশে বিগত ৩০/৪০ বছরের ব্যবধানে জীবনযাত্রার অবস্থা দ্রুত ব্যবধান হয়ে গেছে।
ব্যাংকের টাকা লুট করে, দুর্নীতি ও দেশের সম্পদ লুটের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়া ব্যক্তিগণের সংখ্যাও দেশে দ্রুততার সাথে বেড়ে গেছে। বেড়ে গছে দ্রব্যমূল্য। তার বিপরীতে প্রায় কোটি বা তারও অধিক পরিবার অসহায় নিঃস্ব অবস্থায় জীবন যাপন করছে। রয়েছে অনাহারে অর্ধাহারে। যদি তাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হয় ভাল চিকিৎসা করানোর সামর্থ থাকে না। ভাল পুষ্টিকর খাওয়ার তাদের জুটে না। তাদেরকে ক্ষমতাধর ধনীরা খুবই তাচ্ছিল্য ব্যবহার করে। যা নীরবে সহ্য করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
আমাদের দেশে কেন জানি সরকারগুলোর উপর জনগণের আস্থা কেমন তা নিয়ে ভাবি। এখানে সরকারের প্রতিফলন অত্যাবশ্যক। কিন্তু সরকারী হলেই বিলাসিতার কথা এসে যায়। এসে যায় সম্পদের পাহাড় গড়ার কথা। আসে দুর্নীতির ভিতর অপব্যয়ের কথাও। দেশে যে কোটি পরিবার অনাহারে অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছে তাদের নিয়ে ভাবতে হবে সরকারকে। রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে টিসিবি বা অন্যান্য সংস্থা কম মূল্যে দ্রব্য বিক্রি করে। যা চাহিদার তুলনায় খুবই নগণ্য। দ্রব্যগুলো নিম্নমানের বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ব্যাংক লুটকারী দেশের সম্পদ লুটকারী ঘুষখোর নব্য কোটিপতিরা হয়ে যায় অত্যধিক অহংকারী। এক সময় তাঁরা রাস্তায় রাস্তায় হাঁটত, এখন তারা অবৈধ অর্থ সম্পদশালী হয়ে গরীবদের উপর তথা চতুর্থ শ্রেণীর লোকদের সাথে অহংকারী হয়ে তুই–তোকারি করে আত্মতৃপ্তি লাভ করছে। এমনিতেই হারামের টাকায় অহংকারী হওয়াটা স্বাভাবিক। হারামের অর্থ সম্পদে বিনয় আশা করা যায় না। এরা নেতাদেরকে তোয়াজ করে বেশি আরও উপরে উঠার জন্য। অপরদিকে গরীবদেরকে তাচ্ছিল্য করে বেশি।
এই প্রসঙ্গে এখানে একটা উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক যে, পীরানে পীর বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) পারস্যের গিলান থেকে বাগদাদ গমন করেছিলেন উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য। ৭৩ বছর বাগদাদে থেকে ইন্তেকাল করেন। পরপর ৫ জন আব্বাসী খলিফা তাকে কাছে পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাদেরকে ধরা দেননি। খলিফা বা খলিফার প্রতিনিধি তার ঘরে আসলে তিনি ভিতর বাড়িতে চলে যেতেন। খলিফা বা খলিফার প্রতিনিধি ঘরে বসার পর তিনি ভিতর থেকে আসলে স্বভাবতই খলিফা বা খলিফার প্রতিনিধি দাঁড়িয়ে তার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হবে স্বাভাবিক। অপরদিকে তিনি গরীব দুঃখীদের কাজ করে দিতেন, কাপড় ধুয়ে দিতেন। টাকা–পয়সা হাতে আসলেই এই সব গরীবকে খাওয়াতেন বা সাহায্য করতেন। ইনি হলেন কাদেরিয়া তরিকার ইমাম পীরানে পীর বড় পীর হযরত শেখ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)। সপ্তাহখানেকের জন্য বাগদাদ অবস্থানকালে এই সাধক পুরুষের বারে বারে যেয়ারত করার সৌভাগ্য হয়।
পাকিস্তান আমলে পৌরসভা রেশন কার্ড দিত। সরকার সততার উপর কঠোর অবস্থান করতে পারলে এই নিম্নবিত্ত কোটি পরিবারের কল্যাণে কাজ করতে পারে। কিন্তু দেশের প্রেক্ষাপট যে হারে গ্রামে গঞ্জে লুটপাট চাঁদাবাজি চলছে; সুন্দর পরিচ্ছন্ন দুর্নীতিমুক্ত, চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবেশ দেশে কবে ফিরে আসবে তা নিয়েও ভাবি।
বলছিলাম দেশের কথা। যারা অতীব নিম্নবিত্ত পরিবার চাকরিজীবি ৮/১০ হাজার থেকে ১২/১৪ হাজার টাকার মধ্যে বেতন যাদেরকে অনেকটা ৪র্থ শ্রেণীর মর্যাদার চাকরিজীবি বলা হয়ে থাকে। তাদের জীবন প্রবাহ নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। যারা ব্যাংক লুট করে দুর্নীতি করে শত হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তারা মরার আগে অবৈধ সম্পদগুলো এইসব গরীব দুঃখীর মাঝে বিতরণ করলে কতই না উত্তম হবে।
শত হাজার কোটি টাকার মালিক তুমি তো মরে যাবা, যাদের জন্য অপকর্ম করলা সেই সন্তান দ্বারা তোমার কোন কল্যাণ হবে না। তোমার সন্তানেরা তাদের সন্তানের দিকে দৃষ্টি দিবে তোমার দিকে নয়। শত হাজার কোটি টাকার সম্পদ রেখে গেলেও তোমার থেকে যদি কেউ পাওনা থাকে, তোমার সন্তানেরা তাদের শোধ করবে তা আমার বিশ্বাস হয় না।
শ্রীমঙ্গলে যে অতি অসহায় গরীব লোকের সাথে কথা বললাম সেই রকম অতি অসহায় পরিবার নীরবে নিভৃতে যে লাখ লাখ রয়েছে তা হয়ত আমাদের অজানা। আমরা বিলাসিতা পরিহার করি, গরীবের প্রতি দৃষ্টি দিই। এতে আমাদেরও দুনিয়া আখিরাতে কল্যাণ হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।