প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র কাবার দক্ষিণ পূর্বকোণে সাফা পাহাড় সংলগ্ন আল্লাহর রসূল (.) ও হযরত ইব্রাহীম (.)’র স্মৃতি বিজড়িত বরকতময় পাহাড় জবলে আবু কুবাইস। সাফা এবং মারওয়া উভয় বরকতময় পাহাড়। আমাদের দেশীয় ভাষায় টিলা বলে। আমাদের দেশে বড় বড় পাহাড়পর্বতের নিচে ছোট ছোট পাহাড়ও থাকে। এসব পাহাড়কে দেশীয় ভাষায় টিলা বলা হয়।

নিজ বিবেচনায় সাফা ও মারওয়া পাহাড়পর্বতের পাদদেশকে টিলা বলা যাবে। সাফা পাহাড় সংলগ্ন জবলে আবু কুবাইসকে আমাদের দেশীয় ভাষায় পর্বত বলা যেতে পারে। এ পর্বত সমতল থেকে সোজা উপরের দিকে উঠে গিয়েছে। এই পর্বতের উপর উঠলে পবিত্র কাবা, মসজিদুল হারমসহ পবিত্র মক্কার অধিকাংশ এলাকা দৃষ্টিগোচর হত। এই আবু কুবাইস পর্বতটির চতুর্দিকে ছোট ছোট শত শত বাড়ি ঘর ছিল। যতটুকু জানতে পারি ব্রিটিশ পাকিস্তান আমলে আরাকানসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিজরত করে পবিত্র মক্কায় গমনকারীগণের মধ্যে একটি অংশ এই পাহাড়ের ঢালুতে বসবাস করত। এক বর্ণনায় হযরত আদম (.) এবং সেই প্রাচীন যুগের কতিপয় লোকের কবর এখানে বলে কথিত হয়। এই পাহাড় তথা পর্বতটির নাম ছিল আলআমিন। হযরত নূহ (.)’র মহাপ্লাবনের সময় হাজরে আসওয়াদ নিরাপত্তার কারণে এই পর্বতের উপর সংরক্ষণ করা হয়। আরেক বর্ণনায় মকামে ইব্রাহীম পাথর এই পর্বতের উপর ছিল।

আবু কুবাইস নামটির উৎস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেক কাহিনীর সৃষ্টি হয়। এই এলাকার অধিবাসী আবু কুবাইস নামক কোন লোক এ পর্বতের উপর ঘর নির্মাণ করেন। এতে এর নামকরণ হয় জবলে আবু কুবাইস।

জনশ্রুতি আছে, রাসুলুল্লাহ (.) চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করার সময় এই জবলে আবু কুবাইসে দন্ডায়মান ছিলেন।

৬৮৩৮৪ খ্রিস্টাব্দে এই পর্বতটির উপর স্থাপিত অস্ত্র হতে নিক্ষিপ্তগোলা দ্বারা পবিত্র কাবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিষয়টি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের এর আমলে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

মধ্যযুগে পাহাড়টির উপর একটি দুর্গ ছিল। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে তরিকতের একটি খানকাহ পাহাড়ের উপর নির্মিত হয়। ঐ সময় ওহার ঢালুর দিকে নকশবন্দি সিলসিলার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ছিল।

পবিত্র মক্কা বিজয়ের সময় পবিত্র কাবার ছাদে মতান্তরে জবলে আবু কুবাইস এর উপর হযরত বেলাল (.) আল্লাহর রাসূল (.)’র নির্দেশে আজান দিয়ে ছিলেন। এখানে পবিত্র কাবার ছাদে উঠে হযরত বেলাল (.) আজান দেয়ার গ্রহণযোগ্যতা বেশি। পবিত্র কাবার মাত্র ৪/৫ শ’ মিটারের মধ্যে এ সুউচ্চ পাহাড় তথা পর্বতের অবস্থান বিধায় এ পর্বতের উপর আজান দিলে অনেক দূর শুনা যাবে এই বিবেচনায় হয়ত অনেকে জবলে আবু কুবাইস এর নামও উল্লেখ করেছেন।

জবলে আবু কুবাইস পর্বতের চতুর্দিকে ঘর বাড়িগুলোতে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি ছিল।

১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে হজ করতে যাওয়ার হলে যৌবনকাল বিধায় এ জবলে আবু কুবাইস পাহাড়ে উঠার সৌভাগ্য হয়।

ঐ পর্বত শীর্ষে একটি মসজিদ দৃষ্টিগোচর হয়। মসজিদটির নাম হল হযরত বেলাল (.)’র নামে মসজিদে বেলাল। প্রায় ৪০/৫০ জন নামাজ পড়তে পারে মত ছোট মসজিদ। এই পর্বতের উপরের দিকে যারা বসবাস করে তারা হয়ত এই মসজিদে নামাজ পড়ে। পবিত্র কাবা কেন্দ্রিক মসজিদুল হারমে যেহেতু ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়া হবে সেহেতু এই পর্বত শীর্ষে সকাল বেলা বা আছরের পর উঠা স্বাভাবিক। পরবর্তীতেও হজে গমন করলে যতটুকু মনে পড়ে এই পর্বত শির্ষে উঠা হয়েছিল। এর মূলে বয়স যৌবনকাল বিধায় সাহস যোগায়।

এখানে উল্লেখ্য ব্রিটিশ আমল তো বটেই পাকিস্তান আমলেও যাতায়াত প্রতিকূলতা ছিল। কিন্তু সৌদি আরবে ঢুকতে তেমন বড় ধরনের বিধিনিষেধ ছিল না। ফলে আরাকান আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ মানুষ বংশ পরম্পরায় সৌদি আরবে অবৈধ অবস্থানকারী হিসেবে অবস্থান করে আসছে। তাদের নেই কোন পাসপোর্ট নেই কোন দেশের পরিচিতি। এতে এদের নিয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষ উভয় সংকটে।

১৯৯০ এর দশকে এসে সৌদি কর্তৃপক্ষ এই বরকতময় পর্বতটিকে কেটে এখানে রাজকীয় প্যালেস বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। যেমনি সিদ্ধান্ত তেমনি কাজ। এই পর্বতের চতুর্দিকে বসবাসকারী লোকজনকে সরিয়ে দেয়া হল। পর্বতটির উপর দিক থেকে প্রায় চার ভাগের তিন ভাগ বা কম বেশি উচ্চতার মাটি কেটে সরিয়ে নেয়া হয়। অতঃপর ৭/৮ তলা বিশিষ্ট রাজকীয় প্যালেস নির্মাণ করা হয়। এতে বুঝবার উপায় নেই এখানে জবলে আবু কুবাইস নামক ইতিহাসখ্যাত একটি পাহাড় তথা পর্বত ছিল।

বরকতময় সাফা পাহাড় এবং জবলে আবু কুবাইস এর পার্শ্ববর্তী পাকিস্তান আমল পেরিয়ে ১৯৭০ এর দশকে এখান দিয়ে ছোট ছোট গাড়ি চলাচল করত। তেমনিভাবে ১৯৮৮ এর আগে মসজিদুল হারমের চতুর্দিকে রাস্তা ছিল। এই রাস্তায় ছোট ছোট কার টেক্সী চলাচল করত। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ ফাহাদ কর্তৃক মসজিদুল হারম পশ্চিম দিকে দুই মিনারসহ বর্ধিত করা হয়। ঐ সময় এখানে দোকানপাট হোটেল টয়লেট ইত্যাদি ছিল। অর্থাৎ ১৯৭০ এর দশকে তথা ৮০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মসজিদুল হারমের চর্তুদিকে রাস্তা ছিল। রাস্তার বহিঃরাংশে হোটেল রেস্টুরেন্ট দোকানপাট স্থানে স্থানে টয়লেট ছিল। ১৫/২০ ফুটের সরু রাস্তাটি বরকতময় সাফা পাহাড় ও জবলে আবু কুবাইস এর মধ্যবর্তী পাহাড়কে কেটে গাড়ি চলাচলের উপযোগী করা হয়েছিল। সৌদি কর্তৃপক্ষ তাদের রাজকীয় প্যালেসের নিরাপত্তার খাতিরে রাস্তাটিতে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়। অবশ্য মসজিদুল হারম সম্প্রসারণ উন্নয়নসহ নানাবিধ কারণে মসজিদুল হারমের অতি নিকটে গাড়ি চলাচলের অনুকূল পরিবেশ আছে বলে মনে করি না।

হযরত ইব্রাহীম (.) তাঁর প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (.)’র সহযোগিতা নিয়ে পবিত্র কাবা ঘর পুনঃনির্মাণ করেন। অতঃপর মহান আল্লাহপাকের আদেশ মতে মানবজাতিকে পবিত্র কাবায় এসে হজ সম্পাদন করতে আহ্বান করেছিলেন।

হযরত ইব্রাহীম (.) এই আহ্বান করেন জবলে আবু কুবাইসে উঠে। হযরত ইব্রাহীম (.)’র এ আহ্বান মানবের মধ্যে যে রুহ যতবার শুনবে সে ততবার হজ করবে। যে শুনবে না তার হজ নসীব হবে না।

এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহপাক পবিত্র কুরআন মাজীদে বলেন, হে ইব্রাহীম! যেই ঘর নির্মাণ করবার জন্য আমি তোমাকে আদেশ করেছি, সেই ঘরের যেয়ারত করার জন্য তুমি সকল মানুষকে আহ্বান কর। হযরত ইব্রাহীম (.) আল্লাহর নিকট আরয করলেন, হে আমার প্রতিপালক! আমি কি উপায়ে সকল মানুষকে হজের জন্য আহ্বান করব? অথচ, আমার শব্দ তো সকল মানুষের নিকট পৌঁছবে না। তখন আল্লাহ তাআলা তাকে বললেন, তুমি আহ্বান কর সকল মানুষকে পৌঁছবার দায়িত্ব আমার।

অতঃপর হযরত ইব্রাহীম (.) মতান্তরে আবু কুবাইস নামক পাহাড়ের উপরে দণ্ডায়মান হলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, হে লোক সকল! তোমাদের প্রতিপালক, একটি ঘর বানাইছেন, তোমরা উহার হজ পালন কর। বর্ণিত আছে, হযরত ইব্রাহীম (.) যখন সকল মানুষকে হজের আহ্বান করলেন, তখন সকল পাহাড়, পর্বত নিচু হয়ে গেল এবং তাঁর শব্দ পৃথিবীর সর্বপ্রান্তে সমানভাবে পৌঁছে গেল। যারা মাতৃগর্ভে ছিল, যারা পিতৃপৃষ্ঠে ছিল সকলেই এবং পাথর মাটি ও বৃক্ষরাজী তাঁর শব্দ শুনতে পেল এবং কিয়ামত পর্যন্ত যত লোক হজ করবে সকলেই তাঁর আহ্বানের জওয়াবে বলে উঠল, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। হযরত ইব্‌ন আব্বাস () থেকে মুজাহিদ, ইকরিমাহ ও সাঈদ ইব্‌ন জুবাইর () যেই সকল রিওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, ইহা সেই সকল রিওয়ায়েতের সার সংক্ষেপ। ইবনে জরীর ও ইব্‌ন আবূ হাতিম () দীর্ঘ রিওয়ায়েতের বর্ণনা করেছেন ।

মহান আল্লাহর বাণী তারা তোমার নিকট হজের উদ্দেশ্য পদব্রজে ও দুর্বল উট সমূহের উপর আরোহণ করে আসবে।

যেই সকল উলামায়ে কিরাম পদব্রজে সক্ষমব্যক্তিদের জন্য পায়ে হেঁটে হজ করাকে উত্তম মনে করেন তাঁরা এই আয়াতকে দলীল হিসাবে পেশ করেন। কারণ ‘পদব্রজে আগমনএর কথা উটে আরোহণ করে আগমনএর পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব ইহা দ্বারা এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পদব্রজে হজে গমন করবার গুরুত্ব বেশী। উপরন্তু পায়ে হেঁটে হজে গমনকারীর দৃঢ় মনোবলেরও পরিচায়ক বটে। হযরত ওয়াকী (.) হযরত ইবন আব্বাস (.) হতে বর্ণনা করেন, আমার ইহাই একটি আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, হায় যদি আমি পদব্রজে হজ পালন করতে পারতাম। কারণ, আল্লাহ্‌ তাআলা ইরশাদ করেছেন তাঁর নিকট তারা পদব্রজে আসবে।

(তাফসীর ইবনে কাছীর)

বস্তুতঃ জবলে আবু কুবাইস পবিত্র কাবার মাত্র ৪/৫ শত মিটারের মধ্যে একটি সুউচ্চ পর্বত। যার সামান্য উত্তর পশ্চিমে এই পর্বতের পাদদেশে টিলা তথা সাফা পাহাড়। ১৯৮০ এর দশকে পর্যন্ত এই সুউচ্চ পর্বত জবলে আবু কুবাইস অক্ষত ছিল। কিন্তু সৌদি কর্তৃপক্ষ ৫/৭টি রাজকীয় প্যালেস নির্মাণের জন্য এই পর্বতটির উপরি ভাগ থেকে চার ভাগের তিন ভাগ বা তার কম বেশি কেটে ফেলে। ফলে জবলে আবু কুবাইস এখন শুধুমাত্র স্মৃতি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিলুপ্তির পথে গ্রামীণ ঐতিহ্যের সার্কাস
পরবর্তী নিবন্ধপ্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগে ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম