প্রবাহ

শিয়াদের দেশ ইরান

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৩০ জুলাই, ২০২৫ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বের প্রাচীন জনপদ পারস্য। পারস্যের বড় অংশ নিয়ে আজকের ইরান। মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ইরানকে অন্যতম সাহসী তথা মাথানিচু না করার দেশ বলা যাবে। তবে ইরান হল শিয়াদের দেশ। বিগত দশকের কম বেশি সময় নিয়ে লেবাননে হিজবুল্লাহ, গাজার হামাস, পরবর্তীতে ইয়েমেনের হুতিরা জবরদখলী ইসরায়েলের কাছে মাথানত না করার নীতি অবলম্বন করছে। অর্থাৎ যার যতটুকু সামর্থ্য আছে তা নিয়ে করছে প্রতিরোধ, করছে আক্রমণও। এর সহায়ক শক্তি যে ইরান তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পারমাণবিক নিরস্ত্রিকরণ নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ ইরানের সাথে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের তদন্ত দর কষাকষি চলছে। এতেও ইরানের অবস্থান তত নমনীয় নয়।

শেষ পর্যন্ত গত ১৩ জুন জবর দখলী ইসরায়েল ইরানে বিমান হামলা চালায়। ক’দিনের ব্যবধানে আমেরিকাও হামলা চালায়। এতে বিশ্বের বুকে আলোচনার বিষয় হয় ইরান। আমাদের দেশে আলোচনার মধ্যে আরেকটি বিষয় যোগ হয়, তা হলইরানীরা ত শিয়া, শিয়া আকিদা বিশ্বাস নিয়ে আমাদের মাঝে কৌতুহলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। শিয়া আকিদা মতাদর্শ নিয়ে সম্প্রতি ফেসবুকইউটিউবে আলোচনা সমালোচনা চলমান। তৎমধ্যে প্রসিদ্ধ ধর্মীয় কয়েকজন বিজ্ঞজন বলতেছেনশিয়াদের মধ্যে অনেক ভাগ রয়েছে। যারা আল্লাহর রাসূল (.)কে নবী মানেন তাদেরকে অমুসলিম বলা যাবে না, বাতিল ফেরকা বলা যাবে। যারা আল্লাহর রাসূল (.)কে নবী না মেনে হযরত আলী (.)কে নবী মানে তাদেরকে মুসলিম বলা যাবে না। শুধু এইটুকুতেই নয়, ফেসবুকেইউটিউবে শিয়া নিয়ে আরও নানান আলোচনা সমালোচনা চলমান। তবে এই কথা সত্য যে, আমাদের দেশের ক্ষুদ্র অংশ বাদে বাকী সবাই ইসরায়েল বিষয়ে ইরানের প্রতি সমর্থন, দরদী।

শিয়া আকিদা মতাদর্শ নিয়ে আমার মধ্যেও কৌতুহল ছিল বাস্তবতা কতটুকু কি তা নিয়ে।

দীর্ঘ দিন ধরে সংবাদপত্রে লেখালেখি করে আসতেছি, স্বভাবতই কোন কিছু জানতে পারলে তার উপর একটি সংবাদপত্রে লেখা দেয়ার সুযোগ হয়। গত ২০০৫ সালে তথা আজ থেকে ২০ বছর আগে ২ সপ্তাহের প্রোগ্রামে প্রথমবার ইরান যাওয়া হয়। ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে তেহরান পৌঁছলে সহযাত্রীর ইরানী ব্যবসায়ী অংশীদারেরা আমরা ২ জনের সহযোগিতায় তৎপর। তেহরানে একজনকে দেখলাম ব্যবসার পাশাপাশি ধর্মীয় বিজ্ঞজন। তার নাম হামিদ কাবেরী। আমি তার কাছে আগ্রহ দেখাই একজন আয়াতুল্লাহর সাথে দেখা করা যাবে কিনা। এতে তিনি উৎফুল্ল মনে আমার কথাকে গুরুত্ব দেয়। তার কাছের আত্মীয় কোমে আয়াতুল্লাহ মোস্তফা নাজাফী। তার সাথে ফোনে আলাপ করে একদিন বা দুই দিন পর কোমে প্রোগ্রাম রাখেন। সেই মতে তিনি সকাল ৮ টার দিকে আমাদেরকে হোটেল থেকে তুলে নিয়ে কোমের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। অধিকাংশ ইরানী নিজেরায় গাড়ি চালায়। স্বামীর গাড়ি স্বামী, স্ত্রীর গাড়ি স্ত্রী চালায়। সন্তানেরা বড় হলে তাদের গাড়ি তারায় চালায়।

আগেই অন্য প্রবন্ধে উল্লেখ করা আছে, ইরানীরা অনেক ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পূর্ণ। ট্রেনসহ স্থল যান বলতে সবকিছু তারা নিজেরাই উৎপাদন করে। ট্রেনের পাশাপাশি কার, জিপ, বাস, ট্রাক ইত্যাদি। গণতান্ত্রিক দেশ। দেশের নাম ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান। দুর্নীতি তেমন নেই বললেই চলে। ফলে এসব যানবাহন অনেকটা সস্তা। আমরা প্রায় ১৬০ কি.মি দূরত্বে ইস্পাহানের দিকে বিশাল হাইওয়ে ধরে প্রায় ২ ঘণ্টায় কোমে পৌঁছে যাই। কোমে পৌঁছে তার ভাইয়ের বাসায় যাই। তিনি আমাদের স্বাগত জানায়। চানাস্তা দিয়ে আতিথেয়তার পর তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন কোম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন মর্যাদার আয়াতুল্লাহ মাহাদী হাদাবীর বাস ভবনে। তিনি অনর্গল ইংরেজিও বলতে পারেন। আমি যেহেতু লেখালেখি করি; দেশে এসে এই বিষয়ে লিখব এতে আয়াতুল্লাহ মোস্তফা নাজাফী আমার সাক্ষাতকারের প্রোগ্রাম করে রেখেছেন। যাতে আমার সাক্ষাতকার দুইজন আয়াতুল্লাহর সাথে হতে পারে। এতে তার ঘরেও চা নাস্তা আতিথেয়তার পাশাপাশি আমার সাক্ষাতকার পর্ব শুরু হয়ে যায়। শিয়াদের সাথে আমাদের যে বিষয়টি বেশি স্পর্শকাতর তাই প্রথম প্রশ্ন করলাম। যা পবিত্র মদিনায় ইরানের কালচারাল সেন্টারে ১৯৯৯ সালে হুজ্জাতুল ইসলাম ফালাহ হিয়ানকে করেছিলাম।

আমার প্রথম প্রশ্ন:-আপনারা হযরত আলী (.)কে ইমাম মানেন না নবী মানেন?

সাথে সাথে আয়াতুল্লাহ মাহাদী হাদাবী দৃঢ়ভাবে বললেন, তারা অর্থাৎ শিয়ারা হযরত আলী (.)কে ইমাম মানেন। তখন পুনঃ প্রশ্ন করলাম ইরানে এমন কিছু এরিয়া গোষ্ঠী আছে যারা হযরত আলীকে নবী মানেন। এতে তিনি তা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করলেন। তখন তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে বললেন, বিশ্বে এমন কিছু লোক বা গোষ্ঠী আছে যারা তাদের (শিয়াদের) দুর্নাম/বদনাম ছড়ায়। তিনি আবেগ জড়িত কণ্ঠে আরও বললেন, হযরত মুহাম্মদ (.) শেষ নবী এবং হযরত আলীর শিক্ষাদীক্ষা,জ্ঞানগরীমা সবকিছু মুহাম্মদ (.) থেকে প্রাপ্ত।

আমাদের সফরকালীন ইরানে ইমাম মেহেদীর জন্মবার্ষিকীর প্রস্তুতি দেখতেছিলাম বলে প্রশ্ন করলাম:- আপনারা কি ইমাম মেহেদী জন্মগ্রহণ করেছেন বলে বিশ্বাস করেন? এতে তিনি বললেন:-আপনারা (সুন্নিরা) ইমাম মেহেদী জন্মগ্রহণ করেননি বলে বিশ্বাস করেন। তারা (শিয়ারা) ইমাম মেহেদী জন্মগ্রহণ করেছেন বলে বিশ্বাস করেন। ২৫০ হিজরির ১৫ শাবান তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। তবে আল্লাহপাক তাকে এখনও লুকিয়ে রেখেছেন।

আমার তৃতীয় প্রশ্ন ছিলকালেমা নিয়ে। শিয়া আকিদা মতে মুহাম্মদ (.) বলার পর আলীও অলিউল্লাহ বলে থাকেন। এতে উত্তরে আয়াতুল্লাহ বলেন-‘মূল কালেমা’ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ’ অতঃপর আলী ও অলিউল্লাহ কালেমার অংশ নয়। না বললেও চলে।

৪র্থ প্রশ্ন: নামাজ জামাহ কেন? অর্থাৎ যোহর ও আসর এবং মাগরিব ও এশা পরপর পড়া হয় কেন? যা সুন্নি মতে সফরে করা হয়ে থাকে। এতে আয়াতুল্লাহ বললেন,হাদীস শরীফ মনে গ্রহণযোগ্য, প্রয়োজনে তারা হাদীস শরীফ দেখাতে পারবেন।

৫ম প্রশ্ন: মসজিদের ভিতরে বা বাহিরে হযরত আলী (.) ও ইমাম হোসাইনের ছবি কেন? এবং তা গ্রহণযোগ্য কিনা? উত্তরে বললেনগ্রহণযোগ্য নয়, তবে হারামও নয়।

৬ষ্ঠ প্রশ্নমোতা এখনও জায়েজ মনে করেন কিনা? উত্তর:-অবশ্যই জায়েজ। বর্তমানে আরবের শেখরাও মোতা বিবাহ করতেছেন। তা না হলে তাদের চার এর অধিক স্ত্রী থাকে কি করে। মোতা বিবাহের দ্বারা খারাপি রহিত হচ্ছে।

৭ম প্রশ্ন: ওযুতে পা না ধুয়ে মোছেহ করা হচ্ছে? সুন্নি মতে বিশেষ অবস্থায় করা হয়। আপনারা সব সময় করছেন। উত্তর: হাদীস শরীফ মতে গ্রহণযোগ্য।

৮ম প্রশ্ন: সুন্নিগণের কাছে প্রচার আছে, আল্লাহ তাআলা জিব্রাইল (.)কে প্রেরণ করেন হযরত আলী (.)’র কাছে। কিন্তু ভুলক্রমে মুহাম্মদ (.)কে নবুওয়াত দেয়া হয়। উত্তর: সম্পূর্ণ মিথ্যা। একটু আগেও বলেছিহযরত মুহাম্মদ (.) শেষ নবী এবং হযরত আলী (.)’র শিক্ষা জ্ঞান সবকিছু হযরত মুহাম্মদ (.) থেকে প্রাপ্ত। এইসব বক্তব্য আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রাচার ছাড়া কিছুই নয়।

৯ম প্রশ্ন: আজানে হযরত আলী (.)’র নাম নেয়া হচ্ছে কেন? উত্তর: এসব শর্ত নয়। না বললেও চলে।

১০ম প্রশ্ন: হযরত আবু বকর (.) ও হযরত ওমর (.) কে খলিফা মানেন কিনা ? উত্তর: উনারা দু’জনের বিশাল খেদমত রয়েছে এবং তারা দু’জন নবীজির সাথে থেকে খেদমত করে গেছেন। তারা উঁচু মাপের সাহাবা এবং তাদের অবদানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। কিন্তু আমরা (শিয়ারা) ইমাম মেনে থাকি।

আয়াতুল্লাহ মাহাদী হাদাবী এর সাথে আয়াতুল্লাহ নাজাফী এবং হামিদ কাবেরীও প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশগ্রহণ করেন।

মূলতঃ শিয়াদের সাথে আমাদের তথা সুন্নিদের মতপার্থক্য রয়েছে। গত ১৩ জুনের পর থেকে ইউটিউব, ফেসবুকে দেশের ধর্মীয় বিজ্ঞজনের অন্যতম প্রশ্ন শিয়ারা আল্লাহর রাসূল (.)কে শেষ নবী মানেন কিনা! যদি শেষ নবী মেনে থাকেন তাহলে তারা মুসলমান, তবে বাতিল ফেরকা হিসেবে গণ্য হবে। পবিত্র মদিনায় হুজ্জাতুল ইসলাম ফালাহ হিয়ানও আমার প্রশ্নোত্তরে একই কথা বলেছেন। অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল (.) শেষ নবী। হযরত আলী (.) তাদের ইমাম এবং প্রথম ইমাম। হযরত আলী (.) শিক্ষাদীক্ষা যাবতীয় কিছু আল্লাহর রাসূল (.) থেকে প্রাপ্ত। ২০০৫, ২০১১, ২০১৪ পরপর তিনবার ইরান সফর কালে কৌতুহল দীপ্ত হয়ে অনেক ইরানীর সাথে আলোচনার মধ্যে এই প্রশ্নটি জানতে গুরুত্ব দিই। আর তা হল আপনারা (শিয়ারা) হযরত আলীকে নবী মানেন কিনা। সকলের কাছে একই উত্তর পেয়েছিলামআল্লাহর রাসূল (.) শেষ নবী। তারা ইমাম প্রথায় বিশ্বাসী হযরত আলী প্রথম ইমাম।

বিশাল ইরানের বিস্তীর্ণ এলাকা বিভিন্ন শহরে গমনের সুযোগ হয়। এতে তাদের যে কোন মাহফিলে আলোচক আল্লাহর রাসল (.)’র নাম নেয়ার সাথে সাথে উপস্থিত সকলে সমস্বরে এই দরূদ শরীফটি পড়েন; আর তা হল-‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মদ, ওয়ালা আলি মুহাম্মদ’। আলোচক যতবারই আল্লাহর রাসূলের নাম নিবেন ততবারই তারা সমস্বরে বারে বারে এই দরূদ শরীফ পড়তে প্রত্যক্ষ করি। যা মনে হয় না আমাদের দেশে মোটেও করা হয়। শিয়ারা আল্লাহর রাসূল (.) কে শেষ নবী মানেন এবং তারা আশেকে রাসূল এতেও আমি নিশ্চিত। যদিওবা শিয়াদের সাথে আমাদের নানান বিষয়ে মত পার্থক্য রয়েছে।

তবে দেশে যে হারে ওয়াহাবী, সুন্নি, কওমী, আহলে হাদীস নিয়ে কাদা ছুড়াছুড়ি চলছে, একে অপরকে কাফের ফতোয়া দেয়া হচ্ছে তা নিয়েও ভাবছি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি : অগ্রগতি ও অর্জন