বিগত প্রায় ৪০ বছর তথা ১৯৮৪/৮৫ সাল থেকে বাস্তবতার আলোকে গত হজকে অনেকটা স্মরণীয় বলা যাবে। অবশ্য তা ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে করোনা মহামারীর কারণে হজের উপর প্রভাব থাকায় এ তিন বছর বাদে।
৪০ বছরের ব্যবধানে গত হজ স্মরণীয় হবার পক্ষে রয়েছে একাধিক যৌক্তিকতা:-
১. হজযাত্রীর সংখ্যা কম: ১৯৮০/৯০ এর দশকে ৩০ থেকে ৪০ লাখ বা আরও বেশি নর–নারী হজ করতেন বলে মনে করি।
বাদশাহ ফয়সল ১৯৭৩ সালে তেল অবরোধ করলে বিশ্বব্যাপী তেলের জন্য হাহাকার পড়ে যায়। অতঃপর, সৌদি সরকার তেলের দ্বিগুণ তিনগুণ দাম পেয়ে অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠে। সৌদিতে ব্যাপক উন্নয়নে কর্মসংস্থানের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীদের ঢল নামে। ঢাকায় ১৯৭৭ সালে সৌদি দূতাবাস খুললে সৌদি এয়ারলাইন্স ঢাকার সাথে ফ্লাইট চালু করে। এতে বাংলাদেশ থেকেও টাকা রোজগারের জন্য সৌদি আরবে যাওয়া শুরু হয়।
হজ ছিল উন্মুক্ত। অপরদিকে, হজের সময় এবং রমজানের শেষ দশকে সৌদি আরবে অফিস আদালত সহ অনেক কিছু বন্ধ থাকে। ফলে প্রবাসীরা হজ করতে অতীব তৎপর হয়। মনে হয় বিদেশী হজযাত্রীর চেয়ে সৌদি আরবে অবস্থানকারী প্রবাসীদের সংখ্যা অত্যধিক হবে। হজের কয়েক দিন আগে পবিত্র মক্কায় এবং ৫ দিনব্যাপী হজ পালনকালে মিনা–আরাফাত–মুজদালেফা প্রবাসীগণের ব্যাপক উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যেত। ফলে হজযাত্রীর সংখ্যা সর্বমোট ৩০ বা ৪০ লাখ অথবা আরও বেশি বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।
২০০০ সাল থেকে সৌদি সরকার হজ ব্যবস্থাপনাকে একাধিক দিকে নিয়ম শৃঙ্খলায় আনতে সচেষ্ট হয়। সে হারে পর্যায়ক্রমে হজযাত্রীর সংখ্যা কমে আসতে থাকে।
করোনা মহামারীর পর থেকে সৌদি সরকার হজ ব্যবস্থাপনাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজায় এবং সৌদি আরবের অভ্যন্তর থেকে প্রবাসী বা সৌদি নাগরিক অনুমতি ব্যতীত যাতে হজ করতে না পারে সেই লক্ষে কড়াকড়ি আরোপ করতে থাকে।
গত (২০২৪) সালে বিশেষ কোন ঘটনা দুর্ঘটনা ছাড়ায় প্রায় ১৫ শতের কম বেশি হজ্বযাত্রী মারা যায় ৫ দিনব্যাপী হজ্বপালন করতে গিয়ে। যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৌদি সরকারের হজ্ব ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। অপরদিকে, তাদের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে হজ্ব নিয়ে সমন্বয় করতে গিয়ে চলতি বছর এসে আরও বেশি কড়াকড়ি করেছে বলে প্রতীয়মান। ফলে পাকিস্তান থেকে প্রায় ৬৭ হাজার, ভারত থেকে অনুরূপ বড় অংকের হজযাত্রী সৌদি সিস্টেম অনুসরণ করতে না পেরে হজে গমন করতে পারেনি। এই রকম বিশ্বের আরও একাধিক দেশ রয়েছে।
পবিত্র মক্কায় সৌদি কর্তৃপক্ষ অবৈধ অবস্থানকারীদের উপর কঠোরভাবে ধরপাকড় শুরু করে। এতে প্রবাসীদের ইকামা থাকলে হবে না, পবিত্র মক্কায় কাজ করার পারমিট থাকতে হবে। অন্য শহরের পারমিট ব্যবহার করে এখানে কাজ করা যাবে না। যা পবিত্র মক্কায় প্রবাসীদের উপর স্মরণীয় অভিযান বলা যাবে। শুধু তাই নয়, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়, হজ্ব করতে পবিত্র মক্কা আসতে ২ লাখ ৭০ হাজার প্রবাসীকে ফিরিয়ে দিয়েছে পুলিশ। পবিত্র মক্কা অনেকটা পাহাড়–পর্বত কেন্দ্রিক বলা যাবে। পাহাড়–পর্বত দিয়ে পায়ে হেঁটে আসা–যাওয়া করা যায়। ঐ সকল পথ দিয়েও সৌদি সরকার নজরদারী আরোপ করে। ফলে বিগত প্রায় ৪০ বছরের ব্যবধানে মাত্র ১৬ লাখ ৭৩ হাজার ২৩০ জন নর–নারী হজ করে যা এই সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন।
২. তাপমাত্রা: গত বছর ২০২৪ সালে হজ্বের সময় ৫ দিনব্যাপী হজপালন কালে তাপমাত্রা ছিল ৪৮–৫০ ডিগ্রী প্রায়। কিন্তু গত হজ্বে তাপমাত্রা ছিল ৪৩–৪৫ ডিগ্রীর মধ্যে। কিন্তু হজ্বের পরপর তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে ৪৭–৪৮ ডিগ্রী হয়ে যায়।
৩. হজযাত্রীর কষ্ট লাঘবে অবদান:
(ক) ৫ দিনব্যাপী হজ পালনে মিনা–আরাফাত–মুজদালেফা ট্রেন সার্ভিস উন্মুক্ত করে দেয়। হজযাত্রীর অন্যতম পরিচয় নুসুক কার্ড। এই কার্ডে একজন হজযাত্রীর সমস্ত ডাটা রয়েছে।
(খ) জামরাতে পাথর মারতে আসা–যাওয়া কালে স্থানে স্থানে উপরে তাঁবু নিচে ফ্যান ও পানি ছিড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
(গ) জামরাত থেকে পবিত্র মক্কা ৫/৬ কি.মি রাস্তা ফ্রি আসা–যাওয়া করার জন্য হাজার হাজার বাসের ব্যবস্থা করে। এই লাখ লাখ হজ্বযাত্রী বাসে উঠতে সৌদি সুন্দর শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা ভাববার বিষয়।
(ঘ) ২০২৪ এর মত ২০২৫ সালে এসে যেনতেনভাবে ব্যারিকেড দেয়া হয়নি।
(ঙ) ২০২৪ এর হজে প্রচণ্ড গরমে হাজীরা প্রয়োজনীয় পানি পায়নি বলে সমালোচনাগুলোর মধ্যে একটি। ফলে গত হজ্বে মসজিদুল হারমের চর্তুদিকে কত কোটি পানির বোতল বিতরণ করা হয়েছে তা ভাববার বিষয়। শুধু আমাদের অবস্থান করা মিসফালাহ এরিয়ায় প্রতিদিন লাখ বোতল পানি হজযাত্রীগণের নিকট বিতরণ করে। এমন অবস্থায় এসে দাঁড়ায় পানি নেওয়ার জন্য হজযাত্রীগণকে আহ্বান করা হচ্ছে। মনে হয় প্রত্যেক হজ্বযাত্রী হজ্বপালন কালে শত শত পানির বোতল নিয়ে গেছে কোন ঝামেলা ছাড়া। হজের পর জান্নাতুল মুয়াল্লা যেয়ারতে যেতে ঐদিকেও দেখলাম পানির বোতল বিতরণ করা হচ্ছে।
৪. কর্তৃপক্ষ চাচ্ছিল গরমের মধ্যে যাতে হাজীরা যেনতেন স্থানে নামাজ না পড়ে: এই পয়েন্টে সৌদি সরকার ব্যর্থ। যেহেতু হাজীরা যাবে কোথায় মসজিদুল হারম পূর্ণ হয়ে গেছে। সৌদি সরকার মিসফালাহ এরিয়ার হাজীদেরকে বাধ্য করতেছিল প্রায় ১ কি.মি এর অধিক হেঁটে মসজিদুল হারমের তৃতীয় বর্ধিতকরণ তথা বাদশাহ আবদুল্লাহ হেরেমে যেতে। কিন্তু অধিকাংশ হাজী হেঁটে হেঁটে এত দূরে গিয়ে নামাজ পড়তে হচ্ছে বলে কর্তৃপক্ষের উপর বিরক্ত। ফলে লাখ হাজী আজানের টাইম হলে রাস্তায় এসে প্রচন্ড গরমের মধ্যে নামাজ পড়ে।
সৌদি সরকার যতদিন পর্যন্ত মসজিদুল হারম ব্যাপক সম্প্রসারণ না করবে ততদিন মসজিদুল হারমে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে, তাওয়াফ করতে গিয়ে হজ্ব ও ওমরাহকারীর দুর্ভোগ থেকেই যাবে।
২০২৪ সালের হজে হজযাত্রী মারা যাওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনা হওয়ায় সৌদি সরকার ব্যাপক সাবধানতা অবলম্বন করে। যা স্বীকার করতেই হবে। এতে যেমনি সৌদি সরকারে সাবধানতা ছিল সামগ্রিক পরিবেশ পরিস্থিতি তাপমাত্রাও অনুকূলে ছিল। ফলে বিগত প্রায় ৪০ বছরের ব্যবধানে কোন অঘটন ছাড়াই হজ পালিত হয় এবং হজযাত্রীর সংখ্যা ছিল সর্বনিম্ন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক।