প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৭ মে, ২০২৫ at ৭:৩৪ পূর্বাহ্ণ

দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করে ধর্মীয় শিক্ষা লাভের লক্ষ্যে। এখানে সে সময় ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাধারণ শিক্ষার সমন্বয় ছিল না বললেই চলে। ব্রিটিশরা তাদের কৌশলগত কারণে ইসলামী শিক্ষায় হাত দেয়। নিয়ন্ত্রণ নিতে সচেষ্ট। এতে ভারতে উত্তর প্রদেশের পশ্চিম দিকে কয়েকজন ধর্মীয় মুরব্বির মাথায় সচেতনতা আসে ব্রিটিশদের ইসলামী শিক্ষায় হাত দেয়াটা ধর্মের জন্য খুবই ক্ষতিতর হবে। ফলে ক’জন ধর্মীয় মুরব্বি দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৬৬ সালে। এই মাদ্রাসা দ্রুততার সাথে প্রসার লাভ করে। উপমহাদেশে ধর্মীয় আবেগে আলোড়ন সৃষ্টি করে। দেওবন্দ এলাকার নাম। ঐ সময় মৌলিকভাবে ইসলাম ধর্মে একালের মত আকিদা বিশ্বাস নিয়ে এত মত পার্থক্য করত না মুসলমানেরা। অবিভক্ত বাংলার সকল মতাদর্শের ছাত্ররা দেওবন্দ মাদ্রাসায় গিয়ে লেখাপড়া করত। এই মাদ্রাসা বিশ্বব্যাপী এত বেশি সাড়া জাগায় যে, তাদের ফান্ডে যে পরিমাণে অনুদান জমা হত তা খরচ করতে কষ্টসাধ্য ছিল। দেওবন্দ সাহারানপুর জেলার অংশবিশেষ। একালে কেউ দেওবন্দ মাদ্রাসা দেখতে গিয়ে থাকলে তিনি হয়ত হতবাক হবেন দেওবন্দ মাদ্রাসার বিশালত্ব দেখে।

অপরদিকে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে আরও ১০/১৫ বছরের ব্যবধানে। স্যার সৈয়দ আহমদ খান চিন্তা করলেন, একদিকে ব্রিটিশরা ইসলাম ধর্মে কর্তৃত্ব নেতৃত্ব দিতে চাচ্ছে, অপরদিকে দেওবন্দ মাদ্রাসার মতাদর্শ হল সম্পূর্ণ ধর্ম ভিত্তিক। এতে উপমহাদেশে প্রখ্যাত সাহসী ব্যক্তিত্ব স্যার সৈয়দ আহমদ খান ধর্মীয় এবং সাধারণ শিক্ষার সমন্বয়ে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৭৫ সালে। এর নাম দেন মাদ্রাসাতুল উলুম। সাথে আরও প্রতিষ্ঠা করেন মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ সংক্ষেপে গঅঙ। পরবর্তীতে উভয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ লাভ করে। এই বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুততার সাথে বিশালত্ব লাভ করে। উপমহাদেশে ব্যাপক সাড়া জাগায়। সর্বমহলে বাড়ে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। যার রয়েছে দীর্ঘ বর্ণনা।

মৌলিকভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার সমন্বয়ে। ফলে মতাদর্শ নিয়ে দেওবন্দ আর আলীগড়ের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয় এবং তা পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে। ভারতবর্ষে দেওবন্দ আর আলীগড়ের দূরত্ব বেশি নয় ২৪৫ কি.মি বা কম বেশি। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে দেওবন্দ এর ১০/১৫ বছরের ব্যবধানে। ফলে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোগ নেয় দেওবন্দের সাথে মত বিনিময় করে দূরত্ব কমানো যায় কিনা। ঐ সময় দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রধান পরিচালক ছিলেন শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান। অপরদিকে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ব্যক্তিত্ব আলীগড় ভাবধারার প্রধান প্রবক্তা লেখক ডেপুটি কালেকক্টর নজির আহমদ। আলীগড় থেকে সংবাদ দেয়া আছে নির্দিষ্ট ট্রেনে ডেপুটি কালেকক্টর জনাব নজির আহমদ দেওবন্দ যাচ্ছেন। তিনি দেওবন্দে পরিবেশও দেখবেন এবং মতবিনিময়ও করবেন। দেওবন্দ গমনের সময়সূচি টেলিগ্রাম (সেই সময়কার তার বার্তা) মাধ্যমে জানানো হয়।

ডেপুটি কালেকক্টর জনাব নজির আহমদ তার আত্মজীবনীতে লিখেন, ডিসেম্বর এর কনকনে শীত রাত ১১ টার দিকে ট্রেন এসে থামল দেওবন্দ স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফরমে এদিক সেদিক দেখতে ছিলেন। কনকনে শীতে নাজুক অবস্থা। লোকজন নেই বললেই চলে। এমন সময় এক ব্যক্তি একটি কালো ছ্যাড়া কম্বল গায়ে দিয়ে নিকটে এসে বিনীতভাবে সালাম জানিয়ে জানতে চাইলেন তার গন্তব্য কোথায়। এতে জনাব নজির আহমদ বললেন দেওবন্দ মাদ্রাসা। তখন লোকটি বলল, তিনি দেওবন্দ মাদ্রাসার একজন খাদেম। এই বলে লাগেজপত্র নিজের কাঁধে মাথায় তুলে নিলেন। আর এদিকে ডেপুটি কালেক্টর নজির আহমদ লাগেজ বহনকারী লোককে বলতে লাগলেন সে এত বেশি লাগেজ বহন করতে পারবে কিনা, রাস্তায় কোন ফেলে দিবে কিনা। তখন লোকটি হেঁসে বলল, তার এ রকম মালামাল বহন করে নেয়ার অভ্যাস আছে। কথা বলতে বলতে দেওবন্দ মাদ্রাসায় এসে পৌঁছলেন। লোকটি একটি সাজানো গুছানো ঘরে এনে বিছানা পেতে দিলেন। আনুষঙ্গিক কার্যাবলী ছেড়ে বিছানায় শুয়ার ব্যবস্থা করে লোকটি এসে তার হাত পায়ের সেবা করতে লাগলেন। এতে ডেপুটি কালেকক্টর নজির আহমদ খেদমতে খুশি হয়ে বললেন, তুমি কাল সকালে আমার সাথে সাক্ষাৎ কর তোমাকে বকশিস দিব।

পরদিন সকালে ফজরের নামাজ পড়ার পরেই মসজিদে সাক্ষাৎ করতে গেলেন শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের সাথে। বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট সাক্ষাৎ প্রার্থী নিয়ে তিনি বসেছিলেন মসজিদে। এতে ডেপুটি কালেকক্টর সাহেবকে দেখে শায়খুল হিন্দ জানতে চাইলেন গত রাতে কোন কষ্ট হয়নি তো। এতে ডেপুটি কালেকক্টর অতি আশ্চর্য্য বিস্ময় দৃষ্টিতে দেখলেন,গত রাত্রে ট্রেন স্টেশন থেকে মালামাল কাঁধে মাথায় নিয়ে বহন করা, যিনি গেস্ট রুমে খাবার ও শুয়ার ব্যবস্থা করে দেন, সকালে বকশিস দেয়ার আশ্বাস দেন সেই ব্যক্তিই হচ্ছেন দেওবন্দ মাদ্রাসার শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান। তখন ডেপুটি কালেকক্টর নজির আহমদ অত্যধিক লজ্জিত হন। মনে মনে বলতে লাগেন, এই ব্যক্তি যদি ইসলামের সুমহান আদর্শে আদর্শবান না হয়, তবে আদর্শবান আর কোথায় পাওয়া যাবে।

আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ডেপুটি কালেকক্টর নজির আহমদ দেওবন্দ মাদ্রাসায় গেলেন, পরিবেশ উপলদ্ধি করলেন, মত বিনিময় করলেন। বাস্তবতা নিরিখে মনে হয় না এর দ্বারা বড় ধরনের কোন সুফল বয়ে আনবে।

মৌলিকভাবে দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে দেওবন্দ ও আলীগড়ের মধ্যে চরম মত পার্থক্য তিক্ততায় রূপ নেয়। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার সৈয়দ আহমদের অনুসারীগণ শিক্ষা সংস্কৃতি জীবন দৃষ্টির দিক দিয়ে ভারতবর্ষের মুসলিম সমাজে ব্রিটিশ গেসাদেরকে ন্যূনতম হলেও রুখতে সক্ষম হয়েছেন। এই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় মতাদর্শের ব্রিটিশ শাসকদের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে মুসলিম সমাজকে অফিস আদালতে নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।

অপরদিকে দেওবন্দের দৃষ্টিভঙ্গি জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইংরেজদের বর্জন করে চলা। ভারতীয় এই উপমহাদেশের মাটিতে মানুষকে ধর্মপালনে দৃঢ়তা স্বদেশী চিন্তা ও জীবন দৃষ্টিতে গড়ে তুলায় ছিল লক্ষ্য উদ্দেশ্য।

ফলে দুই ভাবধারার দুই বিশ্বখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা দেওবন্দ ও আলীগড় চিন্তাধারায় প্রকাশে লেখায় বক্তৃতায় প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে দূরত্ব লেগেই থাকত। দেওবন্দ ভারতে উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার একটি অংশ। যা সাহারানপুর থেকে ৪৫/৫০ কি.মি দূরত্বে। দেওবন্দ একটি জায়গার নাম। মাদ্রাসার নাম দারুল উলুম দেওবন্দ। যাকে ইলমের দরজা বলা হয়ে থাকে। দেওবন্দ প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ৬০/৭০ বছর মনে হয় আকিদা মতাদর্শ নিয়ে এই মাদ্রাসা তেমন তৎপর ছিল না। ধর্মীয় শিক্ষা দানে মুখ্য ভূমিকা ছিল। আমাদের এই অঞ্চলের সকল মতাদর্শের লোক দেওবন্দ গিয়ে শিক্ষা লাভ করাটা গৌরববোধ করত।

১৯৩০/৪০ এর দশকের পর থেকে দেওবন্দ মতাদর্শ ও সুন্নি মতাদর্শ নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা সমালোচনা শুরু হয়। দেওবন্দসাহারানপুরের অবস্থান ভারতের উত্তর প্রদেশের একদম পশ্চিম সীমান্তে। এখান থেকে ২/৩ শত কি.মি পূর্বে উত্তর প্রদেশের বেরলীতে শায়িত আছেন হযরত আহমদ রেজা খান বেরলভী (রহ.)। তিনি জন্ম লাভ করেন দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাত্র ১০ বছর আগে ১৪ জুন ১৮৫৬ সালে। ইন্তেকাল করেন প্রায় ৬৫ বছর বয়সে ১৯২১ সালের শুক্রবারে।

তবে ১৯৩০৪০ এর দশকের পর থেকে দেওবন্দ মাদ্রাসার মতাদর্শ কওমী ও সুন্নী উভয় মতাদর্শে না থেকে এক মতাদর্শে বলে ধারণা। অর্থাৎ মূল হচ্ছে দেওবন্দী মতাদর্শ অপরদিকে সুন্নী মতাদর্শ। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় দেওবন্দী ও সুন্নী মতাদর্শের দূরত্বে থেকে ধর্মীয় শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার সমন্বয়ে চলমান। যা দেওবন্দ ও সুন্নী মতাদর্শ থেকে উর্ধ্বে বলে মনে করি।

অপরদিকে সাহারানপুর মাদ্রাসাকে যতটুকু আকিদা বিশ্বাস নিয়ে কড়াকড়ি মনে হয়েছে দেওবন্দকে উল্টো উদার মনে হয়েছে। দেওবন্দ মতাদর্শ আহলে হাদীস বা সুন্নি মতাদর্শ নয়। নিজস্ব ভিন্ন মতাদর্শ মনে করি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাতীয় নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন; কোনটা আগে
পরবর্তী নিবন্ধকাব স্কাউট ইউনিট লিডার বেসিক কোর্সের মহা তাঁবু জলসা সম্পন্ন