প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৯ এপ্রিল, ২০২৫ at ৮:১৩ পূর্বাহ্ণ

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ৫ জুন হজ্ব। ৮ যিলহজ্ব থেকে ১৩ যিলহজ্ব পর্যন্ত ৬ দিনব্যাপী হজ্ব পালন। কিন্তু ১২ যিলহজ্ব মহান সাহাবাগণের মধ্যে অনেকেই নিজ প্রয়োজনে আল্লাহর রাসূল (.)’র কাছ থেকে বিদায় নেয়ার অনুমতি পান। ফলে একালে ৮ থেকে ১২ যিলহজ্ব ৫ দিনব্যাপী হজ্ব পালিত হচ্ছে। ১৮ লাখ থেকে ২৬ লাখ নরনারী হজ্ব পালন করে থাকেন। তৎমধ্যে লাখ খানেক নরনারী অতি সওয়াবের আশায় ১২ যিলহজ্ব মিনায় অবস্থান করে ১৩ যিলহজ্ব ৩ শয়তানের প্রতি আরও ২১ টি পাথর মেরে মিনা ত্যাগ করেন।

প্রায় ১৪ শত বছর পবিত্র মক্কার কতেক বাসিন্দা হজ্বযাত্রীগণকে সহযোগিতা করতে থাকতেন। তাদেরকে মোয়াল্লেম বলা হত। তারাই হজ্বযাত্রীগণকে পবিত্র মক্কায় অবস্থানের ব্যবস্থা করা, মিনাআরাফাতে তাঁবুর ব্যবস্থাসহ যাবতীয় সহযোগিতা দিয়ে আসতেন।

মিনাআরাফাতমুজদালেফায় বিদ্যুৎ এবং ব্যাপক পানির ব্যবস্থা ১৯৮০ এর দশক থেকে। যুগে যুগে যেমনি আধুনিকতা ও আরামের ছোয়া লেগে আসছে তেমনি মোয়াল্লেমগণও পরিবর্তিতভাবে সেবা দিয়ে আসছেন। গত ৫০৬০ বছর যাবৎ হজ্বযাত্রীর সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় মোয়াল্লেমগণ ৫ দিনব্যাপী হজ্ব পালনে সে অনুপাতে ব্যবস্থাপনা করে আসছিলেন। হজ্বযাত্রীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তারা পবিত্র মক্কায় হজ্বযাত্রীগণের অবস্থানের বিষয় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাদ দেন।

গরীব দেশের হজ্বযাত্রীরা টাকা বাঁচানোর জন্য মসজিদুল হারমের অভ্যন্তরে, রাস্তারধারে যেনতেন স্থানে অবস্থান নিতে থাকেন। এতে পবিত্র মক্কার পরিবেশ কলুষিত হওয়া স্বাভাবিক। ফলে সৌদি সরকার হজ্বকে নিয়ন্ত্রণে নিতে এগিয়ে আসে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাফেলা এজেন্সী প্রথা চালু করিয়ে দেয়।

ওআইসি এর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয় বিশ্বের প্রত্যেক দেশ থেকে হাজারে একজন মুসলমান হজ্ব করবেন। সেই মতে বাংলাদেশের কোটা ১ লাখ ২৭ হাজার। সরকারীভাবে অনুমোদন প্রাপ্ত হজ্ব এজেন্সীরা তাদের নিয়ন্ত্রিত হজ্বযাত্রীগণকে নিয়ে গিয়ে দুই পবিত্র নগরীতে হোটেল ঠিক করে অবস্থান করাবে। মোয়াল্লেমগণের সহযোগিতায় ৫ দিনব্যাপী হজ্ব পালন করা হয়।

২০২০ ও ২০২১ সালে করোনা মহামারীর পর সৌদি সরকার হজ্ব ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজায়। এতে মোয়াল্লেম প্রথা রহিত হয়ে সার্ভিস সেন্টার নাম ধারণ করে। বাংলাদেশে ১৫৩৯টি লাইসেন্স থাকলেও ৮ শত থেকে ১ হাজার হজ্ব লাইসেন্স চালু আছে। সৌদি সরকার এত বেশি হজ্ব লাইন্সেসের উপর বিরক্ত। এতে গত বছর ৩ শত জন হজ্বযাত্রী এক লাইন্সেসের আওতায় থাকবে। ফলে ৫/৭ টি হজ্ব এজেন্সীকে এক এজেন্সীর আওতায় গিয়ে তাদের হজ্বযাত্রীদেরকে হজ্ব করাতে হয়েছে। এতে নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে মিনাআরাফাতে হজ্বযাত্রীগণের ভোগান্তি বেড়েছে বলে মনে করি। হজ্ব এজেন্সী মালিক ও তাদের স্টাফদের হজ্বযাত্রীগণকে সহযোগিতা সেবা দিতে অসহায় প্রত্যক্ষ করি।

আগামী হজ্বের লক্ষে সৌদি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২ হাজার হজ্বযাত্রী এক এজেন্সীর আওতায় হজ্ব করবে। এতে বাংলাদেশ সরকার অসহায়। ৮ শত থেকে ১ হাজার হজ্ব এজেন্সী রয়েছে। তারা চাচ্ছে তাদের নিজ নিজ লাইসেন্স ব্যবহার করে হজ্বযাত্রীগণকে হজ্ব করাবে। শেষ পর্যন্ত এক লাইসেন্স ব্যবহার করে ১ হাজার হজ্বযাত্রীকে হজ্ব করাতে হবে। বেসরকারী এজেন্সীর আওতায় আগামী হজ্ব হবে ৭৯ হাজার জন থেকে কম। সেই অনুপাতে এক লাইন্সেসে ১ হাজার হজ্বযাত্রী হজ্ব করলে ৭৫/৮০ টি হজ্ব লাইন্সেস ব্যবহৃত হবে মাত্র। বাকী সমস্ত কাফেলা এজেন্সীকে এই সব লাইন্সেসের আওতায় থাকতে হবে।

তবে হজ্বযাত্রীগণকে মনে রাখতে হবে তারা হজ্বের আগে বা পরে পবিত্র মদিনা যেয়ারত করে পবিত্র মক্কায় এসে হজ্বের অপেক্ষায় থাকবেন। এখানে তাদের হজ্ব এজেন্সীর লাইসেন্স ব্যবহার হোক বা না হোক হজ্ব এজেন্সী তৎপর থাকবে তাদের নিয়ন্ত্রিত হজ্বযাত্রীকে সেবা দিতে।

৯ যিলহজ্ব দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতে অবস্থানকেই হজ্ব বলে। কিন্তু মিনায় অবস্থান করা হয় হজ্ব কার্যক্রমে ৪ দিনব্যাপী। এখানে মোয়াল্লেম নাম্বার স্থলে সার্ভিস সেন্টার হিসেবে হজ্বযাত্রীগণ সরকারী বাসে মিনায় রওনা হবেন। তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে বাংলাদেশের ১ হাজার হাজীর এজেন্সীর নামকরণে। সেই মতে সার্ভিস সেন্টারের নাম্বার অনুপাতে তাদের আওতাভুক্ত এরিয়ায় এই ১ হাজার জনের তাঁবু ও তাঁবুর ভিতর সিট বরাদ্দ দিবে। ৭/৮ বা ১০/১২ টি হজ্ব এজেন্সী তাদের আওতাভুক্ত হজ্বযাত্রীকে এক লাইন্সেসে হজ্ব করাবেন। কাজেই এজেন্সী মালিক ও তাদের স্টাফরা নিজস্ব লাইন্সেস ব্যবহার না হলেও তাদের ব্যানার ফেস্টুন ব্যবহার করে তাদের নিজস্ব হজ্বযাত্রীগণকে সেবা ও আরাম দিতে তৎপর থাকবে স্বাভাবিক। তারপরও বিশৃংখলা এলোমেলো হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

আগেকার বিগত ৩০/৪০ বছরের নিয়মে এখনও বাসের স্বল্পতা ও শৃংখলা রক্ষায় ৮ যিলহজ্ব সকালের স্থলে ৭ যিলহজ্ব দিবাগত রাত হজ্বযাত্রীগণকে মিনা নেয়া শুরু করে দেয়। তেমনিভাবে ৯ যিলহজ্ব সকালে মিনা থেকে আরাফাত যাওয়া হজ্বের তারতীব হলেও ৮ তারিখ দিবাগত রাত হজ্বযাত্রীকে মিনা থেকে আরাফাতে নিয়ে যায়। অর্থাৎ ৫ দিন ব্যাপী হজ্ব কার্যক্রমে হজ্বযাত্রীগণকে দায়িত্ব পালনে বিগত ৩০/৪০ বছরের সিস্টেম বহাল রয়েছে। পুরাতন বাস সরিয়ে ফেলে অত্যধিক নতুন বাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু মিনা আরাফাতের অবস্থানটা আগের মত আরামদায়ক মনে হচ্ছে না। বিশেষ করে মিনায় অবস্থানের এরিয়া খুব কম এবং খাবারের মান আমাদের বাংলাদেশীদের রুচির অনুকূল মনে হয় না। জানি না আমার সাথে অন্যান্য হজ্বযাত্রীরা একমত কিনা। তবে জুন মাস তথা গরমকালে হজ্ব। তা শারীরিকভাবে সাবধান থাকতে হবে। শারীরিক সক্ষমতা ঠিক রাখতে পবিত্র মক্কার হোটেলে হজ্বের আগে স্বাস্থ্য সচেতন আবশ্যক। যেহেতু ৫ দিনব্যাপী হজ্ব খুবই কষ্টসাধ্য। ১ হাজার জন হজ্বযাত্রীকে এক এজেন্সীর আওতায় হজ্ব করতে হলেও তার আওতাভুক্ত আপনি যে এজেন্সীর মাধ্যমে হজ্ব করতে যাচ্ছেন তার দিক নিদের্শনা আনুগত্য থাকা হজ্বযাত্রীর জন্য অপরিহার্য।

মনে রাখতে হবে আমাদের হানাফী মাজহাব মতে হজ্বের ৩ ফরজ ৬ ওয়াজিব। তৎমধ্যে প্রথম ফরজ হচ্ছে হজ্বের নিয়তে এহরাম পরিধান করা। দ্বিতীয়৯ যিলহজ্ব দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতে অবস্থান । তৃতীয়১০ থেকে ১২ যিলহজ্বের মধ্যে পবিত্র কাবা তাওয়াফ করা।

৬ ওয়াজিব হল। ১. ৯ যিলহজ্ব দিবাগত রাত মুজদালেফায় অবস্থান করা ২. মিনায় ৩ শয়তানের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করা ৩. হজ্বের কোরবানী তথা দমে শুকরিয়া করা ৪. মাথা মুণ্ডানো বা চুল কাটা ৫. সাফামারওয়া সায়ী করা ৬. হজ্বের পর পবিত্র মক্কা থেকে বিদায় নিতে বিদায় তাওয়াফ করা। বিদায় তাওয়াফে এহরাম থাকবে না, সায়ী থাকবে না শুধু তাওয়াফ।

হজ্ব করতে ধর্মীয় জ্ঞান লেখাপড়া করা আবশ্যক। হজ্বের উপর প্রশিক্ষণ নিতে হবে। হজ্বযাত্রী কল্যাণ পরিষদ প্রতি বছরের ন্যায় আগামী ১৯ এপ্রিল শনিবার সকাল ঠিক ৯ টা থেকে হজ্ব ও ওমরাহ যাত্রীর বিনা ফিতে প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছে। আর তা হচ্ছে চট্টগ্রাম মহানগরীর স্টেশন রোডস্থ বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের হল রুমে। হজ্বযাত্রী কল্যাণ পরিষদ কোন কাফেলা এজেন্সী নয়, হজ্বযাত্রীগণের কল্যাণে সেচ্ছাসেবী সংগঠন। প্রয়োজনে ০১৭১৩১১৫৬০১ নাম্বারে যোগাযোগ করতে পারেন হজ্ব ও ওমরাহ সম্পর্কে আরও জ্ঞান লাভ করতে।

এ প্রশিক্ষণে প্রত্যেককে দোয়া দরূদের পুস্তক প্রদান করা হবে। গ্রুপ ভিত্তিক “হেজাজের পথে: মোবারক স্মৃতি” গ্রন্থও প্রকাশ করা হবে। প্রশিক্ষণে উভয় পুস্তক বিনা হাদিয়ায় প্রদান করা হবে।

একালে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হজ্বের ধর্মীয় প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। যেহেতু মানুষের নানান ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। অতএব ৪০ দিন বা কম বেশি সময়ের জন্য দেশ থেকে সৌদি আরব চলে যেতে হবে বিধায় দুনিয়াবী প্রস্তুতিটাই প্রাধান্য পাচ্ছে। ধর্মীয় প্রস্তুতিটা গৌণ হয়ে গেছে। অপরদিকে, মক্কা মোকাররমা ও মদিনা মুনাওয়ারা অতি পবিত্রতম স্থানে যেহারে এনড্রয়েড/স্মার্ট মোবাইল যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে তা নিয়ে ভাবতে হবে। এও ভাবতে হবে ৭০ বছরে ৭০ বার হজ্ব করলে এক ওয়াক্ত ফরজ নামাজের সমান হবে না। কিন্তু কেন জানি, হজ্বের সফরে অধিকাংশ হজ্বযাত্রীর নামাজ কাজা হচ্ছে। হজ্বের সময় সবর ধৈর্য অত্যাবশ্যক। যাতে আমরা কারও সাথে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত না হই। কাফেলা এজেন্সীর কোন অব্যবস্থাপনা অনিয়ম থাকলে আমরা হোটেলের কক্ষে বসে সমালোচনা না করে তাদেরকে সরাসরি বলাই উত্তম।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলাম লেখক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্বের চাল উৎপাদন এবং গ্রামীণ বাংলাদেশের তৃতীয় স্থান
পরবর্তী নিবন্ধবাঁধনের জন্মদিন