প্রবাহ

ব্যাংক লুটেরা- ঘুষখোরদের এবাদত ও প্রশান্তি লাভ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১২ মার্চ, ২০২৫ at ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ

একালে দেশের ব্যাংক থেকে লুট করা হয়েছে লক্ষ হাজার কোটি টাকা। মেগা প্রকল্পের নামে লুট করা হয়েছে অগণিত হাজার কোটি টাকা। এতে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়া হয়েছে। দেশের সরকারী, আধা সরকারী, প্রতিষ্ঠানসহ রাজধানী ঢাকা থেকে জেলা উপজেলা পেরিয়ে ইউনিয়নে পর্যন্ত ঘুষ আর ঘুষ। ঘুষ ছাড়া কাজ হয় এমন ঘটনা বিরল। এখন প্রশ্ন আসে এসব লক্ষ কোটি জঘন্য লোকদের কি অনুশোচনা আছে! বরং মনে হয় উল্টো আত্মতৃপ্তিতে আছে। কেন! তারা বেশি বেশি এবাদত করে। এ প্রসঙ্গ নিয়ে বিভিন্ন জনের সাথে আলাপ আলোচনা হয়। একজন বললেন, লক্ষ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক লুটকারী তাহাজ্জুদের নামাজ বাদ দেন না। আরেকবার আরেক জন বললেন, এই অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী বেশি বেশি নফল রোজা রাখেন। আরেকবার আরেকজন বললেন, প্রতি বছর মানুষকে হজ্ব করান। সম্প্রতি হজ্ব করার পাশাপাশি মানুষকে ওমরাহ করাচ্ছেন। এই লুটেরা, দুর্নীতিবাজ নিজেরাও সম্প্রতি ঘনঘন ওমরাহ করতে যায়।

অফিস আদালতে এমন ঘুষখোরদের সংখ্যা কম নয় যারা যোহর, আসর ইমামের সাথে জামাত পড়বে। মাগরিব, এশা, ফজর বাড়ির পাশে ইমামের পেছনে জামাত ত্যাগ হবে না অর্থাৎ পাক্কা নামাজি। মাসে মাসে কয়েকটি নফল রোজাও রাখে। মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি কিন্তু ঘুষ খাওয়া তার কাছে কোন ব্যাপারই না।

দেশে এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়, ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করে সন্তানদের জন্য বাড়ি, ফ্ল্যাট, ব্যবসাবাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করে। বয়স বাড়লে বা চাকুরি থেকে অবসরে গেলে তিনি নিজে আল্লাহর অলি বনে যান। মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি, নফল এবাদত, মাসে মাসে নফল রোজা, হজ্ব ও ওমরাহ করার মাধ্যমে নিজেকে নিজেকে আত্মতৃপ্তি লাভ করতেছেন।

অবাক করা ব্যাপার, ব্যাংক লুট করে দেশের সম্পদ লুট করে, ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ সম্পদ গড়ার পর যদি এর জন্য অনুশোচনাও থাকত তাহলে তার মনে কিছুটা দুশ্চিন্তা থাকত। সন্তানসন্ততির কল্যাণ চিন্তা করে সারাজীবন অপকর্ম করলাম, দালান ফ্ল্যাটের মালিক হলাম, এখন আমার কি হবে, পরকালে আমার কি উপায়। এই রকম অনুশোচনা শতকরা ৫/৭ জনেরও আছে বলে মনে হয় না।

আরও অবাক করা ব্যাপার, অফিস আদালতে বা পরিবারে কেউ যদি হালালে থাকতে চায় তার জীবনটা হয়ে যাবে খুবই কঠিন। অফিস আদালতে নিজে ঘুষ না খেলেও ঘুষখোরদের নিকট নমনীয় থাকতে হবে, ফাইল আটকানো যাবে না। তেমনিভাবে পরিবারে সমাজে হালাল থাকতে চাইলেও সমঝোতা উপেক্ষা করা কঠিন হবে। আরও অবাক করা ব্যাপার, আল্লাহর ঘর মসজিদ শতে ১/২ টি বাদে বাকী সব মসজিদ জনগণের টাকায় নির্মিত। এতে এক প্রকার নিশ্চিত বলা যাবে একালের মসজিদ হারাম টাকায় নির্মিত পুনঃনির্মিত।

ইউটিউবের মাধ্যমে জানতে পারলাম, এক ব্যক্তি ধর্মীয় বিজ্ঞজনের কাছে প্রশ্ন করেছিল, মসজিদের ইমাম ছাহেব এলাকার যে কারও ঘরে দাওয়াত দিলেই খাওয়াদাওয়া করেন, হালালহারাম চিন্তা করেন না। তার পিছনে ইক্তেদা করা যাবে কিনা। উত্তরে বলেছিলেন, ঐ ইমামের পিছনে ইক্তেদা করা যাবে না। ঐ রকম কঠোরভাবে হালালহারাম পার্থক্য করে চলা ইমাম পাওয়া কঠিন, অপরদিকে হালালহারাম পার্থক্য করে না ইমামের পিছনে ইক্তেদা না করাও কঠিন।

শতে হয়ত ২/১ জন থাকবে যারা হারাম আয় রোজগার থেকে বেঁচে থাকতে চায়। তারা কি চিন্তা করে কারও ঘরে দাওয়াত খেতে গেলে তার আয় কি রকম। তারা কি ভাবে বিয়ে, মেজবান, ওয়ালিমা খেতে গেলে ঐ লোকের আয় রোজগার হালাল কিনা।

বাস্তবতা নিরিখে আমরা এমন পরিবেশে উপনীত মানুষকে চোখ বুঝে ভাল ধারণা করার সুযোগ নেই। যা ৪০/৫০ বছর আগে ছিল। এখন ভাল কে তা কিছুটা হলেও যাচাই করে বুঝে চিন্তে এগুতে হবে।

পাকিস্তান আমল পেরিয়ে বাংলাদেশের প্রথম ১০/১২ বছর দেশে ব্যাপক ঘুষ, সুদ, দুর্নীতি হারাম রোজগারের প্রবণতা কম ছিল। হয়ত রাষ্ট্রীয়ভাবে অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান হয়ে গেছে দেশে। কিন্তু দেশের সামাজিক পরিবেশ এত খারাপ ছিল না।

১৯৮০ এর দশক থেকে বাংলাদেশে ঘুষ, দুর্নীতি শুরু হয়ে তা পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে চলে এসেছে খারাপ কে তা নয়, ভাল কে, হালাল রোজগারকারী কে তা তালাশ করতে হবে।

একালের কথা পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ পাক বলেছেন এবং হাদীস শরীফে আল্লাহর রাসূল (.) বলে গেছেন।

আনাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের মাঝে যে যুগ আসবে তার চেয়ে তার পরবর্তী যুগ হবে অধিকতর মন্দ। আর এইভাবে মন্দ হতে হতে প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের সময় এসে উপস্থিত হয়ে পড়বে। (আহমাদ, বুখারী, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামে’)

হালাল ও হারাম ইসলামী শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়। সাধারণত ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে সব বৈধ বিষয়কে হালাল ও সব অবৈধ বিষয়কে হারাম বলা হয়।

হালাল ও হারাম আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। তাই প্রত্যেক মুমিন নিঃসংকোচে তার অনুসরণ করে। কেননা সে বিশ্বাস করে, তিনি তাদের জন্য পবিত্র (ও উত্তম) বস্তু হালাল করেছেন এবং অপবিত্র (ও অনুত্তম) বস্তু হারাম করেছেন। (সূরা আরাফ, আয়াত:১৫৭)

আল্লাহর নির্ধারিত সীমা: মুমিনের জন্য হালাল ও হারাম আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এই সীমারেখা অতিক্রম করতে নিষেধ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে,‘এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা। সুতরাং তোমরা তা লঙ্গন করো না। যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করে তারাই অবিচারী।’ (সূরা বাকারা, আয়াত:২২৯)

নির্ধারণের অধিকার শুধু আল্লাহর: হালাল ও হারাম নির্ধারণের অধিকার শুধু আল্লাহর। আল্লাহ এই অধিকার আর কাউকে দেননি।

শরীয়তের পরিভাষায় বৈধ বিষয় বুঝাতে প্রধানত হালাল এবং অবৈধ বিষয় বুঝাতে হারাম শব্দ ব্যবহার করা হয়। শরীয়তের হালাল ও হারাম, বৈধ ও অবৈধ নির্ধারণের ক্ষমতা শুধু আল্লাহর। মহান আল্লাহ বলেন,‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত: ২৭৫)

হারাম উপার্জন মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। মহান আল্লাহ হারাম উপার্জনকারীদের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। (সূরা বাকারা:২৭৮২৭৯) হালালকে হালাল মনে করা এবং হারামকে হারাম মনে করা মুমিনের পরিচয়ের অংশ।

কোন হালাল বস্তু যদি সন্দেহযুক্ত হয় তাহলে তা পরিহারের সুযোগ আছে। কেননা নবী পাক (.) বলেছেন,‘ যে সন্দেহজনক জিনিস থেকে বেঁচে থাকবে সে নিজের দ্বিন ও সম্মানকে রক্ষা করবে।’ (সহীহ বুখারী)

হযরত আবু হুরায়রা (.) হতে বর্ণিত: নবী পাক (.) বলেন, এমন এক যুগ আসবে, যখন মানুষ পরোয়া করবে না যে, সে কোথা হতে সম্পদ উপার্জন করল, হালাল হতে না হারাম হতে। (সহীহ বুখারী)

আমাদের বুঝতে হবে নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত কবুল হতে হালাল রোজগার শর্ত। হারাম রোজগারে যে কোন নেক কাজ গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষ মরণশীল। ইন্তেকালের পর সাথে কিছু যাবে না। কাজেই আমরা যেন বড্ড বেকুব হয়ে সন্তানসন্ততির জন্য অবৈধ সম্পদ গড়া থেকে বিরত থাকি, অবৈধ আয়ে দালানকোঠা রেখে না যাই।

মহান পবিত্র রমজান মাস চলমান। আমাদের ভাবতে হবে আয় রোজগার হালাল কিনা, এবাদত গ্রহণযোগ্য হচ্ছে কিনা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসংগীতের সপ্ত স্বর
পরবর্তী নিবন্ধপ্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোচিং ক্লাস-প্রাইভেট পড়ানো নয়