আমাদের উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তানসহ ভারতবর্ষে দু’জন মহিয়সী নারীর হজ্ব পালন বর্তমানকালে হজ্ব ও ওমরাহকারীগণের ভাববার বিষয়। এই মহিয়সী দু’জন নারীর মধ্যে একজন হলেন মোঘল রাজকুমারী বাবরের কন্যা হুমায়ুনের সৎ বোন তথা বাশাহ আকবরের ফুপু গুলবদন বেগম। অপরজন হচ্ছেন বাংলার অপর মহীয়সী নারী নবাব ফয়জুন্নেছা। মোঘল রাজকুমারী গুলবদন বেগম হজ্ব করেন আজ থেকে প্রায় ৫ শত বছর আগে তথা ১৫৭৬ সালে। অপরদিকে নবাব ফয়জুন্নেছা হজ্ব করেন আজ থেকে ১৩০/১৩৫ বছর তথা ১৮ শ’ শতকের শেষের দিকে।
প্রথমে আসি মোঘল রাজকুমারী গুলবদনের হজ্বে গমন নিয়ে। মানবের তথা পুরুষগণের মধ্যে মায়ের পর পিতা ও মাতার দু’দিকের দু’মহিলার প্রতি অত্যধিক দুর্বলতা কাজ করে। আর তা হল পিতার বোন ফুপু ও মায়ের বোন খালা। রাজকুমারী গুলবন বেগম বাদশাহ আকবরের ফুপু। ধর্মপরায়ণ গুলবদন বেগম ভাতিজা বাদশাহ আকবরের নিকট বারে বারে আবদার রাখতে থাকেন তাকে যেন হজ্বে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এতে বাদশাহ আকবর পর্যায়ক্রমে দুর্বল হচ্ছিলেন। গুলবদন বেগম মোঘল হেরেমের রাজকুমারী। অতএব রাজকীয় ব্যবস্থায় ফুপুকে হজ্বে পাঠাতে হবে তা বাদশাহ আকবরের মনের গভীরে কাজ করছিল। ভারতবর্ষে তথা বঙ্গোপসাগর, আরবসাগর, ভারত মহাসাগর এই অঞ্চলে শীতকালে সাগর উত্তাল থাকে না। এই সময় সাগরপথে হজ্বে গমন করা অনেকটা সুবিধাজনক।
মোঘল বংশের শাহসুজা পালিয়ে যখন আরাকানে চলে যান, তখন হয়ত শীতকাল ছিল না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আরাকানে কয়েক মাস অপেক্ষায় থেকে শীতকালে সাগরের উত্তাল কমে আসলে তিনি আরাকান হতে পবিত্র মক্কায় চলে যাবেন বলে ইচ্ছা পোষণ করেন। তেমনিভাবে ১৫৭৬ সালে গুলবদন বেগম হজ্বে গিয়েছিলেন শীতের আগে আগে তথা শরতের শেষে অক্টোবর মাসে। সুরাট বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করেন। বাংলায় ৬ ঋতু। তৎমধ্যে বর্ষার পরে শরৎ। বর্তমানকালে যে আবহাওয়া অসামসঞ্জ্য অপ্রকৃতিস্থ পরিলক্ষিত হচ্ছে তা মাত্র ৪০/৫০ বছর আগেও ছিল না। যেমনটা বছরে ছিল ঋতু তেমনটা স্বাভাবিক থাকত আবহাওয়া। মুম্বাই এর আগে আরব সাগরের আরও উত্তরে ব্যবহৃত হত সুরাট বন্দর। আমাদের এই অঞ্চলের মত আরবের ঐ অঞ্চলেও জলদস্যু হিসেবে ব্যাপক দুর্নাম ছিল বর্তমানকালে ইউরোপে সভ্য হিসেবে পরিচিত লাভ করা পুর্তগীজরা। অর্থাৎ ভারতবর্ষ থেকে পবিত্র মক্কায় যেতে স্থলপথেও যেমন নিরাপদ ছিল না, তেমনি সাগরপথও নিরাপদ নয়। অতএব সুরাট বন্দরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হয় গুলবদন বেগমের কাফেলাকে পুর্তগীজ জলদস্যুদের ব্যাপারে খবরাখবর নিতে।
ভাতিজা বাদশাহ আকবর নির্মিত গ্রান্ড মোঘল জাহাজ সালিমি ও ইলাহি দু’টি জাহাজ ব্যবহার করে ফুফু হজ্বে গমন করেন। তখন গুলবন বেগমের বয়স ছিল ৫৩ বছর। রাজ পরিবারের ১১ জন নারীসহ আগ্রার ফতেহপুর সিক্রি থেকে হজ্বের যাত্রা শুরু করেন। বাদশাহ আকবর ফুফুর পুণ্যময় সফরের সম্মান দেখাতে গিয়ে প্রায় ২ শত কি.মি এগিয়ে দেন। তার এই রাজকীয় পুণ্যময় সফরে তাদের সাথে ফুফুকে দেন স্বর্ণ খচিত বাক্সে স্বর্ণের ও রৌপ্যের মোহর বারসহ হাজার হাজার নগদ অর্থ। এই ছাড়াও জনগণের মধ্যে বিতরণের জন্য সাথে নিয়ে যান বিশেষভাবে তৈরি করা বার হাজার পোশাক। এই সময় ফতেহপুর সিক্রিসহ এই যাত্রা দেখার জন্য অসংখ্য নারী–পুরুষ দাঁড়িয়ে ছিল।
জেদ্দায় পৌঁছে উত্তপ্ত মরুভূমি বালির উপর উটের পিঠে সফর করতে হয় পবিত্র মক্কা পৌঁছতে। অবশ্য গুলবদন বেগমের সফরের প্রধান অংশ হয় পবিত্র মক্কা পৌঁছানোর পর। কারণ তিনিসহ তার কাফেলা হেজাজে অবস্থান করেছিলেন। তবে পবিত্র মক্কা থেকে পবিত্র মদিনা যে গমন করেছিলেন তাতে ইতস্ততা থাকতে পারে না। যেহেতু তার সাথে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বাহিনী থাকবে তা নিশ্চিত।
মোঘল শাহাজাদীর দানশীলতা হেজাজের জনগণের মধ্যে নাড়া দেয়। এতে ক্ষমতাসীন ইস্তাম্বুলের তুর্কি সুলতান মুরাদকে ক্ষুদ্ধ করে তুলে। সুলতান মুরাদের ধারণা এই কাজগুলো মোঘল বাদশাহ আকবরের রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যম। ফলে সুলতান মুরাদ মোঘল নারীদের আরব ত্যাগ করতে ফরমান পাঠান। প্রতিবারই গুলবদন বেগম হেজাজ ছাড়তে অসম্মতি জানিয়ে পরপর ৪ বছর থেকে যান। এতে গুলবদন বেগম স্বভাবতই ৪ বার হজ্ব করেছেন। অতঃপর গুলবদন বেগম ১৫৮০ সালে পবিত্র মক্কা ত্যাগ করেন।
প্রকৃতই গুলবদন বেগম মোঘল ইতিহাসে অতি ধর্মপরায়ণ জ্ঞানীগুণী হিসেবে সমাদৃত ছিলেন। তিনি সম্রাট বাবরের তৃতীয় স্ত্রী দিলদার বেগমের ঘরে ১৫২৩ সালে জন্ম নেন। তার নামের অর্থ গোলাপের মত তক। দূর–দূরান্তের ভূমিতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য যখন রাজ পরিবারের পুরুষেরা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত থাকত তখন গুলবদন বেগম সম্রাটের মা, খালা, বোন, স্ত্রী ও তাদের মেয়েদের মত রাজ পরিবারে শক্তিশালী নারীদের মত বেড়ে উঠেন।
গুলবদন বেগম যে হেজাজে তথা পবিত্র মক্কায় ৪ বছর অবস্থান করেছিলেন তার বর্ণনা পাওয়া যায় না। তিনি কিভাবে ৪ বার হজ্ব পালন করলেন পবিত্র মক্কায় বাড়ি ঘর সামাজিক অবস্থা কী রকম ছিল, মসজিদুল হারাম এবং তাওয়াফের পরিবেশ কী রকম ছিল তা উল্লেখ নেই। এও উল্লেখ নেই তিনি পবিত্র মক্কা থেকে পবিত্র মদিনা কীভাবে গেলেন, কয়দিন অবস্থান করলেন, পবিত্র মদিনা বাড়ি ঘর সামাজিক অবস্থান কী রকম ছিল।
পুনঃ দিল্লি গেলে চেষ্টা করব গুলবদন বেগমের হজ্বের উপর ইংলিশ, উর্দু, ফার্সি ভাষায় কোন তথ্য পাওয়া যায় কিনা।
নওয়াব ফয়জুন্নেছা বৃহত্তর কুমিল্লার লাকসামের বাসিন্দা। ১৮৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ সরকার তাকে প্রথম বেগম উপাধি দেন। তিনি তার বেগম উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন, ফলে বাস্তবতা নিরিখে নওয়াব উপাধি দিতে বাধ্য হন। তিনি ১৮০০ সালের শেষের দিকে হজ্বে গমন করেন। এই সফর ২ বছর স্থায়ী হয়েছিল। তিনি হজ্বে গমন করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে পবিত্র মক্কায় পৌঁছে হজ্ব করতে না পেরে অপেক্ষায় থাকেন। পরবর্তী বছর হজ্ব করেন। এই পুণ্যময় সফরে ছিলেন দ্বিতীয় ও কনিষ্ঠ কন্যা এবং কন্যার স্বামী ও ৭ বছরের নাতি। নবাব ফয়জুন্নেছা ছিলেন অতীব জ্ঞানী সাহসী ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মহিলা। ‘রূপজালাল’ নামে কাব্যে আত্মজীবনী লিখে যান। এতে তিনি দাম্পত্য জীবনকে বেশি ফুটিয়ে তুলেন। হজ্বের বর্ণনাকে তেমন উল্লেখ করেননি। তিনি পবিত্র মক্কায় ২ বছর কীভাবে কাটিয়েছেন, তথাকার পরিবেশ কী রকম ছিল, কী রকম ছিল তুর্কি আমলের শেষের দিকে, মসজিদুল হারামসহ নানান পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। ৫ দিনব্যাপী হজ্ব কার্যক্রমে কীভাবে মিনা আরাফাত মুজদালেফা গমনাগমন করেছেন কাটিয়েছেন তার বর্ণনা নেই। এও উল্লেখ নেই, তিনি পবিত্র মদিনা কীভাবে গমন করলেন, অবস্থান করলেন, পবিত্র মক্কায় ফিরে আসলেন।
তুর্কি সুলতানরা প্রায় ৫ শত বছর পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনা কেন্দ্রীক হেজাজ শাসন করে গেছেন। ইস্তাম্বুল থেকে পবিত্র মক্কা কয়েক হাজার কি.মি দূরত্ব বিধায় হেজাজ যাতে তার হাত ছাড়া না হয় তার জন্য হাজার হাজার তুর্কি বাহিনী এখানকার বিভিন্ন দুর্গে মোতায়েন ছিল। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তার দিক দিয়ে তারা তেমন সুনাম অর্জন করতে পারেনি। তা ১৯১২ সালে জমিদার ওয়ায়েজ উদ্দিন মুহুরী, ১৯১৪ সালে হাটহাজারীর মাওলানা ইয়ার মুহাম্মদ, ১৯১৯ সালে বাঁশখালীর খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী এবং ১৯২০ সালে সাতক্ষীরা নলতার খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ এর হজ্বের সফরের কম বেশি বর্ণনায় এ ধারণা পাওয়া যায়। তখন তারা পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনা যাওয়া–আসাকালে নিরাপত্তার অভাব উল্লেখ পাওয়া যায়। অবশ্য ঐ সময় তুর্কি সাম্রাজ্যের নাজুক অবস্থা ছিল।
নওয়াব ফয়জুন্নেছা তার রচিত ‘রূপজালাল’ আত্মজীবনী গ্রন্থে দাম্পত্য জীবনের বিরহ ব্যথাকে ফুটিয়ে তুলেন। এই কুমিল্লারই বিখ্যাত আরেক জমিার পরিবারের সন্তান সম্পর্কে তাদের আত্মীয় হয়। পিতা–মাতা হারা এই জমিদার নওয়াব ফয়জুন্নেছার বাড়িতে যাওয়া–আসা করেন। এতে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। নওয়াব ফয়জুন্নেছার বয়স কম বিধায় পিতা–মাতা রাজি হয়নি। ফলে এই জমিদার আত্মীয় ত্রিপুরার বিখ্যাত এক আইনজীবীর মেয়েকে বিয়ে করেন। কিন্তু কোনো সন্তান হচ্ছিল না। এই দিকে নওয়াব ফয়জুন্নেছা বড় হন কিন্তু পিতা ইন্তেকাল করেন। ভাইদের তেমন যোগ্যতা নেই মা জমিদারী এস্টেট পরিচালনায় প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছিলেন।
নওয়াব ফয়জুন্নেচ্ছা ২ কন্যার মা ছিলেন। প্রথম কন্যাকে স্বামীর ঘরে রেখে দ্বিতীয় তথা কনিষ্ঠ কন্যাকে সাথে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসেন। বাপের বিশাল জমিদারী এস্টেটের হাল ধরেন। অতি যোগ্যতার প্রমাণ দেন। হজ্ব করে ১৯০৩ সালে ইন্তেকাল করেন। জমিদার বাড়ি মোঘল স্টাইলে তিন গম্বুজ মসজিদের ক্ষিণ পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মুসাফিরখানা, মক্তব, প্রতিষ্ঠা করেন। নির্মাণ করেন রাস্তা ব্রীজ। জনগণ পানি খাওয়ার জন্য খনন করে দেন পুকুর, দিঘি। মোঘল রাজকুমারী গুলবদন এর নাম আমাদের দেশে প্রচলন না থাকলেও বাংলার মহীয়সী নারী নবাব ফয়জুন্নেছার নাম সচেতন নাগরিকগণের কাছে পরিচিতি রয়েছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।