প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৭:১৪ পূর্বাহ্ণ

মসজিদে নববী থেকে ২০ কি.মি বা কম বেশি দূরত্বে পবিত্র মদিনা বিমান বন্দর। বিমান বন্দর মসজিদে আজান হয় মসজিদে নববীর। বিষয়টি ২ বছর আগে পবিত্র মদিনা ট্রেন স্টেশনেও অনুভব করেছিলাম। কিন্তু ইতস্তত ছিল।

গত ১১ ডিসেম্বর বুধবার দিবাগত রাত বাংলাদেশ বিমানে পবিত্র মদিনা থেকে আমার ঢাকার ফ্লাইট। মসজিদে নববীতে আছরের জামাত পড়ে হোটেলের সম্মুখ থেকে টেক্সি নিয়ে বিমান বন্দর চলে আসি। বিমান বন্দরে লাগেজসহ ট্রলি নিয়ে অপেক্ষায় আছি। মাগরিবের পর বাংলাদেশ বিমানের চেকইন কাউন্টার খুলবে। কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি এবং অপেক্ষার পর বিমান বন্দরের অভ্যন্তরে মাগরিবের আজান শুনতে পাচ্ছিলাম মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে। আমাদের দেশেও বিমান বন্দরের টার্মিনালে নামাজের টাইমে আজানের ট্যাপ রেকর্ড বাজানো হয়। যেমনটা দেশে ট্রেনসহ অন্যান্য স্থানেও।

পবিত্র মদিনা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সামনে যাত্রীদের গাড়ি ঢুকার রাস্তা। রাস্তা সংলগ্ন অপরপাশে একতলা বিশিষ্ট মসজিদ। ওযু আছে, তাড়াহুড়ো না করে মসজিদের দিকে গেলাম। মসজিদে আজান হবে এ প্রতীক্ষায় আছি। খেজুর গাছের ডালের আদলে প্রায় ৭০/৮০ ফুট উচ্চতায় মসজিদের মিনারটি দেখতেছিলাম। ২/১ মিনিটের ব্যবধানে মসজিদের দরজার দিকে গেলাম। দেখি একামত হচ্ছে। মসজিদের ভিতর গিয়ে জামাতে শরীক হই।

এতে আমার কৌতূহল জাগে। এটা বিমান বন্দরের পূর্ণাঙ্গ মসজিদ, কিন্তু আজান হল না। তখন মাগরিবের জামাত পড়ে টার্মিনালের ভিতরে এসে এক কাউন্টারে সৌদি কর্মকর্তা থেকে জানতে চাইলাম আজানের বিষয়ে। তিনি বললেন মসজিদে নববীর আজান এই বিমান বন্দর মসজিদে সরাসরি রিলে করা হয়। আলাদাভাবে আজান দেয়া হয় না। শুধুমাত্র একামত দিয়ে জামাত পড়া হয়। লেখালেখির জগতে আছি, ভালোভাবে না জেনে কলম ধরা কঠিন।

কাজেই আরও যাচাই করার জন্য একতলা বিশিষ্ট বিশাল বিমান বন্দর টার্মিনালে প্রশাসনিক অফিসে গেলাম। বিলাস বহুল এই অফিসে একজন মাত্র সৌদি কর্মকর্তা দেওয়ালের তাকে কী যেন দেখতেছেন। আমি প্রবেশ করার অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি দিলেন। কৌতূহল নিয়ে আমার আগমন বুঝতে চাইলেন। বললাম আমি একজন লেখক, বাংলাদেশের সংবাদপত্রে লেখালেখি করি। বিমান বন্দর মসজিদে আজান হয় না, মসজিদে নববী থেকে নাকি সরাসরি রিলে হয়। বিষয়টি সত্য কিনা জানতে চাইলাম। তখন তিনি অফিসের বাইরে আসলেন আমাকে সাথে নিয়ে। মনে হয় তিনি বিমান বন্দরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাকে বাইরে এসে দাঁড়াতে দেখে বিমান বন্দরে কর্মরত প্রবাসীরা একটু ইতস্তত হয়। স্যুট টাই পড়া একজন প্রবাসীকে ইশারায় ডাকলেন এবং আমার সাথে আলাপ করতে বললেন। তিনি উর্দু ভাষায় আমার থেকে জানতে চাইলেন, আমি উর্দু ভাষায় আজান বিষয়টি নিশ্চিত হতে চাইলাম। তিনি নিজ থেকে উত্তর দিয়ে দিলেন যে, এখানে মসজিদে নববীর আজান হয়। তবে তা ট্যাপ বাজানো, নাকি সরাসরি রিলে এই ব্যাপারে ইতস্ততায় প্রবাসী।

বস্তুতঃ পবিত্র মদিনা নবী পাক (.)’র প্রিয় শহর। এই মদিনা শরীফকে নানাভাবে সাজিয়ে তুলতে সৌদিরা কর্ম তৎপর। নানান প্রযুক্তি এখানে সংযোজন করা হচ্ছে। আবার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে তারা এমন এমন কিছু সিদ্ধান্ত দিচ্ছে যে, আমরা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যাই। যেমনটা নিরাপত্তা বা একাধিক কারণে মসজিদুল হারামে ইমাম ৫ ওয়াক্ত নামাজের ইমামতি করছে মাতাফে লাখের কম বেশি নরনারীকে সামনে রেখে। অর্থাৎ ইমাম মসজিদুল হারামের সামনের দিকে থেকে ইমামতি করেন। তেমনিভাবে সাম্প্রতিককালে মসজিদে নববীতেও ইমামের আগে এসে ৫ ওয়াক্ত জামাতে ইক্তেদা করছে হাজার নরনারী।

গত প্রায় দেড় দুই বছর আগে এহরাম পরিধান করে ওমরাহ এর নিয়তে ট্রেনে পবিত্র মদিনা থেকে পবিত্র মক্কা যাচ্ছিলাম। ট্রেন স্টেশনের ভিতরে নামাজের ব্যবস্থা আছে। ট্রেন স্টেশনের ভিতরে মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজান শুনতে পাচ্ছিলাম যোহরের। ট্রেন স্টেশনটি করা হয়েছে হুদুদে হারামের মাত্র ৩/৪ শত মিটার বাইরে। অতঃপর একামত দিয়ে জামাত হয়। পৃথক আজান হতে দেখলাম না। হয়ত এখানে পূর্ণাঙ্গ মসজিদ নয় বিধায় পৃথক আজান দেয়া হল না আমার কাছে এমন ধারণাই জন্মে ছিল। কিন্তু গত ১১ ডিসেম্বর পবিত্র মদিনা বিমান বন্দর পূর্ণাঙ্গ মসজিদে আজানের বিষয়টি আমাকে অবাক করে তুলে।

হজ্ব ও ওমরাহ উপলক্ষে আমার যাওয়াআসাকালে এই বিমান বন্দর ৩ কি ৪ বার ব্যবহার করা হয়। তখন বিমান বন্দরে সময় দিয়ে চারদিকে খেয়াল করার সুযোগ হয়নি।

বিশাল আন্তর্জাতিক টার্মিনাল ভবনটি খুবই সুন্দর পরিকল্পিত। বামপাশে আভ্যন্তরীণ আসাযাওয়া ডানপাশে আন্তর্জাতিক আসাযাওয়া। ৫/৬ টি চেকইন এর বিশাল বিশাল ব্লক রয়েছে। এই বিশাল টার্মিনাল ভবনের ডানপাশে হজ্ব টার্মিনাল সংযোজন করা হয়। হজ্ব টার্মিনালও সুন্দর পরিকল্পিত। প্রত্যেকটা জায়গায় রওজা পাক মসজিদে নববীর প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ছবি শোভা পাচ্ছিল। বিমান বন্দরটি হুদুদে হারাম থেকে ৮/১০ কি.মি বাইরে। আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর বিধায় এখানে অমুসলিমরাও যাওয়া আসা করবে যেমনি যাত্রী তেমনি বিমানের ক্রুরা। কাজেই বিমান বন্দরের আশপাশে স্টারমানের হোটেলসহ নানান সুযোগ সুবিধায় ভরপুর।

১৯৪০ এর দশকের শেষের দিকে রিয়াদ জেদ্দার পর পর দাম্মাম ও পবিত্র মদিনা বিমান বন্দরের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৫০ সালে এই বিমান বন্দরে জেদ্দা থেকে যেয়ারতের উদ্দেশ্যে হজ্বযাত্রী আসার প্রমাণ রয়েছে। ২০/৩০ বছর আগেও এই বিমান বন্দরকে ছোট কলেবরে বলে অনুভব করে আসছিলাম। কিন্তু বিগত ১০/১৫ বছরের ব্যবধানে এই বিমান বন্দরকে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে নতুনভাবে সাজানো হয়।

সৌদি কর্তৃপক্ষও চাচ্ছে হজ্ব ও ওমরাহকারীরা জেদ্দা অবতরণ করলে পবিত্র মদিনায় যেয়ারতে এসে এখানকার বিমান বন্দর দিয়ে বের হয়ে যাবে। অথবা পবিত্র মদিনা বিমান বন্দরে অবতরণ করবে। যেয়ারতের পর পবিত্র মক্কা গমন করবে। হজ্ব বা ওমরাহ এর কাজ সমাধা করে জেদ্দা বিমান বন্দর হয়ে নিজ দেশে বা স্বস্ব গন্তব্যে চলে যাবে। অর্থাৎ জেদ্দা/ পবিত্র মক্কা থেকে আগেকার মত যাওয়াআসা না হয়ে পবিত্র মদিনায় শুধুমাত্র যাওয়া বা আসা একবারই হবে।

কেন জানি বিগত ১৫/২০ বছরের ব্যবধানে সৌদি রাজ সরকার ও ধর্মীয় জগতে পবিত্র মদিনার ব্যাপারে আমূল পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করতে থাকি। স্যাটেলাইট জগত আবিষ্কার ও উন্নত হওয়ায় মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীতে পৃথক পৃথক দুটি টিভি চ্যানেলের লাইভ সম্প্রচার চলমান। এতে বিশ্বব্যাপী ২ শত কোটি মুসলমানের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও দেখার সুযোগ লাভ করছে। এতে পবিত্র কাবা কেন্দ্রিক মসজিদুল হারামের সম্প্রচারে ২৪ ঘণ্টাব্যাপী পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত চলমান। অপরদিকে রওজা পাক কেন্দ্রিক মসজিদে নববীতে ২৪ ঘণ্টা ব্যাপী হাদীস শরীফ বলা হচ্ছে। টিভি স্কিনের নিচের দিকে কোরআন তেলাওয়াত ও হাদীস শরীফের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ দেখানো হচ্ছে। আশা করব আগামীতে বাংলা ভাষায়ও দেখা যাবে।

মূলতঃ আল্লাহর রাসূল (.)’র অতি প্রিয় শহর পবিত্র মদিনাকে সৌদিরা অকল্পনীয় অসাধারণ গুরুত্ব দিচ্ছে। রওজা পাক কেন্দ্রিক মসজিদে নববীকে ১৯৮৫ সাল থেকে বিশালভাবে দৃষ্টিনন্দনভাবে সম্প্রসারণ, পবিত্র মদিনা শহরকে নতুনভাবে সাজানো, পবিত্র মক্কাপবিত্র মদিনা হারামাইন এক্সপ্রেস তথা বুলেট ট্রেন চালু, পবিত্র মদিনা বিমান বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা, এই বিমান বন্দরে হজ্ব টার্মিনাল তথা যেয়ারতের টার্মিনাল সংযোজন করা, রওজা পাক মসজিদে নববীতে পৃথক লাইভ চ্যানেল যুক্ত করে হাদীস শরীফ প্রচার করতে থাকা, মসজিদে নববীকে সুন্দর পরিচ্ছন্নভাবে পরিচালিত করা, রিয়াজুল জান্নাতে ২৪ ঘণ্টা ব্যাপী নারীপুরুষ শৃংখলার মাধ্যমে গমনাগমনের ব্যবস্থা করা, রওজা পাকে সালাম পেশ করতে তাঁর উম্মতগণকে সুশৃংখলভাবে ব্যবস্থায় আনা এসব কিছু বিগত ১৫/২০ বছরের ব্যবধানে আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। আমি আবেগে আপ্লুত।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রমিক অধিকার সংস্কার কমিশন সমীপে- শ্রম আইন সংশোধনের কিছু সুপারিশ
পরবর্তী নিবন্ধআন্দোলনে শিবিরের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে কার্যকর : সারজিস