আল্লাহর রাসূল (স.) বলেন– ইহা এমন একটি পাহাড় যে আমাকে ভালবাসে আমিও একে ভালবাসি। এ রকমও উল্লেখ আছে, আমি উহুদকে ভালবাসি, উহুদ আমাকে ভালবাসে। পবিত্র মদিনায় মসজিদে নববী থেকে মাত্র ৩/৪ কি.মি উত্তরে কিছুটা পূর্বে এই উহুদের পাহাড়ের অবস্থান। উহুদের যুদ্ধের কারণে মুসলমানগণের নিকট উহুদের পাহাড় পর্বত একটি প্রসিদ্ধ নাম। হজ্ব ওমরাহ বা প্রবাসী হিসেবে যারা সৌদি আরবে গমন করেছেন এদের মধ্যে একজনও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ যে উহুদের শহীদগণের যেয়ারতের উদ্দেশ্যে তথায় যাননি।
ইসলামের বিজ্ঞজন বলেন জড়, পদার্থের মধ্যে মায়া–মমতা, হিংসা–বিদ্বেষ, সৌভাগ্য–দুর্ভাগ্য বিদ্যমান। হযরত ইমাম নববী (রহ.) বলেন, হাদীস শরীফের দ্বারা আল্লাহর রাসূল (স.) এবং উহুদের পাহাড়ের মধ্যে ভালবাসা বুঝা যায় যা বাস্তব ভিত্তিক। এও উল্লেখ পাওয়া যায় উহুদ পর্বতের স্থান আখেরাতে জান্নাত হবে। হাদীস শরীফে এও উল্লেখ পাওয়া যায়, যে যাকে ভালবাসে, সে তারেই সাথে থাকবে। সুতারাং আল্লাহর রাসূল (স.) বেহেশতের সর্দার বেহেশতেই থাকবেন। উহুদ পর্বতও আল্লাহর রাসূলকে ভালবাসেন বিধায় বেহেশতেই তাঁর সাথে অবস্থান করবে।
মহান আল্লাহপাক উহুদ পর্বতের মধ্যেও ভালবাসা রেখে দিয়েছেন। যেভাবে পাহাড় এবং অপরাপর জড় পদার্থের মধ্যে আল্লাহ পাকের তসবীহ তথা পবিত্রতা বর্ণনা ও প্রশংসার করার শক্তি দান করেছেন।
এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন মাজীদে বলেন, “এমন কোন বস্তু নেই পরন্তু সবই আল্লাহপাকের প্রশংসা সহকারে তার পবিত্রতার গুণাগুণ বর্ণনা করেন।” এতে বুঝা যায় কোন পাহাড়–পর্বতের মধ্যে তার রাসূূল (স.)’র ভালবাসা নিহিত থাকে তবে এতে আশ্চর্যের কি আছে। অর্থাৎ আদিকালের সৃষ্ট মহব্বত প্রত্যেক বস্তুর নিকট নিহিত রয়েছে। যদি তা না হত তবে ফুলের উপর বুলবুল আর্তনাদ করত না।
বিজ্ঞজন আরও বলেন, নবী পাক (স.) শুধু মানুষ জিন ও ফেরেশতাদের প্রতি প্রেরিত হননি; বরং তিনি গাছপালা, পাহাড়–পর্বত ইত্যাদি সমস্ত সৃষ্ট জগতের প্রতি প্রেরিত হয়েছেন। এই কারণে তিনি উহুদ পর্বতকে সম্বোধন করে বলেছিলেন,‘হে উহুদ তুমি থেমে যাও, কেননা তোমার উপর নবী ও শহীদ আরোহণ করেছে।’ এই হাদীস শরীফ দ্বারাও প্রমাণ করে যে পাহাড়–পর্বতের মধ্যেও জ্ঞান ও বুঝ শক্তি রয়েছে। অন্যথায় তিনি উহুদ পর্বতকে এভাবে সম্বোধন করে বলতেন না।
উহুদ শব্দটি তাওয়াহহুদ থেকে নির্গত। ইহার অর্থ হচ্ছে একাকী হওয়া। অর্থটি উহুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেহেতু মদিনা মুনাওয়ারার আশপাশে অপরাপর পাহাড় থেকে বিচ্ছিন্নভাবে একাকী এ পাহাড়–পর্বতটি অবস্থান করছে। কাজেই এই পাহাড়টির নামকরণ উহুদ যথার্থই হয়েছে। যেহেতু নবী পাক (স.) আল্লাহপাকের একত্ববাদ প্রচারের কারণে এর বিশ্বাসী হওয়া তওহীদি জনতার বিরুদ্ধে কাফির মুশরিকরা এখানেই যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
বর্ণনায় এও পাওয়া যায়, উহুদ বেহেশতের পাহাড়সমূহের মধ্যে একটি পাহাড়। নবী পাক (স.) বলেন, উহুদ বেহেশতের একটি অঙ্গ বিশেষ এবং ঈর পাহাড় দোযখের একটি অংশ বিশেষ। এখানে উল্লেখ্য ৪টি পাহাড় ও ৪টি নদী বেহেশতের অন্তর্ভুক্ত। পাহাড়গুলি হল–১. বদর ২. উহুদ ৩. খন্দক ৪. হুনাইন, অপরদিকে বেহেশতের ৪টি নদী হল–১. নীল ২. ফুরাত ৩. ছাইহুন ৪. জাইহুন ।
হযরত ইবনে শাইবা হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (র.) থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত মুসা (আ.) তাঁর ভ্রাতা নবী হারুন (আ.) কে নিয়ে হজ্ব বা ওমরাহ আদায়ের জন্য মক্কা মোকাররমায় আগমন করেন। ফেরার পথে মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছে উহুদ পর্বতে গমন করেন। তখন তথায় হযরত হারুন (আ.) ইন্তেকাল হলে তাঁকে সেখানে দাফন করা হয়।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে–নবী পাক (স.) বছরের শুরুতে উহুদে তাশরীফ নিয়ে যেতেন। শহীদগণের কবরে উপস্থিত হয়ে যেয়ারত করতেন, সালাম দিতেন। উহুদের এই যুদ্ধে শাহাদত বরণকারীর সংখ্যা ৭০ জন।
উভয়পক্ষে রক্তক্ষয়ী উহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয় হিজরি ৩ সনে ৭ শাওয়াল। ইহা পবিত্র মদিনার মুসলমান, পবিত্র মক্কার বিধর্মী কুরাইশদের মধ্যে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পবিত্র মদিনায় নবী পাক (স.)’র আমলে তিনটি যুদ্ধ খুবই প্রসিদ্ধ। ১. বদরের যুদ্ধ ২. উহুদের যুদ্ধ ৩. খন্দকের যুদ্ধ।
উহুদ পাহাড়টি দৈর্ঘ্যে ৭.৫ কি.মি উচ্চতায় ১ কি.মি থেকে কিছু বেশি।
১৯৭০ এর দশকে হজ্বের সাথে যেয়ারতের উদ্দেশ্যে পবিত্র মদিনা গমন করলে বয়স ও আগ্রহ দুইটার সমন্বয় থাকায় এখানে উহুদের পাহাড়ে উঠা হয়েছিল। নবী পাক (স.) যেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন তাও দেখার সুযোগ হয়। পাহাড়ের মধ্যখানে ঝিরিপথ দিয়ে খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (পরবর্তীতে সাহাবা) তার বাহিনী নিয়ে পেছন দিক থেকে মুসলমানগণের উপর আক্রমণ চালায়। এতে জয়ের পথে মুসলমানগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমারও ঐদিকে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল।
পবিত্র মদিনায় অনেক যেয়ারতগাহ রয়েছে। তৎমধ্যে বিশেষ করে বর্তমানকালে চারটি প্রসিদ্ধ যেয়ারতগাহ হজ্ব ও ওমরাহ কারীগণ যেয়ে থাকেন। যথা– মসজিদে কুবা, মসজিদে কিবলাতাইন, খন্দকের যুদ্ধের স্থান এবং উহুদের শহীদগণের যেয়ারত। বীরে ওসমান তথা হযরত ওসমান (র.) কূপ, বীরে আলী তথা হযরত আলী (র.)’র কূপ, সালমান ফার্সির বাগান, খাকে শেফা (শেফার মাটি) স্থানসহ অপরাপর যেয়ারতের স্থানসমূহে বিগত ৪০/৪৫ বছর যাবৎ গমনাগমন বন্ধ রয়েছে। জানি না অপরাপর যেয়ারতগাহ এর অস্তিত্ব রয়েছে কিনা। উহুদের পাহাড় পর্বতের পাদদেশে সমতল ভূমিতে আল্লাহর রাসূলের চাচা হযরত হামজা (র.) সহ শহীদগণ শায়িত। যেয়ারতকারীগণ এখানেই এসে থাকেন। কিছুটা দূরত্বে উহুদ পাহাড়ে অনেক বাড়ি ঘর নির্মিত হয়েছে। ঐদিকে হজ্ব ও ওমরাহকারীগণের একালে গমন করার অবস্থা আছে বলে মনে হয় না।
উহুদ যেমনি বরকতময় বেহেশতের পাহাড় তেমনি নবী পাক (স.) এই পাহাড়কে ভালবাসতেন। এখানেই কাফেরদের সাথে মুসলমানদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
অতএব উহুদ পাহাড় এবং মহান শহীদগণের কবরস্থানসহ ২/৩ কি.মি এরিয়া নিয়ে ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত এ এরিয়া সংরক্ষণ করলে অসুবিধা কি ছিল বুঝে আসে না। উম্মতে মোহাম্মদীগণ এখানে আসত, ইসলাম প্রতিষ্ঠায় নবী পাক (স.)’র সাথে মহান সাহাবাগণের ত্যাগ তিতিক্ষা অনুধাবন করত, উহুদ পাহাড় ঘুরে ফিরে দেখত। জ্ঞানার্জন করা, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া শিরক বিদআত এর কি থাকতে পারে! হজ্ব ওমরাহসহ যতবারই পবিত্র মদিনায় আসা হয় সমভূমিতে ঘেরা দেয়া স্থানে কিছুক্ষণ সময় দিয়ে শহীদগণের যেয়ারত করা হচ্ছে মাত্র। সেই ১৯৭০ এর দশকের এই উহুদ পাহাড়ের খোলামেলা পরিবেশ এখন আর নেই বললেই চলে।
মদিনা মুনাওয়ারায় নবী পাক (স.)’র ১০ বছরের নব্যুওয়াত জিন্দেগীতে অনেক বরকতময় স্থান রয়েছে। লাখ লাখ হজ্ব, ওমরাহকারী মদিনা মুনাওয়ারায় ৮ দিন অবস্থান করে থাকেন। এই সব অনেক বরকতময় স্মৃতি চিহ্নগুলো সাজিয়ে রাখলে উম্মতে মুহাম্মদী তথা লাখ লাখ যেয়ারতকারী জ্ঞানার্জন করতে পারতেন। জ্ঞানার্জনে কোন সীমারেখা নেই। সৌদি কর্তৃপক্ষ শিরক বিদআতের নামে এই ইতিহাস ঐতিহ্যের স্থানগুলোকে বিলুপ্তি করে মনে হয় অনুতপ্ত।
মসজিদে নববীর দক্ষিণ পাশে দুইটি মিউজিয়ামে প্রবেশ করে এটা অনুধাবন করতে পারি। যেহেতু ইস্তাম্বুলের তোপকাপি জাদুঘরে আসল/বাস্তব নবী পাক (স.)’র আমল এবং পরবর্তী আমলের অনেক কিছু সংরক্ষিত আছে। আর এখানে মদিনা মুনাওয়ারা মিউজিয়ামে দেখানো হচ্ছে কাল্পনিক অথবা নকল।
সৌদি যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে, ইতিহাস–ঐতিহ্যের কোন কিছু যাতে নষ্ট করা না হয়। যেহেতু নবী পাক (স.)’র ৬৩ বছর জীবন এবং খলিফা ও সাহাবাগণের জীবন পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনা কেন্দ্রিক।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট