প্রবাহ

স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৬:৫০ পূর্বাহ্ণ

আজ ২৫ সেপ্টেম্বর বহুগুণে গুণান্বিত সুফি ব্যক্তিত্ব ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ আবদুল খালেকের ৬২ তম ইন্তেকাল বার্ষিকী। তিনি ১৯৬২ সালে এই দিন তথা ২৫ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। এই গুণীজন জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৬ সালের ২০ জুলাই। তিনি উত্তর চট্টগ্রামের রাউজান সুলতানপুরের বাসিন্দা। অত্যন্ত মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক রাউজান গ্রামের স্কুল থেকে ১৯১২ সালে প্রবেশিকা পাস করেন। ১৯১৪ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে পাস করেন উচ্চ মাধ্যমিক। ১৯১৯ সালে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে স্বর্ণপদকসহ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করেন। প্রথম দিকে তিনি গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্ম জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে কিছুকাল মায়ানমার (বার্মা) ইয়াঙ্গুনে (রেঙ্গুন) অবস্থান করেন।

ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের সাথে মায়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুন, আরাকানের রাজধানী আকিয়াবের সাথে সাগরপথে জাহাজ সার্ভিস ছিল। পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রামের সাথে ইয়াঙ্গুনের নিয়মিত আকাশ যোগাযোগ তথা বিমান যোগাযোগ ছিল। ছিল চট্টগ্রামের সাথে মায়ানমার ও আরাকানের নিবিড় সম্পর্ক। মায়ানমার ও আরাকান পৃথক পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের পাশাপাশি উভয় দেশ দখলে নেয়ার পর এক দেশ হিসেবে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়। তখনকার সেই ব্রিটিশ পাকিস্তান আমলেও কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত অবস্থায় চট্টগ্রামের লাখ লাখ মানুষ মায়ানমার আরাকানে বসবাস করতেন। তৎপর থাকতেন ব্যবসাবাণিজ্য চাকুরী নিয়ে। তৎমধ্যে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক একজন বলা যেতে পারে। যদিওবা তার সময়কাল ছিল অল্প।

ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ১৯২৯ সালে পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রির প্রতিষ্ঠান কোহিনুর লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন। পরের বছর চট্টগ্রামে প্রথম বিদ্যুৎ চালিত প্রেস তথা কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫০ সালে নিজের সম্পাদনায় কোহিনুর নামে একটি সাপ্তাহিক সাময়িকী প্রকাশ করেন। ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে দৈনিক সংবাদপত্র তথা দৈনিক আজাদী সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি বস্তুনিষ্ঠ নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু করেন। এতদঞ্চলে মুদ্রণ ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা স্মরণীয়। তিনি ২০ টির অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন বলে জানা যায়।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের যোগাযোগ প্রতিকূলতা ব্রিটিশ পেরিয়ে পাকিস্তান আমলের শেষ দিক পর্যন্ত ছিল। আমার বাঁশখালী গ্রামের বাড়ীতে প্রাথমিক জীবন। ছোটবেলায় বছরে এক বা দুই বার বেড়ানোর উদ্দেশ্যে কয়েকদিনের জন্য চট্টগ্রাম শহরে আসা হত। তবে বড় হয়ে জানতে পারি দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে আব্বাজানের (আমিরুল হজ্ব খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরী) খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দৈনিক আজাদীতে আব্বাজানের লেখা ছাপানো হয়েছে কিনা জানতে পারিনি। যেহেতু তিনি ন্যূনতম হলেও সংবাদপত্রে লেখালেখি করতেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রে আব্বাজানের প্রবন্ধ দৃষ্টিগোচর হয়। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ও আমার পিতা অনেকটা সমসাময়িক। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের জন্ম ২০ জুলাই ১৮৯৬ ও আমার পিতার জন্ম ২৩ মার্চ ১৮৮৬, উভয়ের ইন্তেকাল একই বছর। আমার পিতা ইন্তেকাল করেন ১৩ এপ্রিল ১৯৬২ শুক্রবার। অপরদিকে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ইন্তেকাল করেন ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬২ সালে।

১৯৯২ সালের দিকে আব্বাজানের জীবনীগ্রন্থ রচনা করার নিমিত্তে বাঁশখালী গ্রামের বাড়ীর কাচারীতে ৫/৬ টি বড় বড় আলমিরার যাবতীয় কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করা হয়। এতে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের স্বহস্তে লিখিত অনেক চিঠি বেরিয়ে আসে। অনেকের চিঠির মধ্যে সংখ্যার দিকের দিক দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক এবং চট্টগ্রামের অঞ্চলের দিক দিয়ে আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার ও মাওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামাবাদীর। ব্রিটিশ পেরিয়ে পাকিস্তান আমলেও যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে চিঠিপত্র আদান প্রদান। ৫ পয়সার পোষ্ট কার্ড, ১০ পয়সার খাম। সেই সময় পোষ্ট অফিসের গুরুত্ব ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বড় বড় পোষ্ট অফিস ব্যাংকের ভূমিকায়ও কাজ করত। অপরদিকে সেকালের লোকজন ছিল অনেকটা ন্যায়নীতিবান, গুছালো। সংরক্ষণের নিয়মনীতিতে থাকতেন।

ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক এর আপন ভাগিনা ও জামাতা দৈনিক আজাদীর দীর্ঘদিনের সম্পাদক অধ্যাপক মুহাম্মদ খালেদ। তিনি পাকিস্তান আমলে হজ্ব করে এসে তার লেখাগ্রন্থটির মাধ্যমে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক পরিবারবর্গের সাথে পরিচয় বাড়ে। গ্রন্থটির নাম ‘সৌদি আরবে পঁয়ত্রিশ দিন’। তিনি দেশের একজন সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে পাকিস্তান আমলে হজ্ব করতে যান। হজ্বের মোবারক সফরের উপর এই গ্রন্থ রচনা করেন।

শিশুকালে দেখতাম পবিত্র আরবভূমি থেকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে আরবীয়গণ আসাযাওয়া করছেন। সেই শিশুকাল হতে পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনার প্রতি আমার আর্কষণ হৃদয়ের মধ্যে বিরাজমান থাকার সৌভাগ্য লাভ করি। দৈনিক আজাদীর নাম শুনেছি, চট্টগ্রাম শহরে আসলে হয়ত পড়া হত। কিন্তু সৌদি আরবে পঁয়ত্রিশ দিন গ্রন্থটা সংগ্রহ করতে তৎপর হই। গ্রন্থটি বার বার পড়া হয়। ১৯৮৯ সালের জানুয়ারীতে সপরিবারে গ্রামের বাড়ী থেকে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসি বসবাসের উদ্দেশ্যে। মাঝেমধ্যে দৈনিক আজাদীতে যাওয়া হয় অধ্যাপক খালেদ এর সাথে দেখা করতে। তার মাধ্যমে দৈনিক আজাদীতে মাঝেমধ্যে লেখা হয়। আব্বাজান আমাদেরকে নিয়মশৃঙ্খলা মানার অভ্যস্ত হতে মিতব্যয়ী থাকতে কঠোর শাসনের মধ্যে বড় করেছেন। আমরা যাতে বিলাসি না হই, সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত হই। আজও তা বর্তমান চলমান। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের অতি সাদামাটা জীবন আমাকে মোহিত করে; শ্রদ্ধাবোধ বাড়িয়ে দেয়। তার ইন্তেকালে জানাজায় উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়। তার ইন্তেকালের পর দৈনিক আজাদীতে অনিয়মিত লেখা বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন পর এক অনুষ্ঠানে দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক জনাব ওয়াহিদ মালেক এর সাথে সাক্ষাত হয়। আলাপে তার ফুফা অধ্যাপক খালেদের ইন্তেকাল পরবর্তী আজাদীতে পুনঃ আমার লেখা চালু করে দেন নিয়মিত হিসেবে। ফলে সেই হতে ‘প্রবাহ’ শিরোনামে সাপ্তাহিক বুধবার দৈনিক আজাদীতে লেখালেখি করে আসছি। চেষ্টা করি দেশে থাকলে লেখা চালু রাখতে।

ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের একমাত্র পুত্র জনাব এম.এ মালেক, বাকিরা কন্যা সন্তান। জনাব এম.এ মালেক ভাগ্যবান পুরুষ। অরাজনৈতিক নিরহংকারী, কিন্তু ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। ইসলামধর্ম মতে অহংকার হারাম, ব্যক্তিত্ব রক্ষা করা সুন্নত। তার সাথে দূরত্বে হালকা পাতলা যোগাযোগ দেখা সাক্ষাত হত। দৈনিক আজাদীতে অধ্যাপক খালেদের সাথে দেখা করতে গেলে এম. এ মালেকের সাথে সাক্ষাত হত। তাকে কাছে পাওয়ার সুযোগ হয় যখন তিনি নাসিরাবাদ দিচিটাগাং কোঅপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির সভাপতি ছিলেন একাধিকবার। খুলশী জাকির হোসেন রোডস্থ রোজ ভ্যালী রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া, দিচিটাগাং হাউজিং সোসাইটির নিয়ন্ত্রণে ৩য় প্রকল্প। এই রোজ ভ্যালী রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে এই রেসিডেন্সের স্বার্থে আমাকে বারে বারে কথা বলতে হয়েছিল। তিনিও এই রেসিডেন্স এবং রেসিডেন্সের মসজিদের কল্যাণে নানাভাবে অবদান রাখেন। যা এখানকার সদস্যগণের স্মরণে রয়েছে। আমাদের রোজ ভ্যালী রেসিডেন্সের সিনিয়র সহসভাপতি লায়ন্সের সাবেক গভর্নর জনাব শাহ আলম বাবুল। তার সাথে জনাব মালেকের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় তিনিও এই রেসিডেন্সের কল্যাণে জনাব এম.এ মালেককে বারে বারে যোগাযোগ করতেন।

মানুষের জীবনে বহুবিধ কার্যক্রমের শাখা প্রশাখা থাকে। তেমনিভাবে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের সাধারণ জীবনের পাশাপাশি সুফি তাসাউফের জীবন রয়েছে। তিনি কাদেরিয়া তরিকার অন্যতম সুফি দরবেশ হযরত সৈয়দ আহমদ ছিরকোটি (রহ.)’র মুরিদ। ইয়াঙ্গুনে (রেঙ্গুন) থাকা অবস্থায় এই মহান সুফি সৈয়দ আহমদ ছিরকোটি এর সাথে সাক্ষাত পান, মুরিদ হন। ইঞ্জনিয়ার সাহেবের প্রচেষ্টায় চিরকোটি হযরত চট্টগ্রাম সফরে আসেন। আন্দরকিল্লাস্থ কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসের উপরের তলায় ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের অতিথি হয়ে অবস্থান নেন। আজ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের উছিলায় হযরত সৈয়দ আহমদ ছিরকোটি (রহ.) তাঁর সুযোগ্য ছাহেবজাদা হযরত তৈয়ব শাহ (রহ.) পরবর্তীতে তারই সন্তানেরা এই অঞ্চলে বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের খেদমত আনজাম দিচ্ছেন।

মুসলমানের উন্নত চরিত্র হল ধর্ম পালনে অটল থেকে দুনিয়ায় বিচরণ করা। যেমনটা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। তিনি জীবনে ভাল চরিত্রবান আদর্শবান হিসেবে জীবনযাপন করে গেছেন বলে আজ তার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, প্রকাশনা দৈনিক আজাদীসহ তার পরিবারবর্গ সসম্মানে অবস্থান করছেন, করছেন জীবনযাপন।

এই মহান সুফি ব্যক্তিত্ব ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর এই দিনে ইন্তেকাল করেন। তারই পীর ছাহেব হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ ছিরকোটি (রহ.)’র প্রতিষ্ঠিত জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসা সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। মহান আল্লাহপাক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক (রহ.) কে পরকালে জান্নাত দান করুন। আমিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক (রহ.) এক অনুকরণীয় আদর্শ
পরবর্তী নিবন্ধপ্রযুক্তি : বইয়ের বন্ধু নাকি ঘাতক?