প্রবাহ

জাতীয় কবি কাজী নজরুলের জন্মস্থানে কিছুক্ষণ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৮:৩৪ পূর্বাহ্ণ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া। আর্থিক প্রতিকূলতায় ছিলেন, বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি। প্রতিভা বিকশিত হতে লেখাপড়া মুখ্য নয়, তার উদাহরণ কাজী নজরুল ইসলামই। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার মধ্যে একটি প্রতিভা আমাকে মোহিত করে। আর তা হলতাঁর রচিত মহান আল্লাহপাকের শানে হামদ, নবী পাক (.)’র শানে নাত। বাঙালির গত ইতিহাস ত নয়ই আগামী কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর রচিত হৃদয়গ্রাহী হামদ ও নাত কোটি কোটি বাঙালির মধ্যে আর কারও পক্ষে লিখা সম্ভব হবে কিনা বলা মুশকিল।

আমি ব্যক্তিগতভাবে হামদ ও নাত শুনার আশেক। সম্প্রতি দেশে এন্ড্রয়েড ফোন আসায় সময় সুযোগ হলে নীরবে নিভৃতে কাজী নজরুল ইসলাম রচিত হামদ, নাত শুনতে সময় দিই। বিশেষ করে সোহরাব হোসাইন ও খালেদ হোসাইনের কণ্ঠে। অবশ্য ফাঁকে ফাঁকে আরবি, ফার্সি, উর্দু হামদ ও নাত শুনা হয়। গত ২৭ আগস্ট জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৮ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মরণে আজকের এই প্রয়াস।

আমার নিয়মিত কলকাতা হয়ে ভারতে যাওয়া হয়। অবশ্য ২/১ বার ব্যতিক্রম, ঢাকা থেকে দিল্লি হয়ে যাওয়া হয়। আমাদের দেশের জন্য কলকাতা অনেকটা ভারতের প্রবেশ পথ বলা যাবে। ১৯৮০ সাল থেকে ভারতে যাওয়াআসা মূলত তরিকতের সফর বলা যাবে। যেহেতু ১৯৬০ এর দশকে ছাত্র জীবনে গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলার নিকট মুরিদ হওয়ার সৌভাগ্য হয়। আমার শ্রদ্ধাভাজন মরহুম পীর ছাহেবের তরিকতের অনেক মুরব্বি ভারতে শায়িত। সাথে সাথে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। ভারতে বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের গোন্ডায় আজমগড়ী হযরত এবং ট্রেনে আসানসোলের পথে বান্ডেল আমার যেয়ারতের দুই প্রধান জংশন। সাথে কলকাতা নগরীর মানিকতলায় ও পার্ক সার্কাস চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের নিকটে গোবরা১ কবরস্থান। এছাড়াও ফুরফুরা, দিল্লি, আজমীর, শেরহিন্দ ত আছেই। মাঝে মধ্যে ভারতের অন্যান্য স্থানে যাওয়া হয়েছিল যেয়ারতের উদ্দেশ্যে। দূরদূরান্ত একা সফর করা নিরুৎসাহিত, এক প্রকার নিষেধ বলা যাবে ধর্ম মতে; অবশ্যই মক্কা শরীফ, মদিনা শরীফ বাদে।

ভারতে গমনকালে আমার সফর সাথী ত থাকবেই। এবারে আমিসহ ৮ জন। এ সফর পশ্চিমবঙ্গ ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার প্রোগ্রাম করা হয়েছিল। ঐ সময় দেশ থেকে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ট্রেনের সিট বুক করার প্রবণতা মনে হয় চালু হয়নি। এই বারের সফরে আমার মন তাড়িত হচ্ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মস্থানটা ঘুরে আসতে। একাধিক ভাবে তথ্যের মাধ্যমে নিশ্চিত হলাম কলকাতা হাওড়া ট্রেন স্টেশন থেকে যেতে হবে বান্ডেল বর্ধমান হয়ে আসানসোল। তথা হতে টেক্সী নিয়ে যেতে হবে চুরুলিয়া। কলকাতা থেকে আসানসোলের দূরত্ব প্রায় ২ শত কি.মি।

আগেই একাধিক প্রবন্ধে উল্লেখ করা আছে ভারতের ট্রেন ব্যবস্থাপনা আমাদের দেশ থেকে অনেক অনেক এগিয়ে। জাপান, চীন, ইউরোপের সাথে তুলনায় না আসলেও এই উপমহাদেশের মধ্যে ভারতের ট্রেন ব্যবস্থাপনা অসাধারণ। ট্রেন নেটওয়ার্কের বিস্তৃতির দিক দিয়ে বিশ্বে ভারত প্রথম, অতঃপর চীন। ভারতে একই লাইনে ৫/৭ স্তর মানের ট্রেন ব্যবস্থাপনা রয়েছে যেমনি কম ভাড়ায় নিম্ন আয়ের লোকজন চড়তে পারবে, তেমনি আরামদায়ক বিলাসবহুল ট্রেনও রয়েছে। আমাদের দেশের চট্টগ্রামঢাকা রাতের তুর্ণা নিশিতার মত ভারতে ১৯৬৯ চালু করা হয় রাজধানী এক্সপ্রেস। সেই চালু হওয়া রাজধানী এক্সপ্রেস উন্নতি হচ্ছে, হচ্ছে সম্প্রসারিত। সমস্ত কোচ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সমস্ত যাত্রীকে টাইমে টাইমে খাবার সরবরাহ করা হয় ভাড়ার ভিতর। খাবারগুলো মান সম্মত, স্বাস্থ্যসম্মত, রুচিশীল। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মধ্যে শতকরা ৭০/৮০ জন ভেজেটেরিয়ান। অতএব আমাদের বাংলাদেশীদের জন্য খাবার খাওয়া সহজতর।

আমাদের ছোট পরিসরে বাংলাদেশ, অপরদিকে বিশাল ভারত। রাজধানী এক্সপ্রেসসহ দূর যাত্রার ট্রেনগুলি ৭/৮ ঘণ্টা থেকে ২৪ ঘণ্টা বা আরও কম বেশি সময়ে যাতায়াত করে। বড় বড় স্টেশনগুলোতে ট্রেনে খাবার সরবরাহ করার ব্যবস্থা রয়েছে। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে ভারতীয় ট্রেন আমাদের দেশের সোনার বাংলা, সুবর্ণ এক্সপ্রেসের মত ৩/৪ শত কি.মি থেকে ৫/৭ কি.মি মত পর্যন্ত সকালে গিয়ে রাত্রে ফিরে আসবে মত বিলাসবহুল চেয়ার কোচ চালু করে। ট্রেনের সমস্ত কোচ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। রয়েছে দুই ক্লাস; সিসি, ইসি। এই ট্রেনে ভাড়ার ভিতর টাইমে টাইমে খাবার সরবরাহ করা হয়। গত কবছরের ব্যবধানে মোদি সরকার আরও বিলাসবহুল ট্রেন সার্ভিস চালু করে, নাম দেয় বন্দে ভারত। এ ট্রেনেও ভাড়ার ভিতর খাবার দেয়া হয়। আমাদের দেশে ১৯৮০ দশকে চট্টগ্রামঢাকা কর্ণফুলী এক্সপ্রেস চেয়ার কোচে ট্রেনের পক্ষ থেকে খাবার দেয়া হত। পরবর্তীতে তা বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি চট্টগ্রামঢাকা সোনার বাংলা এক্সপ্রেসে ভাড়ার ভিতর ট্রেনের পক্ষ থেকে খাবার দেয়া হত। তাও বন্ধ হয়ে যায়। মূল কারণ দুর্নীতি, দেশপ্রেমের অভাব, দেশকে লুটপাট করে খাওয়া। অপরদিকে ভারতীয়দের রয়েছে দেশপ্রেম।

আমরা ৮ জন কলকাতা থেকে আসানসোল হয়ে চুরুলিয়া যাব। আসানসোল ২ শত কি.মি দূরত্ব কম না। ভারতের ট্রেনে আপার ক্লাসগুলোতে বিদেশীদের জন্য কিছু কিছু কোটা খালি রাখা হয়। বড় বড় শহরগুলিতে ট্যুরিস্ট কোটায় টিকেট পাওয়ার অফিস রয়েছে। তেমনি কলকাতায় রয়েছে ফেয়ারলি প্যালেস। আমরা সম্ভবত এই অফিসে গিয়ে হাওড়াআসানসোল শতাব্দী এক্সপ্রেসে টিকেট সংগ্রহ করি। ট্রেনটি আসানসোল হয়ে পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ববর্তী ঝাড়খন্ড প্রদেশের শহর রাসি (জধহপযর) পৌঁছবে।

আমরা ৮ জন অতি ভোরে হোটেল থেকে দুটি ট্রেক্সী নিয়ে হাওড়া স্টেশনে চলে যাই। ভোর ৬ টা ৫ মিনিটে ট্রেনটি ছেড়ে দিল। যথাসময়ে সকাল ৮ টা ২২ মিনিটে আসানসোল পৌঁছে যাই। এর মধ্যে ট্রেনের পক্ষ থেকে সকালের চানাস্তা সংগ্রহ করা হয়। ট্রেন স্টেশন থেকে দুটি সিএনজি নিয়ে চুরুলিয়া যাই ১৫ কি.মি কম বেশি দূরত্বে। এখানে কাজী নজরুল ইসলামের বাড়ী ঘর, মিউজিয়াম, ছোটখাটো হল ঘর সাজানো আছে। ছোট পরিসরের সাদামাটা মিউজিয়ামসহ এরিয়া ৩৪ শত মিটার জায়গায়। এলাকাটি সবুজের সমারোহ পূর্ণ নয়, হয়ত পশ্চিমবঙ্গের শেষপ্রান্তে বলে। বাড়ীর নিকটে পারিবারিক কবরস্থান। এখানে কাজী নজরুল ইসলামের স্ত্রী সন্তানসন্ততিদের কবর রয়েছে। কবরগুলাতে নাম লিখা আছে কোনটি কার। আমাদের তাড়াহুড়ো না থাকায় চুরুলিয়া বেশ কিছুক্ষণ সময় দিই। এতে স্থানীয়দের মাধ্যমে জানতে পারলাম কাজী নজরুল ইসলামের এখানে চুরুলিয়া প্রতিনিধিত্ব করতেন ভাতিজা কাজী মোজহারুল ইসলাম। তিনি একটু আগে চুরুলিয়া থেকে বর্ধমান এসেছেন কলকাতার পথে। এতে আসানসোল থেকে লোকাল ট্রেনে আমরা বর্ধমান চলে আসি। তিনি আমাদেরকে দীর্ঘক্ষণ সময় দিয়ে বর্ধমানে অনেক ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখান। তাকে নিয়ে আমরা এক রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খাই। তাকে বাংলাদেশ বিশেষ করে চট্টগ্রাম সফরের দাওয়াত দিই। অতঃপর আমরা বর্ধমান থেকে বিকেলের দিকে বান্ডেল চলে আসি। বান্ডেল আমাদের তরিকতের অন্যতম জংশন। এখানে ট্রেন স্টেশন থেকে মাত্র ১ শত মিটারের মধ্যে শায়িত রয়েছেন হযরত শাহ সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী। দীর্ঘক্ষণ যেয়ারতে সময় দেয়া হয়। এখান থেকে লোকাল ট্রেনে কলকাতা পৌঁছি গভীর রাতে। দুভার্গ্যের বিষয় আমরা চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী, নাজিরহাট, ফেনী প্রতি ঘন্টা অন্তর অন্তর লোকাল ট্রেন চালাতে পারছি না, তার মূলে দুর্নীতি দেশপ্রেমের অভাব। কিছুদিনের ব্যবধানে কাজী নজরুল ইসলামের ভাতিজা কাজী মোজহারুল ইসলাম চট্টগ্রাম আসেন। তার সৌজন্যে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়।

ঢাকা গেলে মাঝে মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের যেয়ারতে যাওয়া হয়। সেই সুযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে আছর অথবা মাগরিবের নামাজ পড়া হয়ে থাকে।

বস্তুতঃ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম । তৎমধ্যে তাঁর হামদ ও নাতগুলো আমার হৃদয়ে তাড়িত হচ্ছে বারে বারে। বিশেষ করে হামদের মধ্যে জপি তোমারী নাম, তুমি আসা পুরাও খোদা, আল্লাহ আমার করো না বিচার। নাতের মধ্যে ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ, তোরা দেখে যা আমেনা মায়ের কুলে, মুহাম্মদ নাম যতই জপি ততই মধুর লাগে, তাওহিদেরই মুর্শিদ আমার, চল রে কাবার যেয়ারতে, মসজিদেরই পাশে কবর দিও এসব কিছু নীরবে নিভৃত্তে মন থেকে শুনতে তাড়িত হই। মহান আল্লাহপাক জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে পরকালে জান্নাত দান করুন। আমিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলাম লেখক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা : বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ ও ধর্মসমন্বয়ের আহ্বান
পরবর্তী নিবন্ধগোসাইলডাঙ্গায় পুরস্কার বিতরণ ও আলোচনা সভা