দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর পিতা হাজী মুহাম্মদ দুলা মিয়া সওদাগর অতীব ধার্মিক সৎ জীবনযাপনকারী ব্যক্তিত্ব। তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের গারাংগিয়া কুতবুল আলম সুলতানুল আউলিয়া হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা আবদুল মজিদ (রহ.)’র (হযরত বড় হুজুর কেবলা) সংস্পর্শ লাভ করে ধন্য হন। ভারতের উত্তরপ্রদেশের হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী (রহ.)। ঐ প্রদেশের আজমগড় জেলার বাসিন্দা বিধায় আজমগড়ী হযরত। ১৯৫৯ সালে ইন্তেকালকালীন ৪৪ জন মহান খলিফা রেখে যান। তৎমধ্যে ১৬ জন শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চলের। তাদের মধ্যে হযরত শাহ মাওলানা আবদুস সালাম আরাকানী (রহ.) (আরাকানী হযরত)। হাজী দুলা মিয়া সওদাগর প্রথম দিকে আরাকানী হযরতের নিকট মুরিদ হন। হাজী দুলা মিয়া সওদাগরের পিতা হাজী নজু মিয়া সওদাগর। তিনিও ছিলেন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী। তৎমধ্যে স্বর্ণ ব্যবসা অন্যতম। চট্টগ্রাম মহানগরীর বকশির হাট, খাতুনগঞ্জে। বৃহত্তর পরিসরে স্বর্ণের ব্যবসা নিয়ে ছিলেন। চট্টগ্রামে প্রসিদ্ধ আরেকজন নজু মিয়া সওদাগর রয়েছেন। তিনি সাবেক পৌর প্রশাসক সিকান্দর মিয়ার দাদা ইব্রাহীম মিয়ার পিতা। এই পরিবারের রয়েছে বহুবিধ শিল্প কারখানা। মাঝির ঘাট এলাকায় রয়েছে বাড়ী ঘর। বৃহত্তর বাকলিয়ার সেই সময়কার নুর মুহাম্মদ চেয়ারম্যান বলেন, দুই নজু মিয়া সওদাগর ব্যবসা–বাণিজ্যের দিক দিয়ে খ্যাতিমান।
হাজী নজু মিয়া সওদাগরের প্রথম পুত্র হাজী দুলা মিয়া সওদাগর বকশির হাট, খাতুনগঞ্জে বড় রাস্তা সংলগ্ন প্রকাণ্ড দ্বিতল দালানের অধিকারী হন। নিচতলায় স্বর্ণের দোকান, উপরের তলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। দালানের সম্মুখভাগে বড় অক্ষরে লেখা প্রায় ৩০–৩৫ ফুট দৈর্ঘ্য “হাজী দুলা মিয়া সওদাগর” এখনও স্মৃতিতে ভাসছে। এর কিছুটা পূর্ব দিকে একই আকৃতির একই দ্বিতল দালান রয়েছে স্বর্ণ ব্যবসায়ীর। ঐ দালানের সম্মুখভাগে বড় লেখা নাম রয়েছে “হাজী দানু মিয়া সওদাগর”। তিনি সাতকানিয়া ঢেমশার অধিবাসী। তিনিও ঐ নিচতলায় স্বর্ণের দোকান উপরের তলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। পাকিস্তান আমলে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ১ শত টাকার কম। হাজী দানু মিয়া সওদাগরও গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলার মুরিদ ছিলেন।
১৯৪৪ সালে গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলা আজমগড়ী হযরত থেকে খেলাফত লাভ করেন। ঐ সময় হতে দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর তথা ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত হযরত বড় হুজুর কেবলা বৃহত্তর চট্টগ্রামে তরিকতের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। এ অঞ্চলের সকল মতাদর্শের হাতে অতীব শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর তাকওয়া পরহেজগারী, উদারতা, দুনিয়া বিমুখতা, নানান কারামত প্রকাশ পেতে থাকে। ঐ সময় বিভিন্ন মতাদর্শের মুহাদ্দিস, মুফতি, অধ্যক্ষ, মুহতামিম, খতিব, ইমাম, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, চাকুরীজীবি কর্মকর্তা–কর্মচারী অতীব আগ্রহে থাকত তাঁর ছোহবত লাভ করতে। তিনি চট্টগ্রাম মহানগরীর যে ঘরে যেতেন মানুষের ঢল নামত। যেহেতু হাজী দুলা মিয়া সওদাগর ছিলেন অতীব ধার্মিক উদারপ্রাণ। ধর্মীয়, সামাজিক কাজ, জনকল্যাণে ব্যয় করতে কার্পণ্য করতেন না।
বকশির হাট হাজী দুলা মিয়া সওদাগরের দ্বিতল বাসভবনে আরাকানী হযরত তাশরীফ রাখতেন চট্টগ্রাম শহরে আসলে। পরবর্তীতে গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলাও এ মুরিদের ঘরে তাশরীফ রাখেন।
চট্টগ্রাম মহানগরীর ঘাটফরহাদবেগস্থ কাজেম আলী লেইন খলিফাপাট্টিতে রয়েছে গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলা প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় খানকাহ। যা তাঁর পীর ছাহেবের নামকরণে ‘খানকায়ে হামেদিয়া’। চন্দনাইশের হাজী আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী হযরত বড় হুজুর কেবলার মুরিদ। তিনি এই খানকাহ এর জন্য জমি দান করেন।
১৯৬৫ সালের দিকে এই খানকাহ এর কার্যক্রম এগিয়ে যায়। চট্টগ্রাম মহানগরীতে যে কোন তরিকতের পৃথক জায়গার উপর ইহাই প্রথম খানকাহ হিসেবে প্রসিদ্ধ। এই খানকাহ এর কল্যাণে হযরত বড় হুজুর কেবলা তাঁর অতি প্রিয় স্নেহভাজন ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে দেন। তৎমধ্যে রয়েছে হাজী দুলা মিয়া সওদাগর এর নাম। এই খানকাহ এর কল্যাণে হাজী দুলা মিয়া সওদাগরের নানাবিধ অবদান স্মরণীয়।
১৯৬০ এর দশকে হাজী দুলা মিয়া সওদাগর পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় জাতিসংঘ পার্কের পশ্চিমপার্শ্বে পরিবার নিয়ে নিজস্ব দালানে চলে আসেন। তিনি স্বর্ণ ব্যবসার সাথে প্যাকেজিং ফ্যাক্টরীসহ একাধিক খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার এ দালান থেকে তিনি দৈনিক বকশির হাট খাতুনগঞ্জের স্বর্ণের দোকানে যাওয়া–আসা করতেন।
পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় অপর ফ্ল্যাটে বসবাসকারী জাকির হোসেন কন্ট্রাকটরের ২য় পুত্র হাজী নুরুল ইসলাম বলেন, আমার নানা (হাজী দুলা মিয়া সওদাগর) ছিলেন অতীব ধার্মিক। ৫ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে পড়তে সচেষ্ট থাকতেন। এমনকি ফজর ও এশারের জামাত পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার নিরিবিলি দালান থেকে ৩/৪ শত মিটার দূরত্বে অলি খাঁ মসজিদে চলে যেতেন পায়ে খড়ম (কাঠের পাদুকা/স্যান্ডেল) দিয়ে। যাওয়া–আসাকালে ভাগিনিকে দেখে যেতেন (জাকির হোসেন কন্ট্রাকটরের স্ত্রী)। হাজী নুরুল ইসলাম আরও বলেন, আমার নানা (হাজী দুলা মিয়া সওদাগর) স্বাস্থ্য সচেতন, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। মুখে দাড়ি, মাথায় সার্বক্ষণিক টুপি আল্লাহওয়ালা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ২০০০ সালের দিকে ইন্তেকালের সময় তাঁর বয়স ছিল প্রায় ৯০ বছর।
হাজী দুলা মিয়া সওদাগর ৭ পুত্র ২ কন্যার জনক। তৎমধ্যে ২য় পুত্র ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। ২৩ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসা–বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল আন্দরকিল্লার পূর্ব দিকে টেরীবাজার, বকশির হাট, খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, চাক্তাই এলাকা। কর্ণফুলী নদী কেন্দ্রীক চট্টগ্রাম শহর। কর্ণফুলী নদী থেকে চাক্তাই খাল এই এরিয়া নিয়ে প্রবাহিত। ৫/৭ বর্গ কি.মি এরিয়া নিয়ে এই এলাকাটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসা–বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। ঐ সময় আগ্রাবাদের কথা তেমন আসবে না। বাংলাদেশীদের পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানী এই এলাকায় অবস্থান নেন। চাক্তাই খালের পানি স্বচ্ছ, ওজু গোসল করা যেত। এই রকম একটি সমৃদ্ধ এলাকায় হাজী নজু মিয়া সওদাগর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। পিতার ইন্তেকাল পরবর্তী হাজী দুলা মিয়া সওদাগরের স্বর্ণের দোকান এই অঞ্চলে খুব প্রসিদ্ধ ছিল।
বস্তুতঃ ১৯৬০ এর দশকে ছাত্র জীবনে গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলার নিকট মুরিদ হবার সৌভাগ্য হয়। সেই হতে পীর ভাই হাজী দুলা মিয়া সওদাগরের আল্লাহওয়ালা ধার্মিক তরিকতে অনেক এগিয়ে বলে শুনে আসছিলাম। তিনি ছিলেন অতীব ধার্মিক, ন্যায়পরায়ণ, জনকল্যাণে নিবেদিত প্রাণ। এই জাতীয় ব্যক্তিত্বগণকে সুফি বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক।