প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধূরী | বুধবার , ১৫ মে, ২০২৪ at ৭:৩০ পূর্বাহ্ণ

আরাফাতে অবস্থানই হজ

হজ্বের তিন ফরজ। এক. এহরাম পরিধান দুই. ৯ জিলহজ্ব দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতে অবস্থান করা। তিন. ১০১২ জিলহজ্বের মধ্যে পবিত্র কাবা তাওয়াফ করা।

হজ্বের তিন ফরজ হলেও ৯ জিলহজ্ব আরাফাতে অবস্থানকে মৌলিকভাবে হজ্বের দিন বলে গণ্য করা হয়ে থাকে।

একাধিক কারণে হজ্বের ক্ষেত্রে আরাফাতের গুরুত্ব অত্যধিক। আল্লাহর রাসূল (.) নবুওয়াত জীবনে একবারই হজ্ব করেন। ১০ হিজরির এই হজ্বকে বিদায় হজ্বও বলা হয়। এখানে আল্লাহর রাসূল (.) বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ উম্মতগণের উদ্দেশ্যে উপদেশ নির্দেশ রেখে যান। যাকে বিদায় হজ্বের ভাষণ বলা হয়। সেই হতে অদ্যবধি মসজিদে নমেরায় বাদশাহ বা বাদশাহ এর প্রতিনিধি খোতবা দিবেন। সাথে সাথে এক আজান দুই একামতে কছর হিসেবে দুই রাকাত করে যোহর ও আছরের নামাজ পড়াবেন। বাবা আদম ও মা হাওয়া মতান্তরে ৩ শত বছর পর এই আরাফাতে মিলিত হন। মুজদালেফায় গিয়ে রাত্রিযাপন করেন।

আরাফাত একটি বিস্তীর্ণ প্রান্তর। ঐ প্রান্তরের প্রতিটি অংশই আরাফাত। তাই সমগ্র প্রান্তরকে বহু বচনে আরাফাত বলা হয়েছে। আরাফাত ময়দানটি মুক্ত আকাশের নিচে বালি কংকরের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আবহমানকাল হতে একটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে পরিচিত। দৃষ্টির দিগন্ত পর্যন্ত ধুসর মরুভূমি। জবলে রহমত পাহাড়কেন্দ্রিক বিশাল প্রান্তরকে আরাফাত নামে অভিহিত।

আরাফাত ময়দানের নামকরণ নিয়ে একাধিক বর্ণনা রয়েছে। যথা

. বহিস্কৃত হওয়ার পর হযরত আদম (.) ও হাওয়া (.) পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে থেকে এবং দীর্ঘ দিন পর এখানে এসে মিলিত হন ও পরস্পর ‘‘তায়ারুফ’’ বা পরিচয় লাভ করেন। এজন্য প্রান্তরটির নাম হয়েছে আরাফাত।

. হজরত আলী (.) হতে বর্ণিত যে, হজরত ইব্রাহিম (.) এর নিকট আল্লাহ তায়ালা জিব্রাইল (.) কে প্রেরণ করেন এবং তিনি তাঁেক হজ করিয়ে দেন। আরাফায় পৌঁছে তাঁকে জিজ্ঞাস করেন ‘‘আরাফ’’ আপনি চিনতে পেরেছেন কি? হজরত ইব্রাহিম (.) বলেন, আর রাফতু অর্থাৎ আমি চিনতে পেরেছি। কেননা এর পূর্বে আমি এখানে এসেছিলাম। এ জন্যই এ স্থানের নাম আরাফাহ হয়েছে। আরাফার নাম ‘‘মাশয়ারে হারাম’’ ‘‘মাশয়ারুল আকসা’’ এবং “ইলাল ’’ ও বটে। ঐ পাহাড় কে ও আরাফাহ বলে যার মধ্যস্থলে ‘‘জাবালুর রাহমাত’’ রয়েছে। ( মাযহারী)

. ময়দান ও দিনটির নাম আরাফা রাখার মুল কারন হলো শব্ধটির মূল অর্থ ‘‘আসসাবরু’’ অর্থাৎ সবর বা ধৈর্য্য। যখন কোন লোক ধৈর্য্যশীল ও আল্লাহ ভীরু হয়, তখন তাঁকে বলা হয় ‘‘আরেফ ব্যক্তি’’ অর্থাৎ ধৈর্য্যশীল ও আল্লাহ ভীরু ব্যক্তি। আরাফার প্রান্তরে উপস্থিত হয়েও হাজী সাহেবান অত্যন্ত ধৈর্য্য শীল নম্র, বিনয়ী ও আল্লাহর প্রতাপে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এখানে আল্লাহর ইবাদত, দোয়া ও মুনাজাত, অবস্থান জনিত দুঃখ কষ্ট ও অসুবিধা সমূহ পরম ধৈর্য্যের সাথে মোকাবেলা করেন। এ জন্য দিনটিকে আরাফা এবং প্রান্তর টিকে আরাফাত বলা হয়। আর আরাফাত শব্দটি বহুবচন ব্যবহৃত হয় এ কারনে যে, এ প্রান্তরটির সকল অংশই আরাফা। এর যে কোন অংশে অবস্থান করলেই ‘‘অকুফে আরাফাত ’’ এর হক আদায় হয়ে যায়।

. আরাফাত শব্দার্থ ‘‘আরাফ ধাতু হতে নির্গত । এর অর্থ ‘‘আত্তাইয়ের’’ সুগন্ধি। আরাফাত ময়দান খোলা মেলা, সুগন্ধিময়, সুঘ্রাণে ভরপুর। আল্লামা দাহ্‌হ্‌ক ও মুদ্দী (.)প্রমুখ বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন,এই ময়দানে হজরত জিব্রাইল (.) হজরত আদম (.) কে বলেছিলেন, আপনি আপনার ক্রুটি ও অপরাধ স্বীকার করুন এবং আপনার হজ ও যাবতীয় ইবাদত বন্দেগীর নিয়ম কানুন জেনে নিন ও চিনে রাখুন। এ কারণেই এই প্রান্তরটির নামকরণ হয়েছে আরাফাত। হজরত আলী (.) থেকে বর্ণিত যে, হজরত আদম ( .) সর্ব প্রথম মানব এবং কাবা গৃহ মানব মন্ডলীর জন্য সর্ব প্রথম গৃহ। হজরত আদম (.) ভারত বর্ষ হতে পদব্রজে কাবায় গিয়ে মতান্তরে চল্লিশ বার হজ পালন করেন।

. এই প্রান্তরটির নাম আরাফাত এই জন্য রাখা হয়েছে যে, এখানে এসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুমিন মুসলমানগন পরস্পর মিলিত ও পরিচিতি লাভ করেন এবং তাদের মধ্যে বিশ্ব ভ্রাতৃতের অবিচ্ছেদ্য সেতু বন্ধন রচিত হয়।

. আরাফা হল পরিচিত স্থান বা জানবার কেন্দ্রবিন্দু। কুফার বৈয়াকরনিকদের মতে, আরাফাতের হরকত বা স্বর চিহৃ পরিবর্তনশীল। তাঁরা বলেন অনেক জায়গার অর্থে এর ব্যবহার জায়েজ নয়। যেহেতু আরব বা আরাফাতের তাএ জবর যুক্ত করতেন, যা প্রবাদ অর্থ প্রয়োগ না হয়ে স্থান অর্থে প্রয়োগ হয়েছে। প্রবাদ অর্থ হলে তা জবর যুক্ত জায়েজ নয়। যেমন মুসলিমীন ও মুসলীমাত রুপে ব্যবহৃত হয়েছে। আরাফাতকে আরাফাত নামে অভিহিত করার পিছনে বিজ্ঞজন বিভিন্ন মতের অবতারণা করেছেন। তাদের কারো কারো অভিমত হলো যে, হজরত ইব্রাহিম (.) খলীলুল্লাহ তা অবলোকনে তাঁর কাছে সংগৃহীত বৈশিষ্ট্যসহ তা চিনতে পেরেছেন। তিনি বলেন আমি চিনতে পেরেছ্‌ি তাই এর নাম আরাফাত রেখেছি এ অভিমতটি আরাফাত ভূখন্ড অর্থের পরিবর্তে প্রয়োগ করা হয়েছে। এর স্বীয় সত্ত্বা ও চতুস্পাশ্বের ভিত্তিতে এ নাম অভিহিত হয়েছে।

আরাফার বিশেষ বৈশিষ্ট্যর দরুনই এ নাম এবং তা ব্যতীত অন্য অন্য ভূখন্ডের এ নামকরণ বিরল। ইবনে আব্বাস (🙂 বলেন, জিব্রাইল (.), ইব্রাহিম (.)কে বিভিন্ন স্থানের পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন, তন্মধ্যে বর্তমানে আরাফাত নামক স্থানটিও ছিল। উত্তরে ইব্রাহিম (.) বলেন, চিনতে পেরেছি তাই তাকে ‘‘ আরাফাত ’’ নামকরণ করা হয়েছে। যা আরাফাত ময়দানে সংঘটিত হয়েছিল।

. হযরত আলী (.) বলেছেন, যে আল্লাহ তায়ালা জিব্রাইল (.) কে ইব্রাহিম (.) এর সমীপে প্রেরণ করলেন, তিনি (তাঁর সাথে) হজ করতে শুরু করলেন, এমতাবস্থায় আরাফাত ময়দানে এসে বললেন স্থানটিকে চিনতে পেরেছি। কারন এর পূর্বেও তিনি এ স্থানে একবার এসেছিলেন এ জন্যই আরাফাত নাম রাখা হয়েছে।

বস্তুতঃ হজের তিন ফরজের মধ্যে ৯ জিলহজ্ব আরাফাতে অবস্থান অন্যতম। নবী পাক (.) ৯ জিলহজ্ব সকালে মিনা থেকে আরাফাত পৌঁছেন, গোসল করেন। বিদায় হজের খুতবা দেন। পরপর যোহর, আছর নামাজ পড়ান কছর হিসেবে। অতঃপর জবলে রহমতে দীর্ঘ ৫/৬ ঘন্টা মহান আল্লাহ পাকের এবাদতে মশগুল থাকেন। সূর্য অস্ত গেলে আরাফাত থেকে মুজদালেফায় রওনা হন।

৯ জিলহজ্বের আরাফাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এদিন এহরাম পরিহিত অবস্থায় আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হতে পারবেন আল্লাহর কাছে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা। এদিন মহান আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে অত্যধিক রহমত নাজিল করা হবে, অত্যধিক গোনাহ মাফ করা হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবীর মুক্তিযোদ্ধাদের পদায়ন প্রশংসাযোগ্য
পরবর্তী নিবন্ধআনোয়ারা থানার ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত শুরু