“যে সৌদি মালিকের বাসায় গেছিলাম সেইখানে ঘরের ম্যালা কাজ করতে হইত। কিন্তু মালিক প্রতিদিন গায়ে হাত তুলত। বাধা দিলে জানে মেরে ফেলার কথা বলত। বাসা থেকে যাতে পালাইতে না পারি সেইজন্য তালা দিয়া রাখত। চাইরবারের চেষ্টার পরে একদিন সুযোগ পাইয়া বের হয়ে যাই। পরে এম্বাসির লোকেরা দেশে পাঠাইছে। ”
উপরের এই কথাগুলো হনুফা আক্তারের (ছদ্মনাম)। হনুফা গৃহকর্মী ভিসায় সৌদি আরবে যান এবং এক পর্যায়ে দূতাবাসের সহায়তায় ফিরে আসেন। কিন্তু এই বয়ান কেবল একজন হনুফারই নয়, লক্ষ লক্ষ হনুফার কন্ঠে প্রায় একই কথা শোনা যাবে। নব্বই দশকের শুরু থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে কাজ করতে গেছেন প্রায় তের লক্ষ নারীকর্মী। যাদের আশি শতাংশেরও বেশি গিয়েছেন গৃহকর্মী হিসেবে। সেখানে গিয়ে অতিরিক্ত কাজের চাপ, শারীরিক–মানসিক নির্যাতনসহ নানা অভিযোগে কেউ কেউ ফিরে আসেন। তবু প্রতিবছর নারীকর্মীরা যাচ্ছেন। অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব থেকে ভাগ্য ফেরানোর আশায় বাধ্য হয়েই বিদেশে যান মোট সংখ্যার প্রায় সত্তুর শতাংশ নারীকর্মী। যেসব দেশে নারীকর্মীরা যান সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, লেবানন, মালয়েশিয়া, জর্ডান, ওমান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রুনেই, সাইপ্রাস, মৌরিতাস, হংকং, ইতালি, জাপান ইত্যাদি। তবে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী নারীদের বড় অংশ গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব যান। বিপুল সংখ্যক নারী বিদেশে গেলেও কোন অবস্থায় কর্মরত আছেন, বিদেশে যাওয়ার সময় প্রতিশ্রুত কাজ পাচ্ছে কি–না, শ্রম আইনের অধীনের সুবিধা পাচ্ছে কি–না, তা দেখার ব্যবস্থা নেই। নারী শ্রমিক পাঠাতে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে চুক্তির সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের স্পষ্ট উল্লেখ না থাকা, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও ভাষা না জানা এবং নিজেদের অসচেতনতার কারণে অনেক নারী শ্রমিকই চাকরির মেয়াদের আগে ফিরে আসেন। এদের বড় একটি অংশ সর্বস্ব খুইয়ে বিদেশ থেকে ফেরেন। এর মধ্যে কিছু সংখ্যক নারী শ্রমিক দেশে এসে মুখ খুললেও বাকিরা থেকে যাচ্ছেন সবার অজান্তে।
বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এসব নারীদের অভিজ্ঞতা অনেক সময়ই সুখকর হয় না বলে অভিবাসন নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে। কেননা গৃহকর্মী হিসেবে যারা যায়, বেশিরভাগ সময়ই নির্যাতনের শিকার হয়ে তাদের অনেককে দেশে ফিরে আসতে হয়। যদিও অন্য কাজের ভিসায় গিয়ে সফলভাবে দেশে ফেরার গল্পও রয়েছে নারীকর্মীদের, তবে তা সংখ্যায় এতই নগণ্য যে সেটি শতাংশের হিসাবেও ঠাঁই পাবে না! ফলে শারীরিক নির্যাতনের কারণে গৃহকর্মী হিসেবে নারী শ্রমিকদের বিদেশ যাওয়ার সংখ্যা সামপ্রতিক সময়ে কমেছে বলে জানাচ্ছেন অভিবাসন কর্তৃপক্ষ।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো’র দায়িত্বরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, “বিভিন্ন শারীরিক নির্যাতন– নিপীড়নের অভিযোগের কারণে নারীদের অভিজ্ঞতা ভালো না। তাই গৃহকর্মী হিসেবে নারীদের বিদেশ যাওয়া কমেছে। কারণ এ পেশায় নারীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে যায় না। এর প্রভাব পড়েছে পুরো সংখ্যায়। কিন্তু অন্য পেশায় প্রশিক্ষণ নিয়ে নারীরা যাচ্ছে। তাই আমরা মনে করি, নারীরা বিভিন্ন পেশায় প্রশিক্ষিত হয়ে বিদেশে যাক। দেশের বিভিন্ন জেলায় ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে, তারা সেখান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারে।’’
এদিকে অভিবাসন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সৌদিতে নারী কর্মী পাঠানোর আগে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক থাকলেও তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানা হয় না। আবার প্রশিক্ষণের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। প্রতিবছর অনেক নারী দেশে ফিরে নির্যাতন–নিপীড়নসনহ নানা অভিযোগ করছেন। এ কারণে নারীকর্মী পাঠানো কমে গেছে বলে মনে করছেন তাঁরা। দেশের বিদ্যমান অভিবাসী আইন সংশোধন হলেও নারীদের সুরক্ষার বিষয়টি তাতে আলাদা করে বলা হয়নি। বিদেশে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। এখনো নিয়মিত নির্যাতিত হচ্ছেন তারা। ভীতি থেকে নারীরা যেতে আগ্রহী হচ্ছেন না। তাই বিদেশে কর্মী পাঠানো বাড়লেও আনুপাতিক হারে নারীকর্মী পাঠানো কমছে।
যদিও অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নারীকর্মী বিদেশ যাওয়ার সংখ্যা কমেছে, এ পরিসংখ্যানে এখনই পৌঁছানো যাবে না। কারণ গত কয়েক বছরের নির্যাতনের ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে সরকার কিছু বিষয়ে কঠোর হওয়ার ফলে এটি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই প্রসঙ্গে জরুরি একটি বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের এখনই নজর দিতে হবে আর সেটি হলো, সকল নারী গৃহ শ্রমিককে শ্রম আইনের আওতায় নিয়ে আসা। এ সব গৃহ শ্রমিকদের যেন শ্রম আইনের অধীনে আনা হয়, যাতে আইনের অধীনে সুবিধাগুলো নারী শ্রমিকরা আনতে পারে। বিদেশ–বিঁভুইয়ে নারী শ্রমিকদের শ্রম অধিকার অক্ষুণ্ন রাখার জন্য এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য এ দাবি আমরা উত্থাপন করতেই পারি।