বাংলাদেশ টিকে আছে প্রবাসীদের পাঠানো ডলারে। প্রবাসীরা ডলার না পাঠালে এই দেশ বহু আগে দেউলিয়া হয়ে যেতো। তারা বিদেশ বিভূঁইয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে অর্থ পাঠান, দেশে বসে আমরা সেটি দিয়ে আরাম আয়েশ করে বাহাদুরি করি। অথচ প্রবাসীদেরকে আমরা প্রতি পদে পদে নাজেহাল ও হয়রানি করি। এনআইডি, পাসপোর্ট করা থেকে শুরু করে বিমানে আরোহন করা পর্যন্ত তারা অমানুষিক হয়রানির শিকার হয়। এরপরও জায়গা জমি বিক্রি, ধার দেনা করে তারা নিকটাত্মীয়ের মায়া ত্যাগ করে বিদেশ বিভূঁইয়ে রওয়ানা হয়। কর্মসংস্থানের জন্য যারা বিদেশ যায়, তারা দেশের কম শিক্ষিত দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। একটু কম শিক্ষিত ও কম চালাকচতুর বলে তাদেরকে শিক্ষিত মানুষেরা পদে পদে ঠকায়। তবুও তারা অবিরত ডলার পাঠিয়ে দেশের প্রাণ সঞ্চার করে চলেছেন।
তাই প্রবাসীরা যথাযথ সম্মান আশা করতে পারে, পারে অযথা হয়রানি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা। কিন্তু বিগত দিনের সরকারগুলো তাদের প্রতি সুদৃষ্টি দেয়নি। বর্তমান সরকার প্রবাসীদের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে তাদের জন্য নানান সেবা ও হয়রানি লাঘবের অঙ্গীকার করেছে। যার ফলশ্রুতিতে ঢাকা শাহ জালাল বিমানবন্দরে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য করা হয়েছে প্রবাসী লাউঞ্জ, ফ্রি টেলিফোন সেবা ও হেল্পিং হ্যান্ডসহ আরো কিছু সুবিধা।
কয়েক বছর আগে মদীনা এয়ারপোর্টে একজন ক্লিনারের সাথে কথা হয়েছিলো। ছেলেটি ছিলো ভারতের আসাম প্রদেশের। কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওখানে যেতে তার কত খরচ হয়েছে। সে বলেছিলো ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। তখন আমাদের দেশ থেকে সৌদি আরব যেতে লাগতো ৪–৫ লাখ টাকা। ভেবে দেখুন যাদের পাঠানো ডলারে দেশ টিকে আছে তাদেরকে বিদেশ যেতে ব্যয় করতে হয় তিন চার গুণ বেশি টাকা। এর বাইরে রয়েছে দালালের হয়রানি। আর এসব দালাল চক্রের সাথে জড়িত থাকে দেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী পরিষদের সদস্য পর্যন্ত। তারা প্রবাসী শ্রমিকদের পুঁজি করে লুটে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। যা পত্রিকার রিপোর্টে প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে। আর এসব দালালের দৌরাত্ম্যে বিশ্বের অনেক দেশ অতিষ্ঠ হয়ে বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি।
নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে মালয়েশিয়া, মালদ্বীপসহ অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়োগ ঠেকাতে সমপ্রতি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। গত মার্চে আসা ঘোষণা অনুযায়ী, মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে আর নতুন কোনো শ্রমিক নিচ্ছে না এবং ইতিপূর্বে অনুমোদন পাওয়া শ্রমিকেরা ৩১ মে‘র পর আর মালয়েশিয়ায় ঢুকতে পারেনি। অন্যদিকে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ভুয়া কাগজপত্র দাখিল, লোক নিয়োগে অনিয়মসহ অন্যান্য কারণে মালদ্বীপের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ স্থগিত করেছে। এই পদক্ষেপ মালদ্বীপের অবৈধ অভিবাসন রোধ এবং পরিবর্তিত শ্রমনীতির একটি অংশ। আর মালয়েশিয়ার পদক্ষেপ কর্মী নিয়োগে অনিয়ম রোধ ও সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি মূলত তাদের শ্রমনীতির পুনর্মূল্যায়ন এবং ১২তম মালয়েশিয়া প্ল্যানে নির্ধারিত বিদেশি কর্মীদের জন্য সংরক্ষিত কোটা পূরণের একটি অংশমাত্র।
এদিকে বাংলাদেশি অভিবাসীরা সরকার নির্ধারিত খরচের থেকে মাত্রাতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় ও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় বিদেশে গিয়ে নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। মালদ্বীপের পাশাপাশি মালয়েশিয়ার এ ধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য একটি নতুন শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যানুযায়ী ১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশি অভিবাসীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। তারপরও বিদেশে আমরা আমাদের শ্রমবাজার ধরে রাখতে প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হচ্ছি। এতে বিদেশে বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তি’র ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাই এই ব্যর্থতার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে আমাদের এখনই চিন্তাভাবনা করতে হবে।
এরইমধ্যে বাংলাদেশের কাজের পরিবেশ বিপজ্জনক, কষ্টসাধ্য ও অস্বাস্থ্যকর এ রকম ভ্রান্ত ধারণার কারণে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের বর্তমান ভাবমূর্তি উন্নত নয়। আমরা এখনো প্রমাণ করতে পারিনি যে আমাদের দক্ষ কর্মীদের আমরা অন্য খাতে কাজে লাগাতে পারি। এ ছাড়া বাংলাদেশের স্থানীয় শ্রমবাজার, বিশেষত তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য ভালো কর্মপরিবেশ প্রস্তুত এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের শ্রমবাজার নিয়ে কোনো ইতিবাচক প্রচার প্রচারণা চালাতে পারিনি, যা আমাদের বৈশ্বিক শ্রমবাজার ধরে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় অনেক বাংলাদেশি দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। সে দেশের সমাজে তাঁরা দারুণ প্রভাব বিস্তার করছেন। প্রশ্ন হলো বাংলাদেশি কর্মীদের দক্ষতা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা দূরীকরণে আমরা কি কখনো এই প্রবাসীদের কাজে লাগানোর চিন্তা করেছি? আমাদের সুশীল সমাজ এবং বিভিন্ন দাতা সংস্থা এই অভিবাসন খাতে স্বচ্ছতা আনতে এবং অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। তাই আমাদের সুশীল সমাজেরও উচিত এ বিষয়ে এগিয়ে আসা।
বাংলাদেশের প্রায় সবারই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার আগ্রহ থাকলেও তাঁদের জন্য চাকরির সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। অথচ বিশ্বব্যাপী দক্ষ শ্রমিকদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে বিশ্বব্যাপী উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর কারিগর হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছে। অন্যদিকে আমরা প্রযুক্তিগত বা কারিগরি শিক্ষাখাতকে উপেক্ষা করে চলছি। দেশের স্বল্প–আয়ের পরিবারেও অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু সম্মানজনক নয় এই বিবেচনায় কোনো কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানোর কথা ভাবেন না। কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং ভবিষ্যতে এ শিক্ষার বিনিময়ে সম্মানজনক ও উচ্চ বেতনের সম্ভাবনা আছে, সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য এখনো অনেকের কাছে অজানা। তাই কারিগরি শিক্ষার বিষয়ে সমাজে ভ্রান্ত ধারণা ভেঙে দিতে এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
তবে আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার প্রবাসীদের সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন মডেল, যেমন বিজনেস–টু–বিজনেস (বিটুবি), গভর্নমেন্ট–টু–গভর্নমেন্ট (জিটুজি) এবং গভর্নমেন্ট প্লাস বিজনেস–টু–বিজনেস (জি–প্লাস–বিটুবি) প্রয়োগ করছে। যদিও এসব মডেলের কোনোটিই এখন পর্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। মনে রাখতে হবে, বিদ্যমান শক্তিশালী সিন্ডিকেট, দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগী চক্রের কারণে বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকেরা একদিকে যেমন উচ্চ খরচ বহন করতে বাধ্য হচ্ছে, অন্য দিকে তাঁরা বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন। তাই এখনই সময়, সরকারকে একটি নতুন ও কার্যকর মডেল গ্রহণ করার। যা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য এবং খরচ কমানোর পাশাপাশি শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
এক্ষেত্রে ফিলিপাইনের মডেল গ্রহণ করা যেতে পারে, ফিলিপাইন বিশ্বজুড়ে তাদের প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি সফল নিয়োগব্যবস্থা চালু করেছে। তারা সরাসরি নিয়োগকর্তার সঙ্গে কাজ করে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য উপযুক্ত চাকরির ব্যবস্থা করে। এতে মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালের প্রয়োজন না হওয়ায় শ্রমিকদের খরচ কমে আসে। ফিলিপাইন সরকার তাদের শ্রমিকদের জন্য একটি অভিবাসন বীমা প্যাকেজও চালু করেছে, যা শ্রমিকদের চিকিৎসা, আইনি সহায়তাসহ প্রয়োজনীয় পুনর্বাসন সুবিধা দেয়। বাংলাদেশও এমন একটি সুরক্ষা তহবিল চালু করে শ্রমিকদের যাবতীয় সমস্যায় সরাসরি সহায়তা দিতে পারে। আশা করা যায়, সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এ ধরনের সুরক্ষা প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।