বর্তমানে প্রবাসী আয় কমছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে। আসলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ আসা কমে যাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরেই। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, চলমান ডলার সংকটকালে প্রবাস আয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে। সদ্য বিদায়ী সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাস আয় এসেছে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় (এক ডলার সমান ১০৯ টাকা ৫০ পঞ্চাশ পয়সা হিসাবে) এর পরিমাণ ১৪ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। এটি গত প্রায় সাড়ে তিন বছর বা ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স।
খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত মাসে দেশে যে প্রবাস আয় এসেছে, তা গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় প্রায় ১৩ শতাংশ কম এবং গত আগস্টের তুলনায় এই আয় প্রায় ১৬ শতাংশ কম। আর ২০২০ সালের জুলাইয়ে আসা সবচেয়ে বেশি প্রবাস আয়ের হিসাব বিবেচনায় নিলে গত মাসে আয় কমেছে ৪৮ শতাংশের বেশি। ডলার সংকটের এই সময়ে প্রবাস আয়ের এই পতনকে চলমান সংকটে বড় দুঃসংবাদ বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
একটি পত্রিকা শিরোনাম করেছে, রেমিট্যান্সে ‘দেশের সংকট সময়ে বড় ধাক্কা অর্থনীতিতে’। সেখানে বলা হয়েছে, সদ্য বিদায়ী সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসী আয়ের গড় প্রায় সাড়ে তিন বছর বা ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স। অথচ গত দুই বছরে বিদেশে নতুন করে কর্মসংস্থান হয়েছে ২০ লাখ বাংলাদেশির। প্রবাসী আয় কমার কারণ হিসাবে ধারণা করা হচ্ছে, ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের দাম বেশি পাওয়া যায়। ফলে বেশি লাভের আশায় প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। কোন কোন ব্যাংক একেবারেই রেমিট্যান্স আনতে পারেনি।
অন্য একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবাসী আয়ের রেকর্ড কমে যাওয়া আর রপ্তানি আয়ে মাসিক লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় ডলারের মজুদের ওপর চাপ আরও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে পত্রিকার এই খবরে বলা হচ্ছে, ব্যাংকিং খাত আর খোলাবাজারে ডলারের দামের পার্থক্যের কারণে খুব তাড়াতাড়ি প্রবাসী আয় বেড়ে যাওয়ারও কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর পত্রিকান্তরে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী আয় ধারাবাহিকভাবে কমেছে। সেপ্টেম্বর মাসে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে, তা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। বর্তমানে প্রবাসী আয়ের যে চিত্রটা দেখতে পাচ্ছি, তা মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। এ বিষয়ে আমরা অনেক আগেই বিভিন্ন মাধ্যমে সরকারকে আভাস দিয়েছিলাম। আমি মনে করি, প্রবাসী আয় কমার পেছনে প্রধান কারণ হলো অর্থ পাচারের প্রবণতা। সামনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। স্বাভাবিকভাবে এখন অনিশ্চয়তা অনেক বেশি থাকে। ফলে যারা বিভিন্নভাবে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছে, তাদের একটা অংশ এ সময় সেই অর্থ পাচারের চেষ্টা করছে।এর আগেও প্রতিটি নির্বাচনের সময়ে এ ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে। তবে এ বছর অনিশ্চয়তাটা একটু বেশি। ফলে পাচারের পরিমাণটাও একটু বেশিই হবে। যারা অর্থ পাচার করে, তাদের জন্য ডলারের দর কত, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেকোনো দরেই তারা রাজি থাকে। কিন্তু এর ফলে ডলারের দাম বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে প্রবাসী আয়ে। অর্থ পাচার বড় ভূমিকা রাখছে প্রবাসী আয় কমার পেছনে। অর্থাৎ যারা অর্থ পাচার করছে, তারাই প্রবাসী আয়ের ডলার নিয়ে নিচ্ছে। প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা দেশে বসে প্রবাসী আয়ের টাকা ঠিকই পাচ্ছেন। মোটামুটি ভালো দরেই তাঁরা এটা পাচ্ছেন। কিন্তু প্রবাসী আয়ের এই ডলার বাংলাদেশ সরকার পাচ্ছে না। আর এর প্রভাব পড়ছে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্ট, রিজার্ভ ও বিনিময় হারের ওপরে।
প্রবাসী আয় কমার পেছনে দ্বিতীয় যে কারণ হলো, আন্তব্যাংক ও কার্ব মার্কেটের (খোলাবাজারের) মধ্যে ডলারের দরের বড় পার্থক্য। দুই দরের মধ্যে এখনো ব্যবধান প্রায় সাত টাকার মতো। এটা অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করে। মুদ্রার বিনিময় হারের পার্থক্য আরও কমাতে পারলে প্রবাসী আয় কিছুটা বাড়তে পারে।
মোট কথা, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে পতন আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে হবে।