প্রবন্ধের আলপথ ধরে ফেরদৌস আরা আলীম

ডেইজী মউদুদ | শনিবার , ৮ জুন, ২০২৪ at ১১:০৫ পূর্বাহ্ণ

দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরেই যিনি হাঁটছেন প্রবন্ধের আলপথে, তাঁর গ্রন্থের শিরোনাম তো প্রবন্ধের আলপথেই হবে। কেবল আলপথে নয়, নগরীর রাজপথ থেকে শুরু করে ছোটবড় সড়কপথ, অলিগলিতেও রয়েছে তাঁর প্রবন্ধ নিয়ে সদর্প বিচরণ! প্রকৃতি, প্রেমবোধ, ইতিহাস, সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্য, দর্শন, সমাজচিন্তা ছাড়াও বিষয় হিসেবে ‘নারী’ তাঁর প্রবন্ধে চিত্রিত হয়েছে নানা বর্ণে, নানা গন্ধে! ডুবুরি যেমন মহাসিন্ধুতে ডুবে মণিমুক্তো তুলে নিয়ে আসেন, ঠিক তেমনি প্রবন্ধ সম্ভারকে সমৃদ্ধ করতে তিনি তাঁর প্রবন্ধকে সাজান শব্দের হীরকমালা দিয়ে। বাক্য নির্মাণ করেন পান্নাচুনি খচিত রত্ন দিয়ে। বিষয়বৈচিত্র্য আর নবনব শব্দমালার অসামান্য বৈভব আর প্রাচুর্য এক হয়ে তাঁর প্রতিটি প্রবন্ধই যেন ছড়ায় হীরক দ্যুতি। শব্দ আর বাক্যের গঠনের সাথে বিষয়ের সাবলীল আর চমৎকার উপস্থাপনায় তাঁর প্রবন্ধগুলো পাঠকের কাছে অত্যন্ত পঠনযোগ্য হয়ে ওঠে। চাষী যেমন টোপা মাথে লাঠি হাতে হাঁটেন আলপথে, তিনিও প্রবন্ধের সম্ভারে হাঁটেন শব্দের ভাঙ্গা গড়ার দোলাচলে, বাক্য বিন্যাস আর উপস্থাপনায় প্রজ্ঞা আর মেধার শাণিত এক কাস্তে হাতে নিয়ে। সেই কাস্তে বেশ ধারালো হলেও নান্দনিকতার জৌলুসে প্রবন্ধগুলো অনায়াসেই পেয়ে যায় পাঠকপ্রিয়তা।

যাঁর প্রসঙ্গে বলছি তিনি আমাদের প্রিয় লেখক ফেরদৌস আরা আলীম। তাঁর সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘প্রবন্ধের আলপথে’ সম্পর্কে দুচার লাইন লেখার দুঃসাহস করছি। ইতোপূর্বে লেখকের আরো বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখার সাথে আমার পরিচয় আশির দশক থেকে। পূর্বকোণ এর রমণীয় পাতা এবং দৈনিক আজাদীর নারী পাতায় নিয়মিত প্রকাশিত লেখা পড়তে পড়তেই তাঁকে যতটুকু না লেখক হিসাবে চিনেছি, তাঁর চেয়ে বেশি চিনেছিলাম একজন বোদ্ধাগবেষকসাহিত্যমোদি সর্বোপরি নারীদের এগিয়ে নেবার পক্ষে চিন্তক আর স্বপ্নদর্শী একজন নারী হিসাবে।

এই তো সেদিন হঠাৎ উনার ডেরায় আকস্মিক হানা দিলে তিনি নিজের হাতেই আমায় তুলে দেন ‘প্রবন্ধের আলপথে ’ গ্রন্থটি। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বারোটি প্রবন্ধ নিয়ে সাজানো হয়েছে ‘প্রবন্ধের আলপথ।’ প্রবন্ধগুলো অনেকটাই গবেষণাধর্মী। ১. নিবেদিত প্রবন্ধাবলির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ২. নজরুল: ক্রমমূল্যায়নে ভাস্বর ৩. বুলবুল স্মরণ: শতবর্ষে সঞ্জীবিত ৪.মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের কথাসাহিত্য ৫. গল্পের অদ্বৈতমল্লবর্মন. . আমাদের সাম্প্রতিক ছোটগল্পের গল্প ৭. ফ্যাসিবাদ বিরোধী কবিতা ৮. চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর ৯. যে জীবন শিল্পের, যেশিল্প জীবনের ১০. রচনাসমগ্রে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় ১১.চট্টগ্রামে নারীআন্দোলন ১২. সাময়িকপত্র সম্পাদনে বাংলা থেকে বাংলাদেশে মুসলমান নারীর পথচলা।

বারোটি প্রবন্ধই মূলতঃ বারোটি গবেষণা পত্রের সামিল। বিষয়গত দিকতো বটেই, যথোপযুক্ত তথ্য উপাত্তে ঋদ্ধ এবং লেখকের উপস্থাপনার দৃঢ়তায় প্রতিটি প্রবন্ধ রীতিমতো সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। এব্যাপারে লেখক বরাবরই সচেতন। ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি সাহিত্যআশ্রিত, অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে উপস্থাপনের ব্যাপারে সক্রিয়। পাঠক তাঁর এই প্রবন্ধ পড়ে কখনোই হাঁপিয়ে উঠবেন না, বরং গল্পের ঘটনা পরম্পরা জানার আকাঙ্ক্ষার মতোই প্রবন্ধের আলপথে তাঁর সাথে পাঠকও হাঁটবেন সমান্তরালে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ‘কালান্তর ’ প্রবন্ধ গ্রন্থটি যখন পাঠ্যকালে পরীক্ষার জন্য পড়তাম , কি যে কঠিন মনে হতো। তবে এমন একজন বিজ্ঞ শিক্ষাগুরু প্রফেসর আনিসুজ্জামান স্যার সেটি আমাদের পড়াতেন, স্যারের পড়ানোর ক্যারিশমায় গ্রন্থের প্রতিটি প্রবন্ধই যেন আমাদের কাছে সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছিল। তেমনি ফেরদৌস আরা আলীমের ‘প্রবন্ধের আলপথে’ পাঠ করতে গিয়ে পাঠককে থমকে দাঁড়াতে হবে না। বিভিন্ন মনীষীদের একনিষ্ঠ সাধনা ও কর্মকীর্তি তিনি প্রবন্ধগুলোতে চমৎকার ও সহজ করেই লিপিবদ্ধ করেন। খ্যাতিমান মানুষদের নিয়ে সাহিত্যিক ও গবেষকদের মন্তব্যকে তিনি প্রবন্ধগুলোর সাথেই উপযুক্ত যুক্তি ও বক্তব্যের সাথে সন্নিবেশিত করেন। ফলে প্রবন্ধকারের কোন বক্তব্যকে একঘেঁয়েমি বা একপেশে মনে হয় না। লেখকের মূল্যায়নের পাশপাশি বিষয়ভিত্তিক নানা লেখক ও ইতিহাসবিদদের মন্তব্যকে জুড়ে দিয়ে প্রবন্ধে তিনি সাবলীল ভাবটি আমদানি করেন। সর্বমোট বারোটি প্রবন্ধে মনীষীদের যথার্থ মূল্যায়নের পাশাপাশি তিনি আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ও প্রেক্ষাপটকে অত্যন্ত চমৎকার বর্ণনা ও অসাধারণ শব্দমালায় সাজিয়ে বিষয়গুলোকে তাৎপর্যবাহী করে তোলেন। সবগুলো প্রবন্ধ নিয়ে বিশদ আলোচনায় গেলাম না। শুধু একটি প্রবন্ধের কথা খানিকটা উল্লেখ করতে চাই। মুসলমান নারীদের সম্পাদিত সাময়িকী নিয়ে লেখা প্রবন্ধটিতে চট্টগ্রাম থেকে সম্পাদিত আরো কিছু কাগজের নাম বাদ পড়েছে। যেমন ‘লাবণ্য’ নামের একটি সাময়িকী চট্টগ্রাম থেকে বের হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। আনোয়ারা আলমও ‘অনুসূয়া ’ নামের একটি চটিপত্র বের করেছিলেন বলে মনে পড়ছে। আর আমি নিজেই ‘প্রণোদনা’ নামের একটি সাময়িকী প্রকাশ করেছিলাম। পরিশ্রমী এই প্রবন্ধটিতে এই নামগুলো অন্তর্ভুক্ত হতে পারত।

সুখপাঠ্য এই গ্রন্থটি আরও পাঠকপ্রিয়তা পাক। সর্ববৃহৎ পাঠকের দরবারে পৌঁছে যাক, এই কামনা করি। ১৫০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন আল নোমান। এটি প্রকাশ করেছে খড়িমাটি । লেখক গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন অনুজ লেখক সৈকত দেকে। ছাপা এবং বাঁধাই সুন্দর । মূল্য রাখা হয়েছে মাত্র ৩৫০ টাকা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে অনীহা, বাড়ছে প্রাণহানি
পরবর্তী নিবন্ধরুথ সিউপেদি মোতাও আফ্রিকান প্রথম নারী ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার এবং ফটোজার্নালিস্ট