(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সরকার গঠনের দেড় মাসের মাথায় জাতিসংঘ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ওই সময়ে তিনি মাত্র চার দিনের সফরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর পাশাপাশি অধিবেশনের সাইডলাইনে ৪০টি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকেও অংশ নেন।
বিগত কয়েকবছর ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের এক ধরনের দূরত্ব বিরাজ করছিল। তবে অধ্যাপক ইউনূসের ওই সফরে সেই সংকট অনেকটাই কেটে যায়। বিশেষ করে গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ কিছু ইস্যুতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সংকট অনেকটাই কাটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন অধ্যাপক ইউনূস।
জাতিসংঘ সম্মেলনের পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের’ বার্ষিক সম্মেলনে অংশ নেন অধ্যাপক ইউনূস। এই সফরে তিনি মোট ৪৭টি অনুষ্ঠানে যোগ দেন বলেও জানা যায়। সেই সফরের একটি অনুষ্ঠানের ভিডিওতে ড. ইউনূসের বক্তব্যের সময় অতিথিদের নির্বাক হয়ে গভীর মনোযোগে জুলাই অভ্যুত্থানের কথা শুনতে দেখা যায়।
আমরা লক্ষ্য করেছি, বিগত প্রায় সাত মাসে তিনি নিরলস পরিশ্রম করেছেন। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা, সংবিধান, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জনপ্রশাসন, পুলিশসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার। এরই মধ্যে ছয়টি কমিশন প্রতিবেদন দিয়েছে। সেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটা ন্যূনতম ঐকমত্য তৈরি হলে সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের পদক্ষেপ শুরু হবে। রাজনৈতিক দলগুলো আন্তরিক হলে এই সংস্কার প্রক্রিয়া দেশে ভবিষ্যতে গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। ধ্বংস প্রায় অর্থনীতি শক্তিশালী করতে অধ্যাপক ইউনূস নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন। খেলাপি ঋণের লাগাম টানা হয়েছে।
টাকা পাচার বন্ধ হয়েছে, সরকারি লুটপাট বন্ধ হয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে শুরু করে রিজার্ভেও এসবের সুফল দেখা যাচ্ছে। তৈরি হয়েছে ব্যবসা–বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা। দুর্নীতি প্রতিরোধে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন। এসব পদক্ষেপের ফল স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন। দেশের অভ্যন্তরীণ এমন পরিস্থিতির মধ্যে বহির্শক্তির তৎপরতার কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার কথাও ভাবতে হচ্ছে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে। সচেতন মহলের মতে, এক্ষেত্রে যে ধরনের প্রভাবশালী ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব দরকার, তাতে অধ্যাপক ইউনূসের বিকল্প হিসেবে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বৈশ্বিক পরিসরে কোনো বাংলাদেশির কণ্ঠস্বর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো এতো উচ্চ হবে না– যা আমরা অবগত আছি। বিদেশে অধ্যাপক ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা সব চেয়ে বেশি। স্মরণ করা যেতে পারে যে, দায়িত্ব নেয়ার আগেই গত ৬ আগস্ট তারিখে ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশ যদি অস্থিতিশীল থাকে, তা মিয়ানমার এবং সেভেন সিস্টার্সে (ভারতের উত্তর–পূর্বের সাত রাজ্য) ছড়িয়ে পড়বে। তিনি বলেন, ‘এদেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে, ফলে এটি বাংলাদেশের চারপাশে এবং মিয়ানমারে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো হবে। আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার এখন বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং যদি তা অর্জন করা না যায়, তাহলে ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে এর প্রভাব পড়বে।’ অধ্যাপক ইউনূসের ওই বক্তব্যে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায়ের ক্ষেত্রে তার কৌশলী চিন্তার বিষয়টি সামনে আসে। এবং তিনি যে একজন পরিপক্ক রাষ্ট্রনায়ক হবেন, তা বুঝা গিয়েছিলো।
অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, তাঁর ক্ষমতা ধরে রাখার ইচ্ছা নেই। বারবারই তিনি নির্বাচনের কথা বলছেন। এরইমধ্যে তিনি সম্ভাব্য সময়ও বলে দিয়েছেন। তবে নির্বাচনের আগে কিছুটা সংস্কার তিনি চান। তিনি বারবার বলেছেন, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে পাওয়া রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ হাতছাড়া হলে বাংলাদেশের আর কোনো ভবিষ্যৎ থাকবে না।
আমরা মনেকরি, গণতন্ত্র, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, সুশাসনের স্বার্থে, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য এবং ৫৩ বছরের জঞ্জাল দূর করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের স্বার্থে অধ্যাপক ইউনূসের পাশে থাকা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোর এই উপলব্ধি আসা উচিত যে, তারা পাশে থাকলে তিনি শক্ত হাতে অন্তর্র্বর্তী সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারবেন। দেশি–বিদেশি অপশক্তিও তার অগ্রগতির পথে বাধা হতে পারবে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অধ্যাপক ইউনূসের পাশে থাকলেই বাঁচবে বাংলাদেশ। রক্ষা পাবে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা। শক্তিশালী হবে অর্থনীতি। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে গণতন্ত্র এবং প্রতিষ্ঠিত হবে সুশাসন। এই সুযোগ জাতি হিসেবে সব রাজনৈতিক দল, সামরিক–বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী, তরুণ ছাত্রসমাজ থেকে শুরু করে আপামর জনসাধারণ সবাইকে কাজে লাগাতে হবে। বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, এই সুযোগ কাজে না লাগালে জাতি হিসেবে অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস কোনোদিন দুর্নীতি করেন নি, তাঁর কোনো কালো টাকা নেই, তিনি ফ্ল্যাট–প্লট নেননি। তিনি সারাজীবন গরীব মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছুটে বেড়িয়েছেন। তিনি যেমনি অসংখ্য প্রতিষ্ঠান নিজে তৈরি করেছেন, তেমনই বিদেশ থেকে বিনিয়োগ এনে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে দেশের অর্থনীতিকেও করেছেন শক্তিশালী। সৃষ্টি করেছেন কর্মসংস্থান এবং ব্যবস্থা করেছেন আত্মকর্মসংস্থানের। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘নার্সিং ইনস্টিটিউট’, ‘ডিজিটাল হেলথ প্রোগ্রাম’ ইতোমধ্যে দেশে সাড়া জাগিয়েছে। এমন একজন মানুষের হাতেই বাংলাদেশ নিরাপদ থাকবে–এমন মন্তব্য ‘অযৌক্তিক নয় বলেই’ আমরা মনে করি। এখন প্রয়োজন সম্মিলিতভাবে উনাকে সমর্থন দেয়া, পরামর্শ দেয়া, সহযোগিতা করা। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সময় পর্যন্ত প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নেবেন – এমনই প্রত্যাশা আমাদের।
লেখক: কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।