বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ও গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ছিলো– ‘বৈষম্য বিরোধী জুলাই–আগস্ট্থ ২৪’র ছাত্র–জনতার আন্দোলন তথা গণঅভ্যুত্থান। আন্দোলনের তীব্রতা বিবেচনা করে ৫ আগস্ট পরাক্রমশালী শাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর ৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্র্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পড়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাঁধে। যাত্রার শুরু থেকেই ‘চ্যালেঞ্জ বিহীন’ একটা দিনও তিনি বা তাঁর সরকার কাটাতে পারেনি। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, বিভিন্ন সেক্টরের সংস্কার ও দুর্নীতিবাজদের বিচারের পাশাপাশি দেশ–বিদেশের নানামুখী চ্যালেঞ্জ তথা বিরোধিতা মোকাবিলা করেই তাঁকে আগাতে হচ্ছে। দেশের ভিতর বিভিন্ন গোষ্ঠী–সংগঠন তাদের দীর্ঘদিনের দাবির স্তুপ নিয়ে প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাট অবরোধ করে আন্দোলন করছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মব জাস্টিসের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়েছে। পুলিশ–প্রশাসন প্রয়োজনীয় সক্রিয়তা দেখাতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন ও বিভিন্ন বিষয়ে অন্তর্র্বতী সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। অনেক ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র থেকেও পর্যাপ্ত সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ আসছে। সাথে আছে ভারতীয় মিডিয়ার ব্যাপক অপপ্রচার। আছে ভারতে পালিয়ে থাকা শেখ হাসিনার উস্কানিমূলক বক্তব্য ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার। এতোসব নানামুখী চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে বিচলিত বলে মনে হয়নি। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন বলেই আমাদের মনে হচ্ছে।
সচেতন মহল মনে করেন, দেশি–বিদেশি যে ষড়যন্ত্র গত সাত মাসে মোকাবিলা করতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়া আর কারও পক্ষে সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হতো না। অন্যকেউ থাকলে হয়তো আরও রক্তপাত হতো। এমনকি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা বিপন্ন হতে পারতো। সেসব চ্যালেঞ্জ তিনি মোকাবিলা করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। এমনকি এসব মোকাবেলায় তেমন কঠোরতাও দেখাননি।
প্রফেসর ইউনূসের অতীত আমাদের সবার জানা আছে। তিনি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয়া মানুষ। শৈশব হতেই তিনি মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। নোবেল ও পৃথিবীর সব সম্মানজনক পুরস্কারসহ শতাধিক পুরস্কার ও সম্মান অর্জনকারী এই ব্যক্তিত্ব– শেখ হাসিনার প্রতিহিংসা হতে নিকট অতীতেও বাঁচতে পারেননি। (শেখ হাসিনা মনে করতেন – রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে তিনি নোবেল পুরস্কারের দাবিদার হয়েছেন)। বয়সের দোহাই দিয়ে তাঁর নিকট হতে নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ কেড়ে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁর বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে অসংখ্য গায়েবি মামলা। ট্রাস্ট ও আয়কর আইনে ‘ইনকাম ট্যাক্স রেয়াতের’ বিধান থাকা সত্ত্বেও তাঁর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপর অন্যায় ভাবে ইনকাম ট্যাক্স ধার্য্য করা হয়েছিল। প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে শ্রম আইনের একটি হয়রানিমূলক ঠুনকো মামলায় তাঁকে ছয় মাসের সাজা দেয়া হয়েছিল, যা ছিল নজিরবিহীন। এই বয়সেও মামলার হাজিরার সময়ে লিফট বন্ধ করে তাঁকে সিড়ি বেয়ে ছয়/সাত তলায় তোলা হয়েছিল। তাঁর মতো একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বকে শেখ হাসিনা নিজে পদ্মানদীতে চুবানোর কথা বলেছেন প্রকাশ্যে। তাঁর মন্ত্রীপরিষদের অনেকে এবং মোসাহেব সাংবাদিকদের কয়েকজন নোবেল পাওয়া নিয়েও কটাক্ষ করতে দ্বিধা করেননি। এমনকি ‘রেড ওয়েন’ খেলে নোবেল পাওয়া যায় বলেও মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু এতো অপমান, এতো দুর্ব্যবহার, এতো মানসিক ও শারীরিক কষ্ট পাওয়ার পরও তিনি দেশ ও দেশের মানুষকে পরিত্যাগ করেন নি। যা ছিল দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত। অনেক চেষ্টা করেও তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক কোনো অনিয়ম আবিষ্কার করা যায়নি। সাইফুল মজিদ নামের এক হিংগ্র অধ্যাপককে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান করে প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল। যা ছিল প্রতিহিংসার জ্বলন্ত উদাহরণ। কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত সেই কালোত্তীর্ণ ব্যক্তিত্ব আমাদের সরকার প্রধান হয়েছেন। যা দেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
যা হোক, এখন আমরা এক ধরনের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি (যাকে ট্রানজিট পিরিয়ড বলা যায়)। দীর্ঘ ১৫ বছর একনায়কতন্ত্র, দলীয়করণ ও দুর্নীতি চর্চার মাধ্যমে অন্তঃসারশূন্য করে দেওয়া হয়েছে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলো। নির্বাচনকে তামাশায় পরিণত করা হয়েছে। ফলে কর্তৃত্ববাদী শাসকের পতনের পর সে সব প্রতিষ্ঠান তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ার অবস্থা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের নামে লুটপাট করা হয়েছে লাখো কোটি টাকা।
এমন দুঃসময়ে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস দেশের হাল ধরেছেন। ২০০৬ সালে নোবেলজয়ীর ক্লাবে নাম লিখানোর পরে বিশ্ব দরবারে নতুনভাবে চিনিয়েছেন বাংলাদেশকে। নোবেল পাওয়ার পর থেকেই সমগ্র বিশ্বে বড় বড় অনুষ্ঠানে অতিথি বা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আসন অলংকৃত করে আসছেন। অলিম্পিক থেকে শুরু করে বহুজাতিক অনেক অনুষ্ঠানে তিনি অতিথি হয়েছেন এবং বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছেন। অধ্যাপক ইউনূসের ‘স্যোশ্যাল বিজনেস থিওরি’ তত্ত্ব বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। বিশ্বের অসংখ্য সরকার প্রধান থেকে শুরু করে, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর রয়েছে গভীর সম্পর্ক। অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানরা বাংলাদেশকে ভিন্ন চোখে দেখতে শুরু করেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পরাশক্তি চীনসহ বিপরীতমুখী শক্তিগুলোও সরকারকে স্বাগত জানায়। ইউরোপ–আমেরিকার পাশাপাশি বৈশ্বিক সংস্থা যেমন জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও তাঁকে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনের সময় সংহতি প্রকাশ করতে গিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে দণ্ডিত ৫৭ জন বাংলাদেশিকে অতি অল্প সময়েই দেশটির প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানকে অনুরোধ করে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেন তিনি। যা দেশবাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে। অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে ২০২৪ সালের ৪ অক্টোবর পাঁচ ঘণ্টার জন্য বাংলাদেশ ঘুরে যান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম।
ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ভাটা পড়তে পারে বলে আশঙ্কা ছিল অনেকের! বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি। বরং ট্রাম্পের বিশ্বস্ত বিশ্বের সফলতম টেক উদ্যোক্তা ‘ইলন মাস্কের’ সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে বাংলাদেশে স্টারলিংকের ইন্টারনেট চালু করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এমনকি বাংলাদেশ সফরেরও সম্ভাবনা রয়েছে ইলন মাস্কের। এ ছাড়াও অধ্যাপক ইউনূসের অনুরোধে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস আগামী ১৩ মার্চ চার দিনের সফরে আসছেন বাংলাদেশে। (চলবে)
লেখক: কলামিস্ট ও সমাজকর্মী