প্রধান নির্বাহীর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ মেয়রের, বদলি চেয়ে মন্ত্রণালয়ে পত্র

যোগদানপত্র গ্রহণ করা হয়নি, অভিযোগ তদন্তে স্থানীয় সরকার বিভাগের কমিটি

মোরশেদ তালুকদার | মঙ্গলবার , ১১ নভেম্বর, ২০২৫ at ৪:৩৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের টেন্ডার ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ফাইলগুলো স্বাক্ষর না করে দীর্ঘদিন নিজ দপ্তরে আটকে রাখেন’।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করে তাকে বদলি করার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে পৃথক দুটি পত্র দিয়েছেন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। একইপত্রে প্রধান নির্বাহীর বিরুদ্ধে অফিসে বিভাজন সৃষ্টিসহ আরো কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করা হয়। এর আগে পৌরকর মূল্যায়নে অনিয়মের ঘটনায় এ কর্মকর্তাকে শোকজ করেন মেয়র। এদিকে ৪৫ দিনের উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে চসিকে যোগদান করতে আসলে তার যোগদানপত্র গ্রহণ করা হয়নি জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে পত্র দেন তৌহিদুল ইসলাম।

এ অবস্থায় মেয়র ও প্রধান নির্বাহীর দেয়া পত্রগুলোর বিষয়ে তদন্ত করার জন্য দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। গত রোববার গঠিত এ কমিটিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সুরাইয়া আখতার জাহানকে আহ্বায়ক ও উপসচিব মো. ফিরোজ মাহমুদকে সদস্য সচিব করা হয়।

এ সংক্রান্ত অফিস আদেশে স্বাক্ষর করেন কমিটির সদস্য সচিব মো. ফিরোজ মাহমুদ নিজেই। কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়, মেয়র ও প্রধান নির্বাহীর পত্রে উল্লেখিত বিষয়ে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল। তবে কবে নাগাদ প্রতিবেদন জমা দিতে হবে, তার সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি অফিস আদেশে।

কী আছে মেয়রের পত্রে : ২ নভেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে দেয়া পৃথক পত্র দুটিতে বলা হয়, সামগ্রিক প্রশাসনিক কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও গতি সুনিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামকে বদলি করা প্রয়োজন। তার দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় সর্ব পর্যায়ে চসিকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দদুক) তার দুর্নীতি বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে। এতে চসিকের সার্বিক কার্যক্রমে প্রভাব পড়ছে প্রতিনিয়ত। পত্রে শেখ শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে বলা হয়,

তিনি চট্টগ্রামের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের টেন্ডার ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ফাইলগুলো স্বাক্ষর না করে দীর্ঘদিন তার দপ্তরে আটকে রাখেন। এছাড়াও বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের তদারকি, সমস্যা নিরসনে তাকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এছাড়াও মন্ত্রণালয় হতে বিভিন্ন প্রকল্প পাশ এবং বরাদ্দ ছাড়করণে তার কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। তিনি অফিসে কর্মকর্তাকর্মচারীদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি না করে অফিসে চরম বিভাজন সৃষ্টি করেছেন। যা অফিসের দাপ্তরিক শৃঙ্খলার চরমভাবে অবনতি ঘটিয়েছে। এছাড়া ২টি হোল্ডিং এর ৫১ কোটি টাকার কর ঘষামাজা করার ঘটনায় তার দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি প্রতীয়মান হয়।

পত্রে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরের উন্নয়ন কার্যক্রম, জনসেবামূলক উদ্যোগ এবং মেয়র ও অন্যান্য সংস্থার সাথে সমন্বয় রক্ষার্থে একজন দক্ষ, উদ্ভাবনী ও প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমৃদ্ধ কর্মকর্তার প্রয়োজন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের স্থলে অন্য একজন উপযুক্ত ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিলে চসিকের কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে।

যোগদানপত্র গ্রহণ না করা প্রসঙ্গে : গত ৬ সেপ্টেম্বর একটি প্রশিক্ষণে যোগ দেন শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। প্রশিক্ষণ শেষে গত ২৩ অক্টোবর যোগ দিতে আসলে তার ‘যোগদানপত্র’ গ্রহণ করা হয়নি। এর আগে ২২ অক্টোবর একটি অফিস আদেশ জারি করেন মেয়র। এতে বলা হয়, শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম প্রশিক্ষণ শেষে ফেরত আসার পরে তার যোগদানপত্র গৃহিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সকল বিভাগীয় প্রধানগণ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সচিবের মাধ্যমে নথি অনুমোদনের জন্য মেয়র বরাবর প্রেরণ করবেন। কর্পোরেশনের কাজের স্বার্থে এই আদেশ জারি করা হল’।

এদিকে যোগদানপত্র গ্রহণ না করলেও ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত নগর ভবনে এসে নিজ দপ্তরে উপস্থিত হন তৌহিদুল ইসলাম। সর্বষে ৩০ অক্টোবর যোগদানপত্র গৃহীত না হওয়ায় মেয়রের দপ্তরে যান তিনি। এ সময় কারণ দর্শানো নোটিশের সন্তোষজনক জবাব না দেয়া পর্যন্ত তার যোগদানের বিষয়ে মেয়র নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন। এসময় সেখানে থাকা চসিকের সচিব (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) মোহাম্মদ আশরাফুল আমিনকে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী করেন শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। এক পর্যায়ে সচিবের সঙ্গে ‘দুর্ব্যবহার’ করেন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। এরপর নগর ভবন থেকে বের হয়ে চলে যান প্রধান তৌহিদুল ইসলাম। গতকাল পর্যন্ত আর কর্মস্থলে আসেননি তিনি।

উল্লেখ্য, দুটি প্রতিষ্ঠানের হোল্ডিংএর বিপরীতে চসিকের মূল্যায়নকৃত পৌরকর (গৃহকর ও অন্যান্য রেইট) থেকে ঘষামাজা করে ২০ কোটি টাকা করে ৪০ কোটি টাকা কমিয়ে দেয়ার ঘটনায় শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামকে গত ২৭ অক্টোবর কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন মেয়র।

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে : চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতায় বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়কের উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন শীর্ষক আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলমান আছে চসিকে। চলতি অর্থবছরে এ প্রকল্পে ৬৭৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ আছে মন্ত্রণালয়ের। এ প্রকল্পের অন্যতম অঙ্গ সড়ক সংস্কার।

দায়িত্ব নেয়ার পর ডা. শাহাদাত হোসেন প্রথম দফায় প্রায় ৮০ কোটি টাকার ১০টি কাজের দরপত্র আহ্বান করেন। কিন্তু কাজগুলোর দরপত্র মূল্যায়নসহ নানা রকম যাচাই বাছাইয়ের নামে তিন মাস চলে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করতে হয়। এতে বিঘ্ন ঘটে নগরের সড়ক উন্নয়ন কাজে। তাই শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের ওপর ক্ষুব্ধ হন মেয়র। পরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার পরবর্তীতে আরো ১৪টি প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু সরকারি ক্রয়বিধি (পিপিআর) ২০২৫ চালু হলে এ দরপত্র আর কোনো কাজে আসেনি। ফলে এবারও থমকে যায় উন্নয়ন কাজ। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ত্বরান্বিত হওয়ার জন্য প্রধান নির্বাহীর অসহযোগিতার কথা প্রায় দাবি করেন মেয়র।

আগেও বদলির জন্য পত্র দেন মেয়র : গত জুলাই মাসে কানাডা সফর করেন মেয়র। কানাডা যাওয়ার আগে প্রধান নির্বাহীকে বদলি করার জন্য মন্ত্রণালয়ে পত্র দেন মেয়র। গত ৮ জুলাই ‘সচেতন চট্টগ্রামবাসী’ ব্যানারে এ প্রধান নির্বাহীর অপসারণের দাবিতে টাইগারপাস নগর ভবনের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয়। এছাড়া গত ৩০ অক্টোবর অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের অপসারণ চেয়ে একই স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে ‘চসিকের সকল সাধারণ কর্মচারীবৃন্দ’ ব্যানারে।

নাম প্রকাশ করার শর্তে চসিকের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারি আজাদীকে জানান, প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে মেয়র অনাস্থা প্রকাশ করলে কোনো কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলি করে দেয়ার প্রচলন অতীতে ছিল। গত জুলাই মাসে বদলি করে দিলে জটিলতা তৈরি হতো না।

কী বলছেন মেয়র ও প্রধান নির্বাহী : লন্ডনে অবস্থানরত সিটি মেয়র মোবাইলে আজাদীকে বলেন, গত বছরের জুলাই মাসে ছাত্রজনতার আন্দোলন চলাকালে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় সড়কবাতি বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর অন্ধকারে ছাত্রদের উপর হামলা হয়েছে। এ ঘটনায় কর্পোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু ওই সময় প্রধান নির্বাহী ছিলেন তৌহিদুল ইসলাম। সে কি ঘটনার দায় এড়াতে পারে?

মেয়র বলেন, গৃহকরে ঘষামজা করে ২০ কোটি টাকা করে ৪০ কোটি কমিয়ে দেয়ার ঘটনাটি খোরশেদ আলম সুজনের আমলে হয়েছে। পরবর্তীতে তদন্ত কমিটি গঠন হয়। কিন্তু প্রধান নির্বাহী হিসেবে তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন দিতে কোনো চাপ দেয়নি। ধরে নিলাম রেজাউল করিমের চাপে পারেনি। কিন্তু আগস্টের পর আমি দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত সময়েও তো কিছু করল না। এমনকি আমি দায়িত্ব নেয়ার পর আমাকেও বলেনি এ ধরনের একটি অনিয়ম হয়েছে। পরে জানুয়ারিতে অন্য সোর্স থেকে জানতে পেরে আবার তদন্ত কমিটি গঠন করে দিই। এরপরও সে তদন্ত কর্মকর্তাকে কিছু বলতো না। পরে সে (তৌহিদুল ইসলাম) যখন প্রশিক্ষণে যায় তখন তদন্ত রির্পোট পাই। মজার বিষয় হল, এই ফাইলটা তার রুমে রেখে দিয়েছিল। এ ঘটনায় বুঝা যায় সে দোষী।

মেয়র বলেন, উন্নয়নমূলক কোনো কাজও করতে দেয় না। এই যে রাস্তার টেন্ডার হলো, সেগুলো রিটেন্ডারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু সেগুলোও চার মাস ঝুলিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ উন্নয়নমূলক কাজ করতে দেবে না সে। কিন্তু জনগণ তো আমাকে বলে, রাস্তা হয় না কেন, ফুটওভার ব্রিজ হয় না কেন। এ ধরনের লোক কর্পোরেশনে থেকে তো লাভ নেই। এর আগে গত জুলাই মাসেও বদলির জন্য মন্ত্রণালয়ে পত্র দেয়ার বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেন মেয়র।

শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, প্রশিক্ষণ শেষে যোগ দিতে আসি। কিন্তু আমার যোগদানপত্র গ্রহণ করা হয়নি। বিষয়টি আমি মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছি। আবার মেয়রও পত্র দিয়েছেন। দুটো বিষয়ে তদন্ত করতে কমিটি করেছে মন্ত্রণালয়। তিনি বলেন, মেয়রের পত্রে কী লিখেছে আমি জানি না। শোকজের জবাব দেবেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, জবাব দেব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউখিয়া থেকে অপহৃত শিশু চন্দনাইশে উদ্ধার
পরবর্তী নিবন্ধরাউজানে আসামি ধরার অভিযানে উদ্ধার বিপুল অস্ত্র