প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে বর্জ্য থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদনে কার্যক্রম শুরু করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। সংস্থাটির হালিশহর আনন্দবাজার বর্জ্যাগারে ‘টেকসই ল্যান্ডফিল পুর্ননির্মাণ প্রকল্প’র আওতায় গতকাল গ্যাস কূপের টেস্ট বোরিং উদ্বোধন করেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। এই টেস্ট বোরিং সফল হলে আগামী ডিসেম্বর–জানুয়ারির মধ্যেই পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকল্পটি চালু করা হবে। উৎপাদিত গ্যাস বাণিজ্যিকভাবে বিপণন করার পরিকল্পনা আছে চসিকের। তখন বাসা–বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের নির্ধারিত ফি আদায় বন্ধ করে দেয়া হবে, দৈনিক আজাদীকে এমনটিই জানিয়েছেন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ মে বর্জ্য থেকে গ্যাস উৎপাদন বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান বিএন্ডএফ–এর সঙ্গে চসিকের সমাঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। এর প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটি চসিকের ল্যান্ডফিল বা বর্জ্যাগারে জমাকৃত আবর্জনাকে সম্পদে রুপান্তরের সম্ভাব্যতা যাচাই–এ কাজ শুরু করে। এর অংশ হিসেবে গতকাল গ্যাস কূপের টেস্ট বোরিং উদ্বোধন করা হয়। বিএন্ডএফ–এর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, হালিশহর আনন্দবাজার বর্জ্যাগারের বর্জ্যগুলোকে কয়েকটি ধাপে কাজে লাগানো হবে। এর মধ্যে কিছু বর্জ্য দিয়ে বায়োগ্যাস উৎপাদন করা হবে। জমা হওয়া প্লাস্টিক গলিয়ে করা হবে তেল। এছাড়া অন্যান্য যেসব বর্জ্য রিসাইক্লিং করা যাবে সেগুলোও আলাদা করে কাজে লাগানো হবে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, হালিশহরের আনন্দবাজার ল্যান্ডফিলটি গড়ে উঠেছে ৯ একর ভূমির উপর। এ ল্যান্ডফিলে নগরের ৪১ ওয়ার্ডের মধ্যে ২২ থেকে ২৩টি ওয়ার্ড থেকে সংগৃহীত বর্জ্য ফেলা হয়। এ ল্যান্ডফিলে জমা হওয়া বর্জ্যের ৬০ থেকে ৬৪ শতাংশ দিয়ে বায়োগ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব বলে দক্ষিণ কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান বিএন্ডএফ জানিয়েছে চসিককে।
প্রকল্প প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমস্যার টেকসই সমাধানে এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ব্যবহারযোগ্য গ্যাস উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা নগরবাসীকে সেবা দেওয়ার নতুন দিগন্তে প্রবেশ করতে যাচ্ছি।
বায়োগ্যাস উৎপাদনে কি পরিমাণ বর্জ্যের প্রয়োজন হবে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, তারা তো এক হাজার থেকে ১২শ মেট্রিক টন বর্জ্যের কথা বলেছে। তবে প্রতিদিন শহরে প্রায় ৩ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মধ্যে আমরা প্রায় ২ হাজার ২০০ টন সংগ্রহ করি। নানা কারণে বাকি বর্জ্য নালা ও খালে গিয়ে জলাবদ্ধতা ও দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। খালপাড়ের অনেক বাসা–বাড়ির বাসিন্দা বর্জ্য খাল–নালায় ফেলে দেয়। তাই শতভাগ বর্জ্য সংগ্রহ নিশ্চিত করতে ডোর–টু–ডোর প্রকল্প চালুর মাধ্যমে বাসি–বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করছি। এখন বায়োগ্যাস প্রকল্প যদি পুরোদমে চালু হয় তখন এটা বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহ করব। এতে কর্পোরেশন আর্থিকভাবে লাভবান হলে বাসা–বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহে এখন যে ৭০ টাকা ফি নেয়া হয় তা বন্ধ করে দেব।
এদিকে গতকাল গ্যাস কূপের টেস্ট বোরিং উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মেয়র বলেন, ওয়েস্ট টু এনার্জি প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে বায়োগ্যাস উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসন ও পরিবেশ দূষণ রোধে বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার কোনো বিকল্প নেই। এই প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা চট্টগ্রামকে একটি ক্লিন, গ্রিন ও হেলদি সিটিতে পরিণত করতে চাই। তিনি বলেন, আমি যখন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন থেকেই আমার চিন্তা ছিল, কীভাবে শহরের ময়লাগুলোকে সম্পদে রূপান্তর করা যায়। হালিশহরের মানুষ বছরের পর বছর দুর্গন্ধ ও দূষণের কষ্ট ভোগ করছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা শুধু পরিবেশ রক্ষা নয়, বরং বর্জ্য থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদনের মাধ্যমে জ্বালানি নিরাপত্তাও নিশ্চিত করব।
তিনি নগরবাসীর উদ্দেশে বলেন, আপনারা বর্জ্য নালা বা খালে ফেলবেন না। একটু সচেতনতা আমাদের শহরকে করবে পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এটি হবে বাংলাদেশের প্রথম বায়োগ্যাস প্রজেক্ট, যা চট্টগ্রামকে একটি পরিবেশবান্ধব, আধুনিক ও টেকসই শহরে রূপান্তরে ভূমিকা রাখবে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চসিক সচিব মো. আশরাফুল আমিন, প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, রাজনীতিবিদ আলহাজ্ব এম এ আজিজ, হানিফ সওদাগর, বি অ্যান্ড এফ কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান সি ডব্লিউ পার্ক, পরিচালক মেজর নাসিম উদ্দিন, পরিচালক প্রকৌশলী তানিম, প্রকল্প ইনচার্জ অ্যাডভোকেট তারান্নুম বিনতা নাসিম। চসিকের সচিব মো. আশরাফুল আমিন বলেন, প্রাথমিকভাবে বর্জ্য থেকে মিথেন গ্যাস উৎপাদন করা হবে। পরবর্তীতে ডিজেল’সহ অন্যান্য প্রোডাক্টিভ বিষয়গুলো হবে।
বিএন্ডএফ–এর প্রকল্প ইনচার্জ অ্যাডভোকেট তারান্নুম বিনতা নাসিম আজাদীকে বলেন, ল্যান্ডফিলে বর্তমানে বর্জ্যগুলো বিশৃঙ্খলভাবে আছে। আমরা সেগুলো শৃঙ্খলায় আনব। এখানে তিন–চার স্তরে কাজ করা হবে। গ্যাস উৎপাদন, প্লস্টিক গলিয়ে তেল এবং যেসব বর্জ্য রিসাইক্লিং করা যাবে সেগুলো সেভাবেই করা হবে। এটাকে আধুনিক ল্যান্ডফিল্ডে পরিণত করা হবে। ল্যান্ডফিল্ডে থাকা বর্জ্য ব্যবহার করে উৎপাদিত গ্যাস বিক্রির লভ্যাংশ চসিকের সঙ্গে ভাগাভাগি করা হবে।