প্রথমবার বন্দর থেকে পুরো পৌরকর পাচ্ছে চসিক

বন্দর থেকে বছরে ১৬০ কোটি টাকা পাবে চসিক বকেয়া ১শ কোটি পরিশোধের নির্দেশ মন্ত্রণালয়ের

মোরশেদ তালুকদার | সোমবার , ৭ এপ্রিল, ২০২৫ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) কাছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) নির্ধারিত পৌরকর হচ্ছে ১৬০ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে নির্ধারিত এ পৌরকরের বিপরীতে চবক পরিশোধ করে আসছিল মাত্র ৪৫ কোটি টাকা। এতে প্রতি বছর ১১৫ কোটি টাকা করে রাজস্ব হারায় চসিক। দায়িত্ব নেওয়ার পর চবক থেকে নির্ধারিত পৌরকরের পুরোটাই আদায়ের উদ্যোগ নেন চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। এর অংশ হিসেবে পাওনা পরিশোধে চসিক চিঠি দেয় চবককে। এতে সাড়া না দেওয়ায় মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হন মেয়র। এর প্রেক্ষিতে গতকাল রোববার চসিককে আপাতত ১০০ কোটি টাকা পরিশোধ করার নির্দেশনা দিয়ে চবক চেয়ারম্যানকে দাপ্তরিক পত্র দেয় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। চসিকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১৯৯৪১৯৯৫ অর্থবছর থেকে চবক কখনোই পঞ্চবার্ষিকী করপুনর্মূল্যায়নের আলোকে চসিকের প্রস্তাবিত পৌরকরের পুরোটা পরিশোধ করেনি। সাবেক মেয়রদের অনেকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হন। কেউ অজ্ঞাত কারণে চবককে ছাড়ও দেন। অবশেষে ৩০ বছর পর বর্তমান মেয়রের উদ্যোগে চসিকের প্রস্তাবিত পৌরকরের প্রায় পুরোটায় পরিশোধ করতে যাচ্ছে চবক। এতে রাজস্ব বাড়বে চসিকের। ফলে চসিকের নিজস্ব ফান্ডের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গতি বাড়বে।

কী বললেন মেয়র : বন্দরকে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, স্বাধীনতার পর এই প্রথম কর্পোরেশনকে বন্দর পুরো পৌরকর পরিশোধ করবে। অতীতে মেয়ররা চেষ্টা করেও এটা আদায় করতে পারেননি। বন্দর থেকে মোটা অংকের পৌরকর পেলে আমাদের কর্মকাণ্ডে গতি বাড়বে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আমরা যে বিপুল অংকের ভর্তুকি দিই সেটা আরো বাড়াতে পারব। এতে দুটো খাত আরো সমৃদ্ধ হবে। নগরের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও সেবার পরিধি সম্প্রসারণে যে আর্থিক সক্ষমতা প্রয়োজন সেক্ষেত্রে যথেষ্ট অপ্রতুলতা রয়েছে কর্পোরেশনের। তাই বন্দর থেকে ন্যায্য পৌরকর পেলে নগরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা সহজ হবে। বিপুল দেনা কাঁধে নিয়ে আমি দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্ব ছাড়ার পূর্বে সে দেনা পরিশোধ করে কর্পোরেশনকে একটা পর্যায়ে আনতে চাই। এজন্য চসিকের আয় বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছি।

বন্দর থেকে প্রস্তাবিত পৌরকরের প্রায় পুরোটা আদায় কীভাবে সম্ভব হচ্ছে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, বন্দরে পণ্য আনানেওয়া করা বড় বড় ট্রাকলরি কর্পোরেশনের তৈরি রাস্তা ব্যবহার করে। এগুলো মেরামত করতে আমাদের প্রচুর অর্থ খরচ হয়। তাই সার্ভিস চার্জ হিসেবে বন্দরের কাছে তাদের আয়ের ১ শতাংশ অর্থ চেয়েছিলাম। সার্ভিস চার্জ দিলে বছরে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে বন্দরকে। তখন তারা আমাকে রিকুয়েস্ট করে ওটা পৌরকরে অ্যাডজাস্ট করতে। তাছাড়া আইনেও সার্ভিস চার্জ দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই ১৬০ কোটি টাকার যে পৌরকর আমরা পাব সেটাই চেয়েছি।

১৬০ কোটি টাকাকে ৪৫ কোটি করে করে দেন রেজাউল : ২০১৭ সালে চসিকের পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়নে চবকের কাছে ১৬০ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা পৌরকর প্রস্তাব করা হয়। তবে একই বছরের ডিসেম্বর মাসে এ কর পুনর্মূল্যায়ন কার্যক্রম স্থগিত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়; যা ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর প্রত্যাহার করা হয় (কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে)। এরপর চবককে পুনর্মূল্যায়নের আলোকে পৌরকর পরিশোধ করতে বলে চসিক। কিন্তু আপত্তি জানায় সংস্থাটি।

২০২১ সালের ১৪ জুলাই চসিক ও বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে বিষয়টি সুরাহা করতে বৈঠক হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীও। ওই বৈঠকে ৫০ কোটি টাকা পৌরকর চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু বন্দর পরিশোধ করে ৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ শতাংশ সারচার্জ মওকুফের সুবিধা নিয়ে পরিশোধ করে মাত্র সাড়ে ৪০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত চসিকের সাধারণ সভায় তা অনুমোদন দেন তৎকালীন মেয়র রেজাউল করিম।

মেয়র শাহাদাতের উদ্যোগ : ১৬০ কোটি টাকার পুরোটা আদায়ের উদ্যোগ নেওয়ার পর গত বছরের (২০২৪) ১৫ ডিসেম্বর চবক চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয় চসিক। এতে চলতি অর্থবছরে (২০২৪২০২৫) বন্দরের পরিশোধিত অংক বাদ দিয়ে বাকি ১১৫ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়। পত্রে বলা হয়, চলতি অর্থবছর থেকে ১৬০ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার টাকা পৌরকর ধার্য করা হয়। এরপর চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি নৌপরিবহন সচিবকেও চিঠি দেয় চসিক। এতে চসিকের প্রস্তাবিত পৌরকর পরিশোধে চবককে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করতে বলা হয়।

এদিকে চসিকের চিঠি পেয়ে সার্ভে কমিটি গঠন করে চবক। কমিটি চসিকের পাওনা পরিশোধে সুপারিশ করে বলে আজাদীকে জানান মেয়র শাহাদাত।

অবশেষে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা : গতকাল নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নজরুল ইসলাম আজাদ স্বাক্ষরিত চিঠি দেওয়া হয় চবক চেয়ারম্যানকে। এতে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবমতে পৌরকর বাবদ চাওয়া ১১৫ কোটি টাকার মধ্যে জয়েন্ট সার্ভে কমিটির রিপোর্টের সুপারিশের ভিত্তিতে কমবেশি সমন্বয়ের শর্তে আপাতত ১০০ কোটি টাকা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে প্রদান করা যেতে পারে। বিষয়টি নির্দেশক্রমে জানিয়ে দেওয়া হলো।

চবক সূত্রে জানা গেছে, চসিকের চিঠি পাওয়ার পর নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত জানতে চেয়ে গত ২৩ মার্চ চিঠি দিয়েছিল চবক।

প্রথমবার পুরো পৌরকর পাচ্ছে চসিক : ১৯৯৪৯৫ অর্থবছরে ৩৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা পৌরকর দাবি করলেও চবক ৫ কোটি টাকা পরিশোধ করত। তবে ২০০১০২ অর্থবছরে চসিক বকেয়া ১৯৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা দাবি করে। ওই সময়ে বন্দরের আপত্তিতে চসিক অনড় থাকায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপ করে। পরে দুুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে চবক ২০১২ সালে ১১২ কোটি ৩০ লাখ টাকা পরিশোধ করে চসিককে।

এরপর ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে দুই সংস্থার মধ্যে একটি চুক্তি হয়। চুক্তির ভিত্তিতে ওই অর্থবছর থেকে পৌরকর বাবদ ৩৯ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা পরিশোধ করে চবক; যা সারচার্জ মওকুফের সুযোগ নিয়ে সংস্থাটি ২০২১ সাল পর্যন্ত ৩৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা করে পরিশোধ করে।

পরবর্তীতে ২০১৭ সালের পুনর্মূল্যায়নের ওপর ২০২১ সালের ১৪ জুলাই চসিক ও বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠকে ধার্য হয় ৫০ কোটি টাকা। যার আলোকে ২০১৭২০১৮ অর্থবছর থেকে ২০২০২০২১ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতি বছর বকেয়া বাবদ সাড়ে ১০ কোটি টাকা করে ৪ বছরে ৪২ কোটি উসুল বাদ বকেয়া দাবি করে চসিক। কিন্তু ২০২০২০২১ অর্থবছর পর্যন্ত তা পরিশোধ করা সম্ভব হবে না বলে চসিককে ওই সময় জানিয়ে দেয় চবক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জামায়াত নেতাসহ তিন চাচাতো ভাই-বোনের মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বব্যাপী আজ ‘নো ওয়ার্ক নো স্কুল’