প্রতিযোগী অনেক, স্বপ্ন বহুদূর

ম্যাজিক বাউলিয়ানার চট্টগ্রাম পর্বের অডিশন

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ৪ জুন, ২০২২ at ৪:৫২ পূর্বাহ্ণ

লোকসংগীত সব শ্রেণির মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়, আদরনীয়। প্রবহমান সংস্কৃতির ধারায় সংগীতের অন্য ক্ষেত্রগুলোর মতো লোকসংগীত সহাবস্থান করছে তার স্বকীয় রূপবৈচিত্র্য নিয়ে। লোকসংগীতের সুরের মূর্ছনায় জীবন্ত হয়ে ওঠে বাংলার প্রকৃতি ও মানুষের আবেগ। বাউল, জারি, সারি, পল্লিগীতি আমাদের প্রাণের গান, হৃদয়ের গান। এসব গানে মাটির সুধা লেগে আছে বলেই আমরা বারবার ফিরে যাই এই হৃদয় ছোঁয়া গানের কাছে। লোকগানের ইতিহাসঐতিহ্যের শক্তিকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার অন্যতম প্ল্যাটফর্ম ‘ম্যাজিক বাউলিয়ানা’। আয়োজনটির উদ্দেশ্য দেশের তরুণ প্রজন্মকে লোকগানের সঙ্গে পরিচয় করানো, বিশ্বমঞ্চে বাংলা লোকগানের চিরন্তন আবেদন তুলে ধরা।

বর্তমান প্রজন্মের কাছে এবং সারা বিশ্বে বাংলার বাউল সংগীতকে পৌঁছে দিতে মাছরাঙা টেলিভিশনে চতুর্থবারের মতো শুরু হয়েছে লোকসংগীতের রিয়েলিটি শো ‘ম্যাজিক বাউলিয়ানা ২০২২’। চট্টগ্রামের প্রতিযোগীদের মাধ্যমে এবারের ম্যাজিক বাউলিয়ানার চতুর্থ পর্বের অডিশন শুরু হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টায় নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অডিশন পর্বটি অনুষ্ঠিত হয়।

সরেজমিনে গতকাল সকাল ১০টায় নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের গেইট দিয়ে ঢুকতেই কানে ভেসে আসে বাউল গান। পাঁচ/ ছয় জন জড়ো হয়ে শেষবারের মতো নিজেদের ঝালাই করে নিচ্ছেন, একজনের হাতে গিটার। ‘কেন পীরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু’ থেকে ‘মিলন হবে কত দিনে’ চলছে জমজমাট আসর। স্কুলের ভেতর একটি বড় কক্ষে দেখা যায় প্রতিযোগীরা যে যার মতো বসে আছেন। কেউ রেওয়াজ করছেন, কেউ ভাবছেন ঢাকায় যাওয়া হবে কিনা। তাদের মধ্যে সবাই যে কণ্ঠে আওয়াজ তুলছেন তা নয়, অনেকে পোশাকেও বাউল সেজেছেন। চট্টগ্রাম অঞ্চলের এ অডিশন রাউন্ডে বিপুল প্রতিযোগী অংশ নেন। অডিশন রাউন্ডে প্রাথমিক পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিযোগী রোকসানা আক্তার সুবর্ণা আজাদীকে বলেন, আমার স্বপ্ন সেরা তিন শিল্পীর একজন হওয়া। যেতে চাই বহুদূর।

অডিশনস্থল তিনতলায়। প্রথম কক্ষে অডিশন নিচ্ছেন বাউল শিল্পী আজাদ দেওয়ান ও কাজল রেখা। একেকজন প্রতিযোগী আসছে, গান গাইছে। কিন্তু বিচারকগণকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না কিছুতেই। কারো রেওয়াজ নেই, কেউ সুরে ভুল করছে, কেউ আবার তাল লয় গুলিয়ে ফেলছে। বিচারকদ্বয় বিদায় দেওয়ার আগে প্রতিযোগীদের বারবার বলছেন, এটাই শেষ নয়। রেওয়াজ করতে হবে। অবশেষে ফাতেমা তুজ জোহরা এল। বাড়ি চট্টগ্রামে, কিন্তু বেড়ে উঠেছে সিলেটে। প্রথমেই গাইল বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের গান, ‘আমি তোমার কলের গাড়ি/ তুমি হও ড্রাইভার/ তোমার ইচ্ছায় চলে গাড়ি/ দোষ পড়ে আমার’। বিচারকদ্বয় পরস্পরের দিকে তাকালেন। বোঝা গেল এতক্ষণে তারা কিছুটা সন্তুষ্ট। আজাদ দেওয়ান আরেকটি গান শুনতে চাইলেন। প্রতিযোগী ধরলেন, ‘পর মানুষে দুঃখ দিলে, দুঃখ মনে হয় না’। বিচারকদের মন ভরতে চাইছে না। কাজল রেখা তৃতীয় একটি গান করতে বলেন, কোনো আঞ্চলিক ভাষায়। প্রতিযোগী ফাতেমা সাঁইজির সেই বিখ্যাত গানটি করলো, ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি’। বিচারকদ্বয় কাছে ডেকে তুলে দিলেন, পরবর্তী পর্বে যাওয়ার টিকিট।

আজাদ দেওয়ানের কাছে চট্টগ্রামের প্রতিযোগীদের মান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আজাদীকে বলেন, সকাল থেকে আপনার আসা পর্যন্ত আমাদের রুমে ৪৯ জনের অডিশন নিয়েছি। এ প্রথম একজন ইয়েস কার্ড পেল। কিন্তু তাই বলে প্রতিযোগীদের মান খারাপ এমনটা বলা যাবে না। গতবারও আমার বিচারক হিসেবে থাকার সুযোগ হয়েছিল। আমি দেখেছি চট্টগ্রাম আর রাজশাহীর মতো এত সংখ্যক প্রতিযোগী অন্যত্র নেই। যেখানে প্রতিযোগী বেশি হবে, সেখানে বিচার করাটাও কঠিন হয়ে পড়ে।

শিল্পী কাজলরেখা বলেন, আমার একটাই কষ্ট, এতজনের গান শুনলাম, চট্টগ্রামের কোনো আঞ্চলিক গান গাইল না কেউ। অথচ চট্টগ্রাম অঞ্চল আমাদের সঙ্গীত জগতের রত্ন ভান্ডার। এখানকার গুণী শিল্পীরা যদি নতুন প্রজন্মের মাঝে এ গানগুলো ছড়িয়ে দিতে পারেন, তবেই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান মুখে মুখে ফিরবে।

এরপর যাওয়া হলো পরের কক্ষে, যেখানে বিচারক হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত মিল্পী আবদুর রহিম ও শিল্পী লাভলী দেব। শিল্পী লাভলী দেব বলেন, লোকগানের মাধ্যমে খুব সহজে মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়। লোকগানে একটা শেকড়ের টান থাকে। লোকগানের শক্তিশালী রূপটি নতুন প্রজন্মের সামনে ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরা আর আধুনিক ও প্রথাগত শিল্পীদের মধ্যে একটি সংযোগ তৈরিই এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। আমরা মনে করি যার মনে বাজে বাংলার লোকগান, সেই বাউল। সে থাকুক নিভৃত পল্লিতে কিংবা নাগরিক অট্টালিকায়। গান গায় একতারা হাতে বা গিটার নিয়ে। আমরা প্রতিযোগিতায় তাকেই চাই যার বুকের মাঝে সারাক্ষণ ঢিপ ঢিপ করে বেজে চলে বাংলার গান।

শিল্পী আবদুর রহিম বলেন, বাউলিয়ানা রিয়ালিটি শো এই বাংলার লোকগানের স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে সঙ্গীতায়োজনে এক মৌলিক মিশ্রণ ঘটিয়েছে। আগে লোকগান এত প্রচলিত ছিল না। এখন পরিবর্তন হয়েছে। আমরা জানি বাউলদের জীবন অতি সাধারণ, মনও অতি সাধারণ। গানের সঙ্গে তাদের আত্মার সম্পর্ক। বাউল গানের চর্চা এবং প্রসারে ম্যাজিক বাউলিয়ানার মতো আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি জানান, তাদের রুমে দুপুর পর্যন্ত ৪৫ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ইয়েস কার্ড পেয়েছে চারজন।

বাছাই করা প্রতিযোগীদের নিয়েই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফোক রিয়্যালিটি ম্যাজিক বাউলিয়ানা ২০২২ এর মূল প্রতিযোগিতা শুরু হবে। এদের মধ্য থেকে সেরা তিন শিল্পীকে ম্যাজিক বাউলিয়ানা ২০২২এর বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হবে। বিজয়ীদের জন্য থাকছে নানা রকম স্বীকৃতি ও পুরস্কার।

জানা গেছে, অডিশন রাউন্ড থেকে বাছাই করা শিল্পীদের পরবর্তী পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত করা হবে। তাদের নিয়ে করা হবে গ্রুমিং সেশন। সেখানে শিল্পীদের সংগীত পরিবেশনা, সুরের ব্যবহার, যথাযথ স্কেল নির্বাচন, শুটিংসংক্রান্ত বিষয়ে ধারণা দেওয়ার পাশাপাশি ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো, মাইক্রোফোনের পজিশন, শব্দ প্রক্ষেপণ, পারফর্মিং আর্টসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে ধারণা দেওয়া হবে। চট্টগ্রামের পর বাংলাদেশের বাকি ছয়টি অঞ্চল ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত হবে ‘ম্যাজিক বাউলিয়ানা ২০২২’এর অডিশন রাউন্ড।

উল্লেখ্য, সান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ও স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ওরাল কেয়ার ব্র্যান্ড ম্যাজিকের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজনটির উদ্দেশ্য হলো বাউলগানের চর্চা এবং প্রসারে এই বাউলিয়ানার আয়োজন হলেও এখানেই থেমে থাকা নয়। গত আসরের গাওয়া ১১০টি বাউলগান শুদ্ধরূপে সংকলন করে একটি বই প্রকাশ করা হবে, যা ভবিষ্যতে আর্কাইভ হিসেবে থেকে যাবে। এছাড়া ৩৫ জন গুণী বাউলশিল্পীর জীবনী, তাদের অবদান এবং জনপ্রিয় ৮টি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে ভিডিও নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলো ম্যাজিক বাউলিয়ানার পেজ থেকে একে একে পাবলিশ করা হবে। এর পাশাপাশি বাউল শিল্পীদের রয়্যালিটি নিশ্চিত করা, তাদের এ ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান দেওয়া, ইউটিউবে তাঁদের চ্যানেল খুলে গান আপলোড করে রেভিনিউ লাভের বিষয়টিও করবে উদ্যোক্তাগণ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখালেদা জিয়া মুক্ত থাকলে ক্ষমতায় থাকতে পারত না আওয়ামী লীগ
পরবর্তী নিবন্ধগ ইউনিটে উপস্থিতি ৯৮%