বিশ্ব নাটকের যে কয়েকটি নাট্য আখ্যান দেশ কালপাত্রের সীমানা ছাড়িয়ে অনেক আগে থেকে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে তার মধ্যে গ্রিক নাট্যকার সফোক্লেস এর ‘রাজা ইডিপাস’ অন্যতম। নাটকটির ত্রয়ী পর্ব ‘রাজা ইডিপাস’ ‘ইডিপাস এট কলোনাস’ এবং ‘আন্তগোনে’ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। গ্রিক ট্র্যাজেডি হিসেবে এই ত্রয়ী নাটক সারাবিশ্বে অনূদিত ও রূপান্তরিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। তবে গ্রিক ট্র্যাজেডি ট্রিলজির প্রথম পর্ব ইডিপাসের বিভিন্ন রূপান্তরের মঞ্চায়নই বেশি হয়েছে বিশ্বজুড়ে। বাংলা ভাষায়ও কম নয়। দুই বাংলায়। আমরা চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন মঞ্চেও ইডিপাসের মঞ্চায়ন দেখার সুযোগ পেয়েছি বিভিন্ন দলের প্রযোজনায়।
তবে প্রতিভাসের মঞ্চায়নটি একটু ভিন্নতার দাবীদার। এক্ষেত্রে সলিল সরকারকৃত রূপান্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মূল আখ্যানের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত থেকে পুরো নাটককে তিনি দেশজ এবং বাংলার নিতান্ত এক গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে প্রতিস্থাপিত করেছেন। ফলে, যারা ইডিপাস নাটকটি সম্বন্ধে জানেন তারাও যেমন নতুন এক আস্বাদনের সন্ধান পান, তেমনই যারা নাটকটি সম্বন্ধে অবগত নন তারাও নতুন এক অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়ে যান।
দৈববানী এবং নিয়তির বিষয় আমাদের এতদ্অঞ্চলের মহাকাব্য, লোকগাথা, এবং আখ্যান উপাখ্যানে নিয়ত পরিলক্ষিত হয়। যে কারণে গ্রিক দেশীয় এই নাট্য ত্রয়ীও খুব একটা ভিনদেশী এবং ভিন্ন সাংস্কৃতিজাত বলে মনে হয় না আমাদের। তারপরেও সফোক্লেসের রচনার একটি বিশেষ মৌলিকত্ব রয়েছে যা পুরোপুরি এদেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। সেই মৌলিকত্বকে দেশজ অবয়বে রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে প্রতিস্থাপিত ও উপস্থাপিত করা অনেকটাই দুরূহ যা সলিল সরকার পেরেছেন এবং প্রতিভাস প্রযোজনার নির্দেশক মুনীর হেলাল সে উপস্থাপনাকে দক্ষতার সঙ্গে প্রাণবন্ত করে তুলতে সমর্থ হয়েছেন তাঁর সুদক্ষ অভিনয়শিল্পীদল ও কলাকুশলীর সুসংহত সমন্বয়ে। চমৎকার এক টিমওয়ার্ক উপহার দিয়েছেন নাট্যদল প্রতিভাস।
প্রতিভাস চট্টগ্রামের একটি পুরোনো নাট্যদল। চার দশকের দীর্ঘ পরিক্রমায় উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন নাট্যমঞ্চায়নের অভিজ্ঞতা রয়েছে দলটির। বাংলাদেশের এক ক্রান্তিকালে ১৯৮৩ সালের ১ বৈশাখ প্রতিভাসের প্রতিষ্ঠা। স্বভাতই গত ৪০ বছরে অনেক শিল্পী কলাকুশলী ও সংগঠক এ–দলে সম্পৃক্ত হয়েছেন। অগ্রজদের পাশাপাশি নবীনদের সম্মিলনে প্রতিভাস এখনও কর্মচঞ্চল। তাদের বর্তমান প্রযোজনা জায়া প্রজায়িনী তারই সাক্ষর।
সলিল সরকারের সাবলীল রূপান্তর এবং মুনীর হেলালের তদানুগ কুশলী নির্দেশনা নাটকটিকে উপভোগ্য করে তুলেছে প্রধান দুই চরিত্র দায়াদ (ইডিপাস) ও জায়িনীর (ইডিপাসের মাতা ও স্ত্রী) ভূমিকায় হিন্দোল রায় ও কংকন দাসের অনবদ্য অভিনয়। দায়াদ ও জায়িনী চরিত্র দুটিতে বেশ কয়েক পরতের স্তর রয়েছে। পুত্র ও দয়িত এবং মাতা ও দয়িতার পরস্পরবিরোধী ও পরস্পর সাংঘর্ষিক অন্তর্নিহিত যে মাত্রা চরিত্রদ্বয়ে বিদ্যমান তা অত্যন্ত মানবিকভাবে উপস্থাপনে সমর্থ হয়েছেন হিন্দোল ও কংকন। দেবতার ছলনা ও মানুষের অনতিক্রম্য নিয়তির যে সংঘর্ষ, যার কারণে মানুষ ক্রীড়নক, অদৃষ্টের ফেরে মানুষের অসহায়ত্ব নাটকের এই প্রতিপাদ্যটি আত্মস্থে সক্ষম হয়েছেন পুরো অভিনয়শিল্পীদল। এর ফলে মূল দুই চরিত্রের অভিনয়কে স্বতঃস্ফূর্ত করে তুলেছে সহযোগী অভিনেতাদের প্রাণবন্ত অভিনয়। মোড়ল চরিত্রে দীপঙ্কর দস্তিদার, প্রিনয়নের ভূমিকায় দুলাল দাশ গুপ্ত, রাখাল চরিত্রে অসীম বিশ্বাস এবং দূতের ভূমিকায় মোরশেদ হিমাদ্রী হিমুর অভিনয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য ভূমিকায় রথি দাশগুপ্ত, দীপা চৌধুরী, আশরাফ মাসুদ, অরুণা দত্ত, সৌগতা দে ঐশী, বীনা দাশগুপ্ত, মামুন খান রাহী, আরিয়া জুনাইনাহ, সাবলীল অভিনয় করেছেন।
নাটকের দুটি গানের কথা প্রাসঙ্গিকভাবে লিখেছেন রঞ্জন কুমার দেব এবং তাতে যথাযথ সুরারোপ করেছেন রওনক আনোয়ার। সংগীত পরিচালনায় ছিলেন মধুলিকা মন্ডল। সংগীত পরিবেশনা ও যন্ত্রীদলে ছিলেন দিগন্ত রায়, মধুলিকা মন্ডল, সর্বানী দস্তিদার ও দিবাকর দস্তিদার। মঞ্চ পরিকল্পনায় সঞ্জীব দত্ত ও মঞ্চ নির্মাণে আবদুল মালেক যথেষ্ট পরিমিতি বোধের পরিচয় রেখেছেন যা নাটকের সঙ্গে সাযুজ্যমান।
তবে আলোক পরিকল্পনায় ফাইয়াস রাকিন নূরের আরও মনোযোগ ও পরিশ্রমের প্রয়োজন দাবী করে। পোশাক পরিকল্পনায় অমিত চক্রবর্তী ও মধুলিকা মন্ডল যথেষ্ট চরিতানুগ। রূপসজ্জায় সেলিম চৌধুরী ভালো। প্রস্থেটিক মাস্কে স্বর্ণা ভৌমিকের আরও মনোযোগ প্রয়োজন, কারণ এই মাস্কটি পুরো নাটকের ট্র্যাজেডির বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। পোস্টার ও অলংকরণে দীপংকর দস্তিদার ও মোরশেদ হিমাদ্রী হিমুর পরিমিতির প্রকাশ প্রশংসনীয়।
নাটকের শুরুতে পালার দৈর্ঘ্য কি আরেকটু হ্রাস করা যেত? পালার অভিনেতাদের মধ্যেও আরও সামঞ্জস্য প্রয়োজন। তেমনি সংগীতেও আরো পরিমিতি প্রয়োজন। কয়েকটি দৃশ্যে উচ্চশ্রুত বোধ হয়েছে।
সবমিলে প্রতিভাসের জায়া প্রজায়িনী একটি মানসম্পন্ন প্রযোজনার সাক্ষর রেখেছে। দলের প্রতি আমাদের প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা।