আজ ৩৩তম বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। জাতিসংঘের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়– ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ বিকশিত নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে প্রতিবন্ধী জনগণ।’ এই বিরাট বিশ্বে সকল মানুষই চায় ভালোভাবে, সুন্দর ও মুক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকতে। তবে সুন্দর মুক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকার সুযোগ সকলের নেই। সমগ্র মানব সমাজের মানুষ, নানাভাবে আমাদের দেশের জনগণ বিভিন্ন সমস্যায় দিন যাপন করছে। কারো মনে সুষ্ঠু চিন্তার পরিবেশ, প্রতিবেশ নিয়ে এক অস্থিরতার জীবন যাপন বহন করে যাচ্ছে। সবকিছু অন্তরের সাথে অন্তরের দূরত্ব ক্রমেই বেড়ে চলছে, বিশ্বের সমগ্র মানব সমাজে মাত্র ১০ শতাংশই এই সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করতে পারে, প্রাশ্চাত্যের মনীষী ক্লাইভ বের একদা বলেছিলেন, ‘সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নামই সংস্কৃতি’ তাই একেক সময় নিজের মনে নিজেকে জিজ্ঞাসা করি–যারা ভালোভাবে সুন্দর পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে না তারা কি সংস্কৃতি বর্জিত? তারা কি মানুষ নয়, অন্য গ্রহের জীব? এটা যদি মান্য করতে হয় তাহলে তো বলতে হবে, প্রতিবন্ধীরা মানুষ নয়। এসব কথা মনে আসে যখন প্রতি বছর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস আসে।
প্রতিবন্ধীদের জন্য যে কেবল আমরাই ভাবছি, তা নয়, বিশ্বের সকল দেশ ও জাতির প্রতিনিধি ‘জাতিসংঘ, এ জন্য ১৯৯২ সাল থেকে জাতিসংঘের আহ্বানে ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে আসছে। তবে আমাদের দেশে জাতিসংঘের নির্দেশ অনুসারে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালিত হচ্ছে ২৪ বছর আগে থেকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী বিশ্বের জনসংখ্যার ১৫% মানুষ ১ বিলিয়ন জনগোষ্ঠী মানুষ প্রতিবন্ধীকতার স্বীকার এসব প্রতিবন্ধীর কেউ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, কেউবা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, কেউ বা শারীরিক, এদের মধ্যে কেউ কেউ জন্মগত, কেউ বা রোগাক্রান্ত, কেউ বা দুর্ঘটনার কারণে প্রতিবন্ধী হয়েছে।
কেউবা সুচিকিৎসার অভাবে প্রতিবন্ধী, কেউ বা শিশুকালে দুরারোগ্য রোগে ভুগে দৈহিক বা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়েছেন, কারো নেই শ্রবণ ক্ষমতা, কিংবা স্বাভাবিকভাবে চলবার শক্তি কারো রয়েছে বোধ শক্তির অভাব, প্রতিবন্ধিত্বের কারণে এদের জীবন হয়েছে অভিশপ্ত। এরা স্বাভাবিক জীবন–যাপনের সক্ষমতা থেকে বঞ্চিত পরিণামে এরা হয়ে পড়েছেন পরিবার, সমাজ ও দেশের গলগ্রহ। অথচ এদের জন্য যদি চিকিৎসা, আশ্রয়, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সমাজভিত্তিক পুনর্বাসন নিশ্চিত করা যায় তাহলে এরাও আর দশজনের মতো কর্মক্ষম হতে পারে এবং পরিণত হতে পারে মানব পুঁজিও দেশের সম্পদ। সারাবিশ্বে মধ্যে ৪৫০ মিলিয়ন মানুষ মানসিক বা স্নায়ু রোগে ভুগছে। এদের বেশির ভাগ মানুষ তাদের এ সমস্যা ও অর্থনৈতিক কারণে ডাক্তার/হাসপাতালে আসতে পারেনা, রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের দায়িত্ব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান, প্রতিবন্ধীদের জন্য সামগ্রিক কল্যাণ ও উন্নয়নে সহযোগিতা অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
যেসব প্রতিবন্ধী ছাত্র–ছাত্রী, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বা পাস করেছে, ওরা প্রতিবন্ধী নই প্রতিযোগী, সরকারি চাকরিতে যথাযথভাবে চাকরি পায় এবং চাকরিতে তাদের অধিকার নিশ্চিত হয় নীতি মালায় সে ব্যবস্থাটা অবশ্যই করতে হবে সরকারকে। তাদের জীবন সংগ্রামে এতটুকু আসা চারটি খানি ব্যাপার নয়, জীবন যুদ্ধে ওরা দেশমাতৃকা স্বরূপ কাজ করতে চাই, বিশ্লেষকরা বলেছেন, উন্নত চিকিৎসা, শিক্ষা, নানামুখী প্রশিক্ষণ ও সুযোগ প্রাপ্তির মাধ্যমে প্রতিবন্ধীরাও দেশের সমৃদ্ধিতে শামিল হতে পারে, বিশ্বজুড়ে এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। প্রতিবন্ধীরা সমাজ ও উন্নয়নের প্রতিবন্ধক নই বরং অংশীজন। আমাদের দেশে রাষ্ট্র প্রধান বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এ জনগোষ্ঠির কল্যাণে অঙ্গীকারবদ্ধ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণ ও উন্নয়নে অধিকার ও সুরক্ষা আইন পাস হয়। প্রতিবন্ধীতা থাকার পর ও প্রতিবন্ধকতা জয় করে যারা সফল হওয়ার লক্ষ্যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা উদ্যোগও গ্রহণ করতে হবে। প্রতিবন্ধী উদ্যোক্তা তাদের ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণ সহজ করণ সুদের হার ৪% করা যায় অনেক প্রতিবন্ধী উদ্যোক্তা হয়ে নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বা অন্যজনকে চাকরিজীবী করা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারবে। আইনটি পাস করে কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি। জাতীয় উন্নয়নে প্রতিবন্ধীদের অংশ গ্রহণে কোন ভেদাভেদ থাকা সমীচীন নয়। উন্নয়নের যাত্রা সাম্য ও অভিন্ন হলেও চলে না। তাই উন্নয়নের যাত্রায় প্রতিবন্ধীদেরও সামিল করতে হবে। তাঁদের সামর্থ ও সক্ষমতা অনুযায়ী কিছু কিছু দায়িত্ব দিতে হবে। এতে প্রতিবন্ধীরাও জনসম্পদে পরিণত হবে।
প্রতিবন্ধীরাও যে বিশ্ব সম্পদ ও যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হতে পারে, এবং ঈর্ষণীয় ব্যক্তি হতে পারে তার দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসে অনেক রয়েছে। গ্রীক মহাকাব্যের স্রষ্টা খ্রিষ্টপূর্বে যুগের মহাকবি হোমার ছিলেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। ইতিহাস খ্যাত যোদ্ধা তৈমুর লঙ ছিলেন কবুজ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সংগীত স্রষ্ঠাদের অন্যতম বিটোফেন ছিলেন শ্রবণ প্রতিবন্ধী। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার চার বছর আগে সাহিত্য নোবেলজয়ী লরিয়েট সেলমা নাগারেফ শৈশবে দুরারোগ্য রোগে ভুগে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। চিত্রশিল্পী তুলে লোত্রেকের দুইটা পা ছিল না। অলিম্পিকের সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণপদক বিজয়ী মার্কিন সাতারু ব্রায়ান ফেল্পস ছিলেন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। এ যুগের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ছিলেন প্রতিবন্ধী। এ ধরনের কিছু ব্যক্তিত্ব আমাদের দেশেও হয়ত বা আছেন। প্রকৃতপক্ষে প্রতিবন্ধীদের প্রয়োজনীয় সুবিধা আর মানবাধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠা করা গেলে যে কোনো কর্মক্ষম অর্থাৎ বিনামূল্যে (বাণিজ্যিক নয়) শিক্ষা নানামুখী কারিগরী বিদ্যা দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণ, ছাত্রাবাস সুবিধাসহ ব্যবস্থা করা গেলে, অনেক প্রতিবন্ধী জীবন যুদ্ধে স্বনির্ভরশীল হয়ে উঠবে। তারা করুণার পাত্র বা কারো গলগ্রহ না হয়ে শুধু দেশের নয়, বিশ্বের ও বরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পারে। সবদিকে বিবেচনায় প্রতিবন্ধীদের সমাজের মুল স্রোতে সম্পৃক্ত করে দেশের উন্নয়নের অংশীদার করার জন্য তাদের জীবনমানের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সক্ষম ও স্বচ্ছল ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান এবং সুশীল সমাজসহ সকলকে নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
স্টিফেন হকিং এর উল্লেখযোগ্য উদ্বৃত্তি–
আমি এখনও বড় হইনি, আমি এখনও প্রশ্ন করতে থাকি, যারা বুদ্ধিসত্তা নিয়ে বড়াই করেন, তারা আসলে হেরে গেছেন। জীবন এমন এক শক্তি যা আপনাকে পরিবর্তনে স্বীকার করতে শেখায়, রাগ মানুষের সব থেকে বড় শত্রু, সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতে পারে এই ক্রোধ, যে সমস্ত মানুষেরা ভবিষ্যৎকে বিশ্বাস করেন তারাই রাস্তা পার করার সময় বার বার দুদিকে তাকান, কেউ যদি বলে আপনি ভুল করেছেন, তাকে বলবেন ভুল করার দরকার। ভুল না করলে আমি আপনি কেউই বেঁচে থাকব না।
মানুষ কথা বলেই সবচেয়ে বেশি সাফল্য লাভ করে, মানুষের ব্যর্থতার কারণও এই আলাপচারিতা, তবে কথা বার্তা চালিয়ে যাওয়া উচিত। আপনার শারীরিক বাধা কখনও ভালো কাজে বাধা হতে পারে না। শারীরিক সীমাবদ্ধতার জন্য কখনও অনুতাপ করবেন না। কাজ করার উদ্যমে বৈকল্য থাকা সব থেকে খারাপ। দেশের মাটিকে শ্রদ্ধা সম্মান করা আকাশের দিতে তাকাও, কাজ করতে থাকো কারণ কাজই জীবনের প্রাসঙ্গিক করে তোলে। আর যদি কপাল করে জীবনে ভালোবাসা পাও তাকে ছুড়ে ফেল না। স্টিফেন হকিং জীবনযুদ্ধের অংশ নেয়া এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী, তিনি যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। পারস্পরিক অবিরাম সন্দেহ হিংসা, যুদ্ধ কেড়ে নিচ্ছে মানবিক গুণাবলী; হকিং সৌন্দর্যময় অফুরান প্রাণ স্পন্দনে ভরা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে মানুষ কর্মে, সৃজনে উদ্ভাবনে মুখর থাকবে।
মানুষের তৈরি পারমানবিক অস্ত্র, বিষ্ফোরণ, কুটকৌশল থেকে দূরে গিয়ে ভালোবাসায় বিশ্ব তৈরিতে মনীষী স্টিফেন হকিং ও জেএনআই স্যারের তত্ত্ব, তথ্য অন্তহীন এক প্রেরণা তাঁদের তত্ত্ব কথাগুলো আমাদের দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কল্যাণ ও প্রতিবন্ধী প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে রাষ্ট্র প্রধান সার্বিক সহযোগিতা গ্রহণ করলে প্রতিবন্ধীরা প্রতিযোগী হবেই।
লেখক: কনসার্ন সার্ভিসেস ফর ডিসঅ্যাবেলড (সিএসডি)’র সম্পাদক।