প্রতিবন্ধী ও প্রতিবন্ধকতা

আয়েশা পারভীন চৌধুরী | বৃহস্পতিবার , ১ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ

 

 

কাতারে অনুষ্ঠিত ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনে প্রতিবন্ধী ও প্রতিবন্ধকতা বিষয়টি সারা পৃথিবীতে আলোচিত ও সমাদৃত হয়েছে। সকলের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি একজন প্রতিবন্ধী মানুষের ব্যক্তিগত প্রতিবন্ধকতা দূর করে। সাধারণত প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের আনন্দ আয়োজন ও আলাপ আলোচনা করার ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এই অনুষ্ঠানগুলো সাজানো হয়। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে এই অনুষ্ঠানগুলোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে ; সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদেরকে সহযোগিতা করা। যারা সম্পুর্ণ সুস্থ তারা খুব সহজে প্রতিবন্ধী শব্দটা উচ্চারণ করে। তারা প্রতিবন্ধীদের সামনে বার বার যখন এই শব্দটি উচ্চারণ করতে থাকে তাদের মাঝে তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। সুন্দর সাবলীলভাবে বলতে থাকে। কিংবা পাশে থাকা প্রতিবন্ধী মানুষের মাঝে প্রবল বেগে আঘাত করে। শুনতে পেয়েও তারা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে না। বার বার বুকে কেমন যেন ধাক্কা আসে। কানে ও গলায় এই প্রতিবন্ধী শব্দটি বাজতে থাকে। এই শুনা থেকে তখন তারা মুক্তি চায়। মেনে নিতে কষ্ট হয়। তবুও মেনে নেয়। এগিয়ে যায়। প্রতিবন্ধীদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যরাও ঠিক এভাবে মানসিক ভাবে কষ্টকর জীবন যাপন করে। এমতাবস্থায় সমাজের সকলের উচিৎ; সকল ধরনের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তাদের পরিবারকে মানসিকভাবে সাহস দেওয়া। জীবন চলার পথে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের পাশে থাকা। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে যুক্ত করা। পবিত্র কোরআন শরীফে বার বার সত্যত্যাগী ও অবিশ্বাসীদেরকে অন্ধ ও যারা কানে শোনে না অর্থাৎ কালা তাদের সাথে তুলনা করা হয়েছে। বার বার এই তুলনার মাধ্যমে সত্য ত্যাগী ও অবিশ্বাসীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। এখানে মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের চারিত্রিক দোষত্রুটির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন; যদিও তাদেরকে বিবেক এবং বুদ্ধি দিয়ে যথেষ্ট গুনাগুলির অধিকারী করেছেন তবুও তারা জেনে শুনেই সত্য ত্যাগ করেছে। মিথ্যাকে চলার পথের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করেছে। অবিশ্বাসীরা বার বার একজন অন্ধ এবং কালার মতই কাজ করে যায় অর্থাৎ তারা চোখ থাকতেও অন্ধ এবং কান থাকতেও কোনও ভালো জিনিস তাদের কানে পৌঁছে না। আমাদের মহানবী রাসুল (সাঃ) সহ পূর্বের যত নবী রাসূলগণ ইসলাম প্রচার করতে গিয়েছে ততোবারেই সত্য ত্যাগী ও অবিশ্বাসীরা ইসলাম ধর্মের বিরোধিতা করেছে। পবিত্র কোরআন শরীফের অমান্য করেছে। মহানবী (.) ও অন্যান্য নবীদেরকে জাদুকর হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। তারা নিজেদের চোখে সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে যায়। তারা কানে সব কিছু শুনেও না শোনার ভান করে। এই তুলনার মাধ্যমে মহান আল্লাহতালা একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যারা অন্ধ এবং কালা তারা হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টি। পবিত্র কুরআন শরীফের সুরা আল বাকারাহর ১৮নং আয়াতে এই তুলনাটি দিয়ে সত্যি কারের প্রতিবন্ধীদের সাথে সবল সুস্থ মানুষের মাঝে পার্থক্য দেখিয়েছেন। পবিত্র কুরআন শরীফে এভাবে বার বার তুলনা করা হয়। যারা প্রতিবন্ধী তাদের এমন অবস্থার জন্য তাদের কোনও হাত নেই। মহান আল্লাহ তায়ালা নিজের ইচ্ছায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সৃষ্টি করেছে। সকল সামর্থ্য থেকেও যারা তাদের সামর্থ্যকে কাজে লাগায় না তাদেরকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সাথে তুলনা করার অর্থ হচ্ছে তারাই বাস্তবে প্রতিবন্ধীর মতই। কিন্তু প্রতিবন্ধীরা তাদের অক্ষমতার জন্য আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে বিবেচিত। আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছে যারা সকল ক্ষমতা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের সেই ক্ষমতা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগায় না। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পূর্বে যত নবী রাসূল পৃথিবীতে এসেছিলেন সবাই ধর্ম প্রচার করে গেছেন। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ইসলামকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা কিন্তু যারা এর বিরোধিতা করেছে তাদেরকে মহান আল্লাহতালা প্রতিবন্ধী হিসেবে ব্যক্ত করেছেন। বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ হয়েও অবিশ্বাসীরা ও সত্যত্যাগীরা সত্য ও ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করতে পারে না। সম্পূণরূপে বিরোধিতা করে গেছে। পবিত্র কোরআন শরীফে এই সমস্ত ব্যক্তিকে শেষ বিচারের দিনে মহাশাস্তির জন্য সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে যারা শারিরীক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী তাদের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ তায়ালা আখেরাতে ও পরকালে বিশেষ বিবেচনা রেখেছেন।

কাতারে অনুষ্ঠিত ২০২২ এর বিশ্ব কাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের শুরুতে একজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ২০ বছরের যুবক ঘানিম আল মুফতাহকে দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। সেই যুবক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন। ঘানিম আল মুফতাহ একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। মাতৃ গর্ভে থাকা অবস্থায় তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ধরা পড়ে। ডাক্তাররা গর্ভপাত করে বাচ্চা নষ্ট করে ফেলার জন্য মা বাবাকে অনুরোধ করেন। জন্মের পর থেকে সেই বাচ্চার জন্য পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সকলকে অনেক ধরনের অবহেলা লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে। ২০ বছরে অনেক অনেক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সেই যুবক আজকের বর্তমান অবস্থানে এসেছে। ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে সুরা আল রাহমান তেলাওয়াত করে ২০ বছর বয়সে এই প্রতিবন্ধী যুবক।

কাতারের শান্তির দূত হিসেবে পরিচিত এই ঘানিম আল মুফতাহ বর্তমানে সারা বিশ্বে পরিচিত একজন মানুষ। অথচ সেই শৈশবের খেলার মাঠ ও স্কুল আঙ্গিনায় তাকে পদে পদে লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে কীভাবে সামনে এগিয়ে যেতে হয় এই শিক্ষায় দিয়েছে কাতারের শান্তির দূত হিসেবে পরিচিত এই প্রতিবন্ধী যুবক। প্রতিবন্ধকতাকে কিভাবে জয় করতে হয়সে বিষয়টি বিশ্বকে দেখিয়েছে। উপযুক্ত সমর্থন সহযোগিতা ও একাগ্রতা থাকলে মানুষ যে কোনও ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারে। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য খেলাধুলা ও বিভিন্ন আয়োজন করার মাধ্যমে তাদেরকেও অনুপ্রেরণা দেওয়া হয়। এই একটা দুইটা দিনে গঁদবাধা কিছু অনুষ্ঠান আয়োজনে অতিথিদের বিশেষ বিশেষ বিশেষণ ও তাদের নাম প্রকাশিত ও প্রচারিত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে আনাচে কানাচে অনেক প্রতিবন্ধী মানুষ আছে যারা উপযুক্ত সাহায্য ও সহযোগিতার অভাবে তাদের সুপ্ত প্রতিভাগুলো প্রকাশিত করতে পারে না। প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিবন্ধকতা দূর করার আগে সমাজের সুস্থ সবল মানুষগুলোর প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। শারীরিক ও মানসিকভাবে সকল ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা সকল মেধা ও মননকে অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িয়ে রাখে। সমপ্রতি একজন প্রতিবন্ধী রিঙা চালকের রিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। কয়েকজন শক্ত সামর্থ্য ব্যক্তি মিলে ওই প্রতিবন্ধী রিকশা চালককে খুন করে। আমাদের সমাজে অনেক প্রতিবন্ধী মানুষ উপযুক্ত সুযোগ ও সহযোগিতার অভাবে এগিয়ে যেতে পারে না। বিশেষ করে আমাদের স্কুল, কলেজ, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী আছে।

শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে সফলতার সাথে শিক্ষা জীবন শেষ করে। কিন্তু চাকরি জীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা অনেক ক্ষেত্রে অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু মানসিক প্রতিবন্ধীবাচ্চাদের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে তীব্র অটিজমের বাচ্চাদেরকে নিয়ে পরিবারকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। তবুও এই বাচ্চাদের নিয়ে পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের জীবন সংগ্রাম থেমে থাকে না। পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন ধারায় আমাদের অবহেলিত বঞ্চিত প্রতিবন্ধীদের সুযোগ দিতে হবে। তাদেরকে মূল স্রোতধারায় এনে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের পথে চালিত করার সময় এসেছে। যে যার অবস্থানে থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ।

লেখক: কলামিস্ট; অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ,

ডা. ফজলুলহাজেরা ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরবীন্দ্রনাথের ভুল
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ