৩ ডিসেম্বর। জাতিসংঘ এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে ৩৪ বছর আগে। এই দিনটি এলেই আমার উপরে উল্লেখিত কথাগুলো মনে পড়ে। আমার মনে হয়-আমরা প্রতিবন্ধীরাও মানুষ। প্রতিবন্ধী নই। আমাদের অনেকেরই এই সমাজে প্রতিযোগিতা করে সমাজকে, জাতিকে, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। অতি সম্প্রতি কল্পবিজ্ঞান লেখক ও বিদগ্ধ অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালের লিখিত প্রতিবন্ধী নই-মানুষ শিরোনামের একটি লেখায় তিনি বলেছেন, ‘আমার মনে হলো, হয়ত প্রতিবন্ধী শব্দটাই নতুন করে ব্যাখ্যা করা দরকার, তার কারণ একজন একদিকে প্রতিবন্ধী হলেও অন্যদিকে তারা সেটি পূরণ করে নিতে পারে, আমাদের শুধুমাত্র সেই সুযোগটি করে দিতে হবে।’ শ্রদ্ধাভাজন জাফর ইকবাল এ প্রসঙ্গে লেখাটিতে তাঁর দেখা একাধিক দৃষ্টান্তও তুলে ধরেছেন।
শ্রদ্ধেয় ইকবাল স্যারের কথা শিরোধার্য করার মতো। কোন না কোন কারণে কোন মানুষ প্রতিবন্ধী হলে সে যে বড়, মহৎ বা স্মরণীয় কাজ করতে পারবে না-এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রতিবন্ধী হয়েও যে চিরস্মরণীয় কাজ কিরার দৃষ্টান্ত বহু-পাওয়া যায়। আমরা সকলেই জানি গ্রীক মহাকাব্য ‘ইলিয়ড’, ‘ওডিসি’র স্রষ্টা হোমার ছিলেন জন্মান্ধ, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠদের অন্যতম বিটোফেন ছিলেন শ্রবণ প্রতিবন্ধী, হেলেন কিলার ছিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। সুইডেনের নোবেল লরিয়েট সালমা লাগারেফ শৈশবে দুরারোগ্য রোগে পঙ্গু হয়ে গেলেও বিশ্বে তিনিই প্রথম মহিলা যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি যন্ত্রচালিত ঘোড়ায় চড়ে স্কুলে-কলেজে লেখাপড়া করে শিক্ষয়িত্রী হয়েছিলেন। পরিবারের বোঝা হননি। লাগায়েফ তাঁর কলের ঘোড়ায় চড়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরে ঘুরে পশু পাখিদের একত্রে অবস্থানিক মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করে বিশ্লেষণী মনোবৈজ্ঞানিকের ভাষায় লিখে ফেলেন বিখ্যাত বই দি ‘ওয়ান্ডারফুল অ্যাডভেঞ্চার অব নিলস’। এভাবে আরও অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। আমাদের কালেও আমরা দেখছি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকে। শারীরিক প্রতিবন্ধিকতা হয়েও কেবল একটি সচল আঙুলে কম্পিউটার চালিয়ে আবিষ্কার করেছেন মহাকাশের হাকাশের নিগুঢ় তত্ত্ব। বস্তুত মানুষের প্রতিবন্ধকতা থাকলেও শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ, থাকলেও সুযোগ, উৎসাহ প্রেরণা পেলে প্রতিবন্ধী মানুষ কাজের মানুষ হয়ে যায়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের দেশে সে সব সুযোগ নেই। প্রতিবন্ধীদের এখনও অস্বাভাবিক মানুষ হিসেবে অ-প্রতিবন্ধী মানুষেরা দেখতে অভ্যস্ত কী সমাজে, কী পরিবারে। এ কারণে প্রতিবন্ধীরাও নিজেদের অনেকেই সমাজবিচ্ছিন্ন মনে করে থাকে। এ জন্যে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে না। সর্বদা সন্ত্রস্ত্র হয়ে থাকে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে প্রতিবন্ধী মানুষ হবে শতকরা ১৫ জন। অথচ সত্তরের দশকেও ছিল শতকরা ১০ জন। এর অর্থ বিশ্বে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এই পরিসংখ্যান থেকে অনুমান করা যায়, আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ১৫ শতাংশের বেশি বৈ কম নয়। কারণ যে দেশ যত বেশি দরিদ্র সে দেশে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বেশি হয়। যদি ধরেও নিই বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী তাহলেও বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় দু’কোটি চল্লিশ লাখ। এই বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী সমাজের মূল ধারার সঙ্গে একীভূত বা আত্মিকরণ করা না গেলে ঈন্সিত সমাজ উন্নয়ন তো হবেই না, উপরন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নও হবে না। এ বিশাল জনগোষ্ঠী মানবসম্পদে পরিণত হতে পারবে না। এ কথা টি স্মরণ করে দেয়া হয়েছে চলতি বছরের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের ‘স্লোগান’ বা ‘থিমের’ মধ্য দিয়ে।
আজ আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে মানুষ হিসেবে প্রতিবন্ধীদের সমধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নানাদিক থেকে ভাবনা চিন্তা করা হয় এবং এই জন্যেই দিবসটি পালনে একটি ভাবনার বিষয়বস্তু বা মর্মবাণী (Theme) আকারে আলোচনার জন্য নির্ধারিত হয়। এ বছর আলোচন্য বিষয়-FOSTERING DISABILITY INCLUSIVE SOCIETIES FOR ADVANCING SOCIAL PROGRESS (বাংলায়-প্রতিবন্ধিতা অন্তর্ভুক্তমূলক সমাজগড়ি, সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করি।)
মোদ্ধা কথা, প্রতিবন্ধী নই মানুষ-এ ভাবনা নিয়ে একটি সমাজ গড়ে তোলার যেসব বাধা রয়েছে সেগুলো দূর করতে হবে। এটা করতে গেলে বিরাজমান বাধাগুলো শনাক্ত করে সেগুলি দূর করতে হবে সরকারিও বেসরকারি পর্যায়ের কর্মপ্রয়াসের মাধ্যমে। বাধাগুলো দূর করতে না পারলে প্রতিবন্ধীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস যেমন গড়ে তুলতে হবে তেমনি অপ্রতিবন্ধীদের মধ্যেও প্রতিবন্ধীদের তাদের মতো, সমাজের আর দশজন মানুষের মতো মানুষ হিসেবেই ভাবতে হবে এবং এটা হতে হবে স্বভাবজাত, আরোপিত নয়। এটা প্রাথমিক কাজ। এজন্য চাই জনসচেতনতা বৃদ্ধি। আমাদের মধ্যে সেটা নেই।
অপ্রতিবন্ধীরা এখনও প্রতিবন্ধীদের করুণার চোখে দেখে। এতে চলবে না। এদের মানুষ হিসেবেও সমপর্যায়ের মনে করতে হবে। জনসচেতনা বাড়ানো গেলে এটা অনেকটা সম্ভব হবে।
আসলে সকলের সম্মিলিত প্রয়াস ও কাজ অসম্ভবও সম্ভব হয়, ইংরেজ কবি মিল্টনের ”Paradise lost’ -এর কথায় বলা যায় ”United we stand, divided we fall’ । একতাই শক্তি, একতাই বল। ঐক্যবদ্ধ হয়েই আমাদের প্রতিবন্ধীদের মানুষ পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে। তাদের মর্যাদা অর্জনের সকল বন্ধ দুয়ার খুলে দিতে হবে, গড়ে তুলতে হবে একটি সমাজ যে সমাজ মানব সমাজ যাতে প্রতিযোগিতা থাকলেও ‘থাকবে না প্রতিদ্বন্দ্বী, অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভেদাভেদ। এই শিক্ষায় দিচ্ছে আমাদের ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। জয় হোক মানুষের।
লেখক: কনসার্ন সার্ভিসেস ফর ডিসঅ্যাবেলড (সিএসডি)’র সম্পাদক












