৩ ডিসেম্বর। আজ স্মরণযোগ্য একটি দিন। কারণ এদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩২ বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। এবারের দিবসের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ডিসেম্বরের তৃতীয় দিনে প্রতিবন্ধী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সংস্থার সদস্য দেশগুলোর প্রতি দিনটি পালনের আহ্বান জানায়। সেই হিসেবে এবার আমাদের দেশে ২৫তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস পালিত হবে। প্রতি বছর দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য এককটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাথে সম্মিলিত অংশগ্রহণ, নিশ্চিত করবে এসডিজি অর্জন’।
এই পৃথিবীতে সব মানুষ চায় সুন্দর ও মুক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকতে। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন পাঁচটি মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই সুযোগ এখনো পর্যন্ত সবার নেই। মানবসমাজের মাত্র ১০ শতাংশ এই সুবিধা পাচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান উল্লেখ করা যেতে পারে। পরিসংখ্যানটি জানাচ্ছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ প্রতিবন্ধীতার শিকার। বৃহৎ এই জনগোষ্ঠী শারীরিক–মানসিক নির্যাতন, বৈষম্য, দয়া–দাক্ষিণ্য, করুণা ও অনুকম্পার ওপর ভর করে জীবন নির্বাহ করে। তবে ২০০৭ সালে জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী সনদ পাওয়ার পর দেশে এ সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। ২০১৩ সালের ১৬ জুলাই এই সম্পর্কে একটি বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়। ৩ অক্টোবর পাস হয়। ৯ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেন। তবে প্রতিবন্ধীদের জনসম্পদে রূপান্তর করতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য এখনো যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। প্রতিবন্ধীদের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য নিচের বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য।
শনাক্তকরণ : সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পরিসংখ্যান ও উপাত্ত সংগ্রহের নিমিত্ত জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়নি। না জানার কারণগুলো চিহ্নিত করা দরকার। প্রতিবন্ধী হতে পারে এমন শিশুকে শনাক্তকরণে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। ২০১৬ সালে সরকারিভাবে জরিপ হলে ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরশেনের ১ নং ওয়ার্ডে অনেক প্রতিবন্ধীর সুবর্ণ নাগরিক কার্ড আসেনি। রাষ্ট্রীয়ভাবে তার তদারকি করা প্রয়োজন। প্রতিবন্ধীদের সামগ্রিক কল্যাণে সরকার আন্তরিক। জেলা–উপজেলায় কর্তব্যরত সমাজসেবা কার্যালয় ও প্রতিবন্ধী সংগঠন এগিয়ে এলে শনাক্ত করা সহজ হবে।
চলন : প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং কর্মরত সহায়ক কর্মীদের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চলনের কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দানের পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রবেশগম্যতা : প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নিজেরা যাতে সর্বোচ্চ স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে সেজন্য অবকাঠামোভাবে সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে উঁচু ভবন ও অফিসগুলোয় র্যাম্প সুযোগ নেই বললেই চলে। সমাজসেবা কার্যালয়, সিভিল সার্জন কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের অফিস, জেলা পরিষদ কার্যালয়সহ বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যালয়ে প্রতিবন্ধী বিষয়ক সভা–সেমিনার হলেও যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় শারীরিক প্রতিবন্ধীদের অংশ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ভবন, সড়ক, যানবাহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসন, কর্মস্থলসহ সর্বক্ষেত্রে যাতে প্রতিবন্ধীরা সুবিধাবঞ্চিত না হয় এতে বিশেষভাবে নজরদারি জরুরি।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ : প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যাতে ব্যক্তিত্ব, মেধা, সৃজনশীলতা, নিয়ে একটি মুক্ত সমাজে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে, এর জন্য সার্বিক একীভূত শিক্ষার উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে কার্যকর পরিবেশ তৈরি করতে হবে। যাতে এদের সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক, শিক্ষাগত ও সামাজিক বিকাশ ঘটে। প্রতিবন্ধিতার ধরণ ও লিঙ্গ অনুযায়ী চাহিদার ভিন্নতা বিবেচনায় সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা এবং বিদ্যমান কারিগরি–বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা। প্রতিবন্ধীদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বৃত্তিমূলক ও পেশাগত পুনর্বাসন, কর্ম ধরে রাখা এবং পুনরায় কাজে যোগ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।
কর্মসংস্থান : যথাযথ নীতিমালার আওতায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য উপর্যুক্ত কর্মক্ষেত্র শনাক্তকরণসহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। কর্মস্থলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চাহিদার ভিন্নতা বিবেচনায় উপযোগী পরিবেশ ও সুযোগ–সুবিধা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রতিবন্ধীদের মধ্যে যাতে বৈষম্য সৃষ্টি না হয় সেজন্য সরকারের সতর্ক দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। কারণ আমাদের দেশে বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। সরকারি–বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত স্কুল–কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী প্রতিবন্ধীদের বিনামূল্যে পড়ালেখার সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিশ্বের সব দেশ ঘটা করে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালন করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের দিবসটি পালন করতে গিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। কারণ ওই সময়ে সব স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা চলে। ফলে অনেক প্রতিবন্ধী দিবসটিতে অংশ নিতে পারে না। তাই সরকারের কাছে অবেদন, জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি বাধ্যতামূলক করা কিংবা ওই দিন পরীক্ষা না রাখা। এতে শিক্ষক–শিক্ষার্থীরাও দিবসটিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে।
সামাজিক নিরাপত্তা : প্রতিবন্ধীদের, বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারী, কন্যাশিশু ও প্রবীণদের সামাজিক–রাষ্ট্রীয় সুরক্ষামূলক ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করলে আর্থিক সক্ষমতা অর্জন করা সহজ হবে।
ক্রীড়া–সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও বিনোদন : প্রতিবন্ধিতার ধরন উপযোগী নাটক, মঞ্চনাটক, চলচ্চিত্র, শিক্ষামূলক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, সংবাদ প্রস্তুত ও সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা। একইসঙ্গে খেলাধূলার মাধ্যমে চিকিৎসার (Play Therapy) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। বিশেষ সুযোগ–সুবিধার মাধ্যমে প্রতিটি উপজেলায় প্রতিবন্ধী ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা সময়ের দাবি।
সচেতনতা : শৈশব থেকে সব শিশুর মধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকারের প্রতি সম্মানমূলক মনোভাব গড়ে তুলতে পাঠ্য–পুস্তকে বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্তিসহ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে পদক্ষেপ নিতে হবে।
সংগঠন : প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নেতৃত্ব বিকাশের জন্য জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংগঠন ও সহায়ক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ দান এবং সংগঠনসমূহের প্রতিবন্ধীদের জন্য আর্থিক সহায়তা রাষ্ট্রীয়ভাবে করতে হবে। প্রতিবন্ধী বিষয়ক সংগঠনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। একইসঙ্গে প্রতিবন্ধীদের যেকোনো শিক্ষা কার্যক্রমকে বাণিজ্যিক লক্ষ্য থেকে মুক্ত রাখতে হবে। হতদরিদ্র প্রতিবন্ধীদের দারিদ্র দূরীকরণে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আধুনিক বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিকল্প নেই। তাদের জন্য সুন্দরভাবে কাজ করা গেলে সর্বক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীরা প্রতিযোগী হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে।
সরকারও হতদরিদ্র প্রতিবন্ধীদের দারিদ্র দূরীকরণে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। নানা কারণে হয়তো অপরিহার্য কাজগুলো এগিয়ে নিতে দেরি হচ্ছে। আগের তুলনায় এখন সরকার প্রতিবন্ধী হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক ও মানসিক অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসব প্রতিবন্ধীর কেউ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, কেউবা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, কেউ অটিস্টিক, কেউ শারীরিক। এদের মধ্যে কেউ কেউ জন্মগত, কেউ রোগাক্রান্ত, কেউবা দুর্ঘটনার কারণে প্রতিবন্ধী হয়েছে। আগামীকাল সূর্যোদয়ের আগে যে আমি প্রতিবন্ধী হব না এ কথা কেউ বলতে পারে না। তাই প্রতিবন্ধীদের অনুভব করতে হবে। তাদের নিয়ে ভাবার, সত্যিকার অর্থে তাদের কল্যাণে কাজ করতে হবে।
মহাকবি হোমার ছিলেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। এ যুগে এসে আমরা পেয়েছি বৈজ্ঞানিক স্টিফেন হকিংকে। প্রতিবন্ধীদের কাজে, কর্মে ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে পরিবেশ, প্রতিবেশ বড় ফ্যাক্টর। এরা সুযোগ পেলে বড় হওয়ার ইচ্ছাশক্তি ফিরে পাবে।
এবারের প্রতিবন্ধী দিবসে কনসার্ন সার্ভিসেস ফর ডিসঅ্যাবেলড (সিএসডি) ৭টি উপজেলার প্রতিটিতে হতদরিদ্র প্রতিবন্ধীদের ৬টি করে হুইল চেয়ার ও দৃষ্টিহীন ছাত্রছাত্রীদের সাদাছড়ি প্রদান, স্বরোজগার প্রকল্প আর্থিক সহযোগিতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষাবৃত্তি, চিকিৎসা সহায়তা অনুদান, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এছাড়া সিএসডি পরিবারের উপদেষ্টামণ্ডলী ও নির্বাহী কমিটির সদস্য ও মানবকল্যাণে নিবেদিত যারা দীর্ঘদিন প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তাদের মায়েদের গ্রামমাতা বা রত্নগর্ভা উপাধি দেওয়া হবে।
সব শেষে বলতে চাই, প্রতিবন্ধীদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে, সম্মিলিত ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে।
লেখক : কনসার্ন সার্ভিসেস ফর ডিসঅ্যাবেলড (সিএসডি)’র সাধারণ সম্পাদক।