তার সংগ্রাম আর সাফল্যের গল্প হাজারো প্রতিবন্ধীকে যুগিয়েছে জীবনজয়ের অনুপ্রেরণা; মায়ের কোলে চড়ে ক্লাসে যাওয়া, অক্লান্ত পরিশ্রম করে কম্পিউটার প্রকৌশলী হওয়া ইমতিয়াজ কবিরের সেই জয়যাত্রা থেমে গেল মাত্র চব্বিশে। ছোটবেলায় পোলিওতে আক্রান্ত হওয়ায় কারো সাহায্য ছাড়া সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন না ইমতিয়াজ। তারপরও পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ আর বাবা–মায়ের ত্যাগের বিনিময়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষ করেন সফলভাবেই। এরপর কম্পিউটার প্রকৌশলী হিসেবে ইমতিয়াজ যোগ দিয়েছিলেন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তিনি আর কখনও অফিসে যাবেন না। ফুসফুসের সংক্রমণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ইমতিয়াজকে ভর্তি করা হয়েছিল চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। বৃহস্পতিবার বিকালে তার মৃত্যুর সাথে শেষ হয়ে গেছে একটি পরিবারের জীবন জয়ের গল্প। তার ফুফাত ভাই মাহমুদুর রহমান বলেন, শুক্রবার (গতকাল) দুপুরে নড়াইলের জামিলডাঙায় দাদাবাড়ির কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে ইমতিয়াজকে। খবর বিডিনিউজের।
গ্রামের বাড়ি নড়াইলে হলেও ইমতিয়াজ কবিরের জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। তার বাবা এনামুল কবীর চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মা ইয়াসমিন নাহার স্কুল শিক্ষক। ইমতিয়াজের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পোলিওতে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে। দেশে ও বিদেশে চিকিৎসা করালেও পা আর ভালো হয়নি। কিন্তু পড়ালেখার প্রতি ইমতিয়াজের ছিল অদম্য আগ্রহ। নানা প্রতিবন্ধকতার পরও তার পড়া থামাননি বাবা–মা। চট্টগ্রাম মহানগরীর পূর্ব মাদারবাড়ির ওমর কলোনি এলাকায় থেকে ছেলেকে সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য সবকিছু করে গেছেন। তার স্কুলবেলার ব্যক্তিগত শিক্ষক নেওয়াজুল নওশাদ বলেন, ‘ইমতিয়াজকে তার মা কোলে করে আমার কোচিংয়ে পড়াতে আনত। খুবই মেধাবী ছিল। প্রাইমারি স্কুল থেকে সরকারি কলেজিয়েট স্কুলে সে ভর্তি হয়। পরে ভালো ফল করে এইচএসসি পাস করে এবং ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানে ভর্তির সুযোগ পায়। তাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করাতে মা–বাবার ভূমিকা প্রশংসনীয়। বিশেষ করে তার মা কষ্ট করে তাকে কোলে করে পড়ালেখা করানোর জন্য নিয়ে যেত। ইমতিয়াজের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে কম্পিউটার প্রকৌশলী হবে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে স্নাতক সম্মান শেষ করে।’
ফুফাত ভাই মাহমুদুর বলেন, ইমতিয়াজের শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় পার হতে তা বাধা হতে পারেনি। পড়ালেখা শেষে ঢাকায় একটি চাকরিও পেয়েছিলেন। ছয়মাস সেখানে কাজও করেছেন। কিছুদিন আগে ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ইমিতয়াজ। সেরে উঠতে না উঠতেই আক্রান্ত হন নিউমোনিয়ায়। খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়, ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। একপর্যায়ে তার মেরুদণ্ডের হাড় বাঁকা হয়ে যায়। মাহমুদুর বলেন, ‘উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যেতে পাসপোর্ট করতে দেওয়া হয়েছিল। পাঁচ দিন আগে শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে আবারও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। সেখান থেকে আর ফেরানো যায়নি।’
বৃহস্পতিবার বিকালে ইমতিয়াজের মৃত্যুর পর থেকেই তার মা ইয়াসমিন নাহার একপ্রকার বাকরুদ্ধ। বাবাও ঠিকমতো কথা বলছেন না। ইমতিয়াজের নবম শ্রেণি পড়ুয়া একমাত্র বোনকে নিয়ে জীবনের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে তাদেরকেই।