প্রতিপাদ্য প্রসঙ্গে

সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ৮ মার্চ, ২০২৫ at ১১:২৫ পূর্বাহ্ণ

মুক্ত স্বাধীন বাতাসের তরে, আর দুটি পলকে তবুও মানুষ নিজেকেই ভালোবাসে, বিহঙ্গের সাথে নিজের ডানা উড়াবার শখ মানুষের পুরানো। ভিঞ্চি এঁকেছিলেন উড়োজাহাজ, পাখির আদলে। কোনো শিল্পী যখন তার ভাবনার রূপ ছায়া ফেলেন কাগজে, মনের ভাবনাকে দেন শব্দে রূপ, তিনি নিশ্চয় দেখেন না কে কার সম্বন্ধ। আমাদের প্রায়শ শুনতে হয়, তোমার বন্ধুমহলে এত ভিন্নধর্মাবলম্বীর মানুষ কেন। আহা, প্রিয়জন আমার! তোমায় কি করে বুঝাই বলো, আগে করেছিলাম বন্ধুত্ব, এরপর দেখেছি মানুষ, এরপর তোমার সুরে জানলাম সে হিন্দু না মুসলমান। বন্ধু হতে আসা হাতকে, লেবাস দেয় যেজন তাকে কি আর বন্ধু ভাবা যায় প্রিয়জন।

প্রতিপাদ্য শব্দকে ভেঙ্গে যদি ভাবি, অন্যের তরে পূর্বশর্ত ছাড়া পালন কর্তব্য সম্বন্ধীয় প্রকল্প। এধরনের প্রকল্প কিংবা পরিকল্পনা করে অনুমেয় কাজ হাতে নেওয়া খুব সহজ ঠেকেছে আজকাল, কিন্তু বাস্তবতায় তার বিনাশর্তে হাজিরা গোনা কষ্টসাধ্য। এবছরও ঘটা করে ‘নারী দিবস’ এসেছে। ৮ মার্চ নারী দিবস, প্রত্যেক বছরেই থাকে বিশেষ কোনো প্রতিপাদ্য। ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন নারী ও কন্যার উন্নয়ন’ মর্মে এবছর নারীর কতটা অধিকার রক্ষা হলো, সমতা ফিরলো কিনা, ক্ষমতায়নের বিশেষ সংজ্ঞা কি? ইত্যাদি আলোচনা এবং গবেষণার বিষয় হতে পারে নিশ্চিত। তবে প্রতিবছরের প্রতিপাদ্যগুলো সহজ বাংলায় রসিকতা মনে হয় যেন, যেখানে পূর্বশর্ত ছাড়া এইসকল কর্ম পালনে প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে, সেখানে মৌলিক অধিকারই এক বিরাট প্রশ্ন। আরো রূঢ়ভাবে যদি বলি, কলুষিত।

১৯০৮ সালে বিশ্ব যখন উন্নতির দিকে সবে যাত্রা শুরু করেছে, অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ থেকে যখন নিউইয়র্ক অনেকটা এগিয়ে তখন পনেরো হাজার নারী রাস্তায় নেমেছে তার ভোটাধিকার, শ্রম অধিকার, বৈষম্য অবসানের লক্ষ্যে। দীর্ঘ বারো ঘণ্টা খেটে, অতিরিক্ত সময়ের মজুরি না পেয়ে বরং যারা কেবল নারী বলে দিনের পর দিন মরছে তারাই নিজেদের সংগ্রামের পথকে রাজপথে মিশিয়েছে। ঘোলা জলকে পরিষ্কার করছে। রাজপথের রাজা, পথ নিজেই। এ পথকে জয়ী করে প্রতিবছরই পালিত হয় ‘নারী দিবস’।

চ্যাটজিপিটি’র কাছে প্রায় সবকিছুর উত্তর আছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বলো তো দেখি বন্ধুজন আন্তর্জাতিক নারী দিবস কিভাবে উদযাপন করা যায়? তার সহসা উত্তর এলো, নারীর অর্জন ও সাফল্যের স্বীকৃতি দেওয়া, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি, কর্মশালা ও সেমিনার আয়োজন, বিশেষ প্রশিক্ষণ, উন্নয়নমূলক কর্মসূচি, প্রচারণাআহা চ্যাটজিপিটি তুমি নিশ্চয় অতি উন্নয়নশীল সেইসব পাশ্চাত্য ঘরনার হাতে তৈরি। তোমাকেও তারা দুশো বছর শোষিত জাতির ইতিহাস পড়ায়নি। ধরেই নিচ্ছি তুমি অনুভূতিশূন্য। তোমাকে ক্ষমা করা গেলো তবে। কেননা তোমার কাছে ওড়নার কনসেপ্ট নূন্য, তুমি বাংলা মাটির গন্ধ পাওনি। তোমাকে বিদায় জানাতে হয়, তুমি ফিরে যেতে পারো।

বাংলা মায়ের আকাশে বাতাসে এখন উড়ছে ওড়না। রঙ বেরঙ্গের ওড়না। কিছুর জমিন সুন্দর, কিছু আবার ব্লকের কাজ, কোথাও আছে হাতের নকশা। তারকোভস্কির কোনো সিনেমার দৃশ্যেও এত সুন্দর পোশাক উড়তে দেখা যাবে না, যতটা সুন্দর করে বাংলার দামাল ভাইয়েরা আমার ওড়না উড়িয়েছে। ওড়না উড়াবারই জিনিস বৈকী। বাংলা সিনেমার দৃশ্যে ওড়নার মাহাত্ম্য অনেক। নায়িকার বদন থেকে ঝড়বাতাসে উড়ে যাওয়া ওড়না, স্নানের সময় গায়ে কেবল ওড়না জড়িয়ে চিটচিটে শরীর, দুগ্ধ পানের উদ্দ্যেশে শিশুর মুখে ওড়না জড়ানো মা, গাড়ি থেকে বড়লোকের বেটি নামতেই ওড়না খসে পড়া, বারান্দায় শুকানো ওড়নায় মুখ মোছা, কখনো বা স্বামীর ঘাম মুছে দিতে ওড়নাএমন হাজারো বিচিত্র অনুভূতির ওড়নায় আসক্ত বাংলার সন্তানেরা। বাংলার নারীরা যতখানেক ওড়না পড়েছেন, এরচেয়ে বোধহয় বেশি ওড়না উড়িয়েছেন তারা, কেননা গল্পকারসুরকারকবিপ্রতিবাদী সবই তারা। মুক্তিযুদ্ধের যেমন বীর সৈনিক তারা, নতুন স্বাধীনতার অগ্রণী পুরুষ যারা, নিত্যনতুন দলের সভাকর্তাই তারা।

বলছিলাম, প্রতিপাদ্য প্রসঙ্গে। নারীর সমতা, অধিকার এবং ক্ষমতায়নের চিঠি বোধহয় আমরা ভুল ঠিকানায় দিই কেননা যে স্বাধীনতা সম, অধিকার অনাধিকারের সিঁড়ি নয়, ক্ষমতায়ন মানেই শক্তির বহিঃপ্রকাশ নয়, সেখানে প্রাপক আর প্রেরকই বা কে! সে চিঠি রোজ নির্দিষ্ট দিনে বাকসোতে বন্দী করার মানেই বা কি। আদতে দিবস রজনী যুদ্ধের, সংগ্রামের। রাজপথ তো দেখে না কোনো দিবস, দিনরাত, নারীপুরুষ, হিন্দুমুসলমান। তার যাত্রায় যেরক্ত মিশিয়েছে, বালিতে পুঁতেছে নিজের মস্তক, যার ছিলে গেছে তুলতুলে বদন সেই রাজা। পথ দেখে না ন্যায়অন্যায়। যতটা পারো জিতে নিতে হয়। যদি জানতে চাও তবে প্রশ্ন একটাই, রাজপথে থাকবে কে? তৌহিদী জনতা নাকি জনতা।

আবারো বলছিলাম প্রতিপাদ্য প্রসঙ্গে, লড়াইয়ে জিততে হলে তোমাকে হতে হবে সুচতুর, হতে হবে কূটনৈতিক। আকাশে বাতাসের ওড়নায় তোমার শ্বাসরোধ করা হবে, তুমি অতি বিষয় এড়িয়ে, নিজের শ্বাসটুকু নেওয়ার জায়গা রাখো, প্রয়োজনে ছিঁড়ে ফেলো, অতি প্রয়োজনে অন্যজন সহ ডুবে মরো। তব প্রিয়জন বন্ধু আমার, একা মরো না।

যে আন্দোলনে তোমার উলঙ্গ দেহ কাজে এসেছে, যেখানে তোমার যুদ্ধকে দিয়েছে চারিত্রিক সনদ, বীরাঙ্গনা আমার তোমাকে তারা ভাতে মারবে, কখনো ওড়নায় মারবে কখনো বা মারবে শব্দে। পরকিয়ায় লিপ্ত নষ্টা, নেশাগ্রস্ত বেশ্যা সবই সুন্দর শব্দ, এসবের ফাঁদে পড়ো না। শব্দের মারপ্যাঁচে তোমাকে দীর্ঘদিন নাচিয়েছে, এবার হয়তো বাক্যটা তুমিই বলতে পারো।

কেনই বা বলছিলাম প্রতিপাদ্য প্রসঙ্গে, দেশের গুমখুনধর্ষণেও আজ ওড়না প্রাসঙ্গিক। ওড়নার মাহাত্ম্য তোমার স্তনযুগলে, কবি আখ্যা দেবেন হয়তো সুবৃন্ত পুষ্পযুগলে। কিন্তু এ দেশে প্রতিপাদ্যে কোনো ঠাঁই নেই। এদেশে ট্যাবু হলো সঙ্গমে, পুষ্প থেকে পুষ্পের পরাগায়নে। এ দেশে ধর্ষণ চালডালের মতোই স্বাভাবিক ক্ষুধা নিবারণের পণ্য। যার বিক্রি চলে হাটে, এ হাটে এখনো ট্যাবু মানেই নারী। আর নারী মানেই ট্যাবু। ফলে কেনই বা বলছিলাম প্রতিপাদ্য প্রসঙ্গে।

তবুও বলে যেতে হবে, দেখে নিতে হবে সকল প্রতিপাদ্য। আমাদের প্রতিপাদ্য কারা ঠিক করছেন, কেনই বা ঠিক করছেন। প্রয়োজনে খোঁদাই করে রাখতে হবে। যদিও বা বলছিলাম প্রতিপাদ্য প্রসঙ্গে, শেকড়ে টানটাই জরুরি সম। যে ওড়না নিয়ে লুকায়িত কখনো বা প্রকাশ্য এত কামাতুর লিপ্সা, তাদের মনে করিয়ে দাও আমার মায়ের আঁচলে কতটা সংগ্রামের রক্ত শুষে আছে, এ জীবন এতটাও নূন্য নয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতারেক রহমানের নেতৃত্বে নিরাপদ আগামীর বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধনারী দিবস আজ, কি ভাবছেন নগরীর সচেতন নারীকুল