[ভূমিকা- ক্রাউন পাবলিশিং থেকে সমপ্রতি প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার লেখা স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ ‘আ প্রমিজ্ড্ল্যান্ড’। এই গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুতে তিনি লিখেছেন সিনেটর হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত হবার আগে নিজের প্রস্তুতি বিষয়ে, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে মিশেলের মতামত কতটা প্রভাবিত করেছিল, সেই বিষয়ে। এই অংশটির অনুবাদ করেছেন ফারহানা আনন্দময়ী।]
সিনেটর পদে নির্বাচন করবো, এই সিদ্ধান্তটা যখন আমি নিচ্ছি, মিশেলের সায় কিন্তু সে সময়ে আমি পাইনি। সে একটা দোলাচলে ভুগছিল। আমাকে মিশেল বললো, “কী হবে তুমি যদি হেরে যাও, বলো তো। আমরা গহ্বরের অতলে তলিয়ে যাবো। আর যদি জিতে যাও, আমাদের জন্য সেটাও নতুন সমস্যা তৈরি করবে। শিকাগো আর ওয়াশিংটনে দুটো জয়গায় সংসার চালাতে হবে। এখন একটাতেই কেমন হিমশিম খেয়ে যাই আমরা!”
বললাম, “তুমি একবার ভাবো তো, যদি আমি জিতে যাই, সিনেটে আমিই হবো একমাত্র আফ্রিকান-আমেরিকান সিনেটর! পুরো জাতির দৃষ্টি তখন আমার দিকে। আরেকটি বই তখন আমি লিখবো। দেখো, অনেক কপি বিক্রি হবে সেই বইয়ের, বাড়তি খরচটা ঠিক আমরা সামলে নেবো তাতে”।
“তোমার কথাগুলো কেমন শোনাচ্ছে, জানো! পকেটভর্তি ম্যাজিক বীন আছে তোমার, পুঁতে দিলেই এক রাত্তিরে বড়সড় একটা বীনস্টক গাছ আকাশ ছুঁয়ে বেড়ে উঠবে। আর তুমি সেই গাছ বেয়ে উঠে মেঘের মধ্যে যে দৈত্য লুকিয়ে আছে তাকে মেরে, সোনার ডিম-পাড়া হাঁসটি কোলে করে বাড়িতে নিয়ে আসবে। এরকমই তো বলতে চাইছো, না?”
আমি বললাম, “আসলেই। সেরকমই কিছু হয়তো ঘটবে”।
মিশেল মাথাটা একটু দুলিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। আমরা দুজনেই তখন জানি, এই মুহূর্তে ঠিক কোন্কথাটা শুনতে চাইছি। আরেকটি ভাঙচুর জীবনের আরেকটি জুয়া, আরেকটি নতুন পদক্ষেপ বেছে নেয়া… যে পথ ধরে আমি এগুতে চাই, কিন্তু মিশেল চায় না।
“ঠিক আছে, বারাক। এটাই শেষবার। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণায় তুমি আমাকে পাবে না। এমন কি, আমার ভোটটাও যে তুমিই পাবে, সেটাও নিশ্চিত নয়”। মিশেল স্থিরকণ্ঠে বললো। এরকমই ছিল সিনেট নির্বাচনে প্রার্থী হবার আগের সময়গুলোতে আমাদের আলোচনা। এর চার বছর পরে যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হবো বলে নিজেকে প্রস্তুত করছি, মিশেল আগের চেয়ে তখন খানিকটা নমনীয় আমার সিদ্ধান্তের প্রতি।
ততদিনে সে নিজের ভাবনাগুলো গুছিয়ে আনতে শুরু করেছে। যে কোনো সভাতে সে চুপ করে বসে আলোচনা শুনতো আর মাঝেমধ্যে নির্বাচনী প্রচারণার পদ্ধতি বিষয়ে বা ক্যালেন্ডারে কোন্তারিখে কোথায় প্রচারণা, সেসব বিষয়ে একটা দুটো প্রশ্ন করতো। ধীরে ধীরে মিশেল আমার প্রচারণায় অংশ নিতে শুরু করলো, তার নিজস্ব মতামত দিয়ে। আমার এই নির্বাচন করা নিয়ে ওর ভেতরে একটা সংশয় বা ভীতি, যেটাই কাজ করছিল, তা কাটতে শুরু করলো যেন। ভ্যালেরি আর মার্টি, আমার দুইজন সবচেয়ে বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সঙ্গী, ওদের কথায় নির্দ্বিধায় ভরসা করতো মিশেল। ওর ভাই, ক্রেইগ-ও ওকে সেইসময়ে সিদ্ধান্ত নিতে খুব সাহায্য করেছিল।
ডিসেম্বরের এক সন্ধ্যায়, আমরা তখন গোছগাছ করছি হাওয়াইতে যাবো, ছুটি কাটাতে। সেদিন একটা সভা ছিল এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হবো, কি হবো না… সেই সিদ্ধান্তটা নেয়ার। এক ঘন্টার উপরে সেই সভা চললো, মিশেল খুব ধৈর্য ধরে পুরো সময়টা উপস্থিত ছিল আমাদের সভায়। প্রার্থী ঘোষণা করার পরপরই আমাকে আর আমার সহযোগীদেরকে ঠিক কীভাবে প্রচারণায় এগুতে হবে, সে সমস্ত বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা হলো। আলোচনা শেষে মিশেল কেবল একটি প্রশ্নই আমাকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করেছিল। “বারাক, তুমি আমাকে বলেছ যে আরো কয়েকজন ডেমোক্র্যাট সিনেটর আছেন, যারা এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারার সকল যোগ্যতা রাখেন, এমনকি জিতে তারা রাষ্ট্রপতিও হতে পারেন। তবে তুমি প্রার্থী হলে এমন কিছু বিষয় কি যোগ হবে, এমন কিছু কি প্রাপ্তি হবে, যা তারা প্রার্থী হলে হয়তো হবে না। এরকম যদি কিছু হয়, তাহলেই হয়তো তোমার প্রার্থী হবার সিদ্ধান্তটা অর্থবহ হবে। এখন আমার প্রশ্ন হলো, তুমিই কেন বারাক? তুমিই কেন রাষ্ট্রপতি হতে চাইছ?”
আমরা দুজনের দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম খানিকক্ষণ, টেবিলের দুই প্রান্ত থেকে। এমন মনে হচ্ছিল, যেন সেই মুহূর্তে ওই ঘরে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। আমি ফিরে গেলাম সতের বছর আগের এক সকালে, যখন মিশেলকে আমি প্রথমবার দেখেছিলাম। বৃষ্টির কারণে অফিসে পৌঁছুতে সেদিন আমার একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। ঢুকতেই দেখলাম, আইনবিদদের সেই ব্লাউজ আর স্কার্ট পরনে মিশেল নিজের ডেস্ক ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। স্মিত হাস্যমুখ। হালকা চালে কী যেন বললো আমাকে। তার গভীর দুটো কালো চোখে আমি এমনই এক আবেগের ছায়া দেখেছিলাম, মিশেলের চোখে সেই আবেগ দেখতে পাওয়া সত্যিই খুব দুর্লভ। আমার ভেতরে জানা হয়ে যাচ্ছিল, সে আসলেই বিশেষ একজন নারী, যাকে আমি ভালোবাসতে পারি। এখনো ভাবি, সত্যিই কত ভাগ্যবান আমি।
“বারাক?” মিশেল ডাক দিল।
একটু কেঁপে উঠে বর্তমানে ফিরে এলাম যেন। “হ্যাঁ, তাই তো। আমিই কেন?” কেন আমি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হতে চাই, সেই প্রশ্নের বিভিন্নরকম ব্যাখ্যা আমি আগেও দিয়েছি। নিজেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-ও করেছি বহুবার। হ্যাঁ, আমি হয়তো এ দেশের রাজনীতিতে এক নতুন স্ফুলিংগ হয়ে উঠতে পারি, হয়তো নতুন এক প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে পারি এ পথে আসতে, মানুষের কল্যাণে কাজ করতে কিংবা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে একটা সেতু গড়ে তুলতে পারি, যা অন্য প্রার্থীরা আমার মতো করে পারবেন না।
এবার আমি বলে উঠলাম, “কিন্তু কেউ হয়তো জানি না আমরা আগামীতে কী হবে। এমন কোনো নিশ্চয়তাও দিতে পারবো না, যে, আমরাই জয়ী হবো। তবে একটা বিষয় আমি এখনই বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। যেদিন আমার এই ডান হাতটা উপরে তুলে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হওয়ার শপথ নেবো আমি, পুরো বিশ্ব সেই মুহূর্ত থেকে আমেরিকাকে এক ভিন্ন চোখে দেখা শুরু করবে। আমি জানি, সারা আমেরিকাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যত কৃষ্ণাঙ্গ শিশু আছে, হিস্প্যানিক শিশু আছে, যারা নিজেদেরকে নিয়ে একটা সংশয়ে ভোগে, যারা অন্য আমেরিকান শিশুদের সাথে সমানভাবে মিশে যেতে পারে না, তারা সবাই সেই মুহূর্ত থেকে নিজেদেরকে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে, ভাবতে শুরু করবে। এই শিশুরা স্বপ্নের এক নতুন দিগন্ত খুঁজে পাবে, ওদের মেধা আর প্রতিভা দিয়ে তাদের প্রাপ্যটা বুঝে নিতে পারবে। এবং শুধু এই কারণেই আমার রাষ্ট্রপতি হয়ে ওঠাটা অর্থবহ হবে”।
পুরো ঘরটা নৈঃশব্দ্যে ভরে উঠলো। মার্টি হাসছে, ভ্যালেরির চোখে জল, আর অন্য সদস্যরা যেন সেই মুহূর্তে কল্পনা করতে শুরু করে দিয়েছেন, একজন আফ্রিকান-আমেরিকান মানুষ হিসেবে আমিই প্রথম আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হবার শপথ নিচ্ছি। মিশেল তাকিয়ে আছে আমার দিকে, নিষ্পলক… মনে হলো যেন অনন্তকাল। “হুম, হানি, খুব ভালো বলেছ। এর চেয়ে ভালো উত্তর আর কিছু হতে পারে না”।
সবাই এক প্রশান্তির শ্বাস নিল, এত বড়ো সিদ্ধান্তটা শেষ পর্যন্ত নেয়া গেল। এবার তারা অন্য আলাপে চলে গেল। এত বছর পরে এসেও, আজও, আমাদের যে কোনো সভাতে, যে কোনো আলাপে সেদিনের সেই সন্ধ্যাটি ফিরে ফিরে আসে। মিশেলের ছোট্ট একটি প্রশ্নের উত্তরে যা আমি বলেছিলাম, তা আমাদের সকলকে এতটা পথ পাড়ি দিতে খুব সাহায্য করেছিল। এই যাত্রা খুব একটা সহজ ছিল তা নয়, তবে গন্তব্যে পৌঁছুতে সেদিনের সেই স্বপ্ন, বিশ্বাস আর প্রতিজ্ঞা সবচেয়ে শক্ত করে আমাদের হাত ধরে ছিল। এবং আমরা পৌঁছেছিলাম, যেখানে পৌঁছাতে চেয়েছি। আমাদের স্মৃতিতে খুব উজ্জ্বল হয়ে আছে আজও, সেই ছবিটা, ওভাল অফিসের সেই একটা ছবি। ছোট্ট একটি কৃষ্ণাঙ্গ বালক একদিন ওভাল অফিসে আমার চুলে হাত দিয়ে দেখছে! বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে দেখছে, একজন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট-এর মাথার চুলও ওর মাথার চুলের মতো! ভেতরে ভেতরে সে কত শক্তিমান হয়ে উঠলো সেই মুহূর্তে। শিক্ষকদের সেই রিপোর্টের স্মৃতিও তো আমরা ভুলতে পারি না আজও, আমি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেবার পরে আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে, বিভিন্ন প্রান্তে নাকি কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরা ওদের স্কুলের পাঠে আরো অনেক বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছিল।
এটা সত্য, সেদিন মিশেলের সেই প্রশ্নের উত্তরে যে স্বপ্নের রূপরেখা আমি এঁকেছিলাম, নির্বাচনী প্রচারণাতে সেই মতো এগুতে পারলে সমাজের বর্ণবৈষম্যের গায়ে একটা ধাক্কা দিতে পারবে। সমষ্টিক এই পরিবর্তনের হাওয়া আমার ব্যক্তিগত বোধকেও আরো অনেক বেশি সংহত করে তুলতে পারবে। আমরা যদি জয়ী হই, বুঝতে পারবো, সিনেট নির্বাচনে জয়ী হওয়াটা আমার জন্য কোনো হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ভাগ্য ছিল না। আমরা যদি জয়ী হই, এর অর্থ দাঁড়াবে, যে পথে আমি রাজনীতির দিকে এগিয়েছি, সেটা কোনো নিছক স্বপ্নের পথ ছিল না। যে আমেরিকাকে আমি স্বপ্নে বুনেছি, যে গণতন্ত্রকে আমি কল্পনা করেছি, সেটা সত্যের নাগালের মধ্যেই ছিল।
যদি আমরা জয়ী হই, আলোকিত বিশ্ব গড়ার যে প্রতিজ্ঞা আমরা করেছিলাম, সেই অঙ্গীকার পালনে সমর্থ হবো আমি। ভীষণ শীতল আর ক্ষমাহীন এক বিশ্বে নিশ্চয়ই আমরা থাকতে চাই না। দুর্বলের ওপর সবলের যে নির্যাতন, তা থেকে বেরোতে পারবো। শ্রেণিতে শ্রেণিতে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে স্তরে যে বৈষম্য, তাও দূর করতে পারবো নিশ্চয়ই। অজানা ভয়, শঙ্কা আর অন্ধকার পেরিয়ে মানবতায় উষ্ণ এক অন্য পৃথিবীকে স্বাগত জানাবো।
এই নির্বাচনী প্রতিজ্ঞাগুলো সত্যরূপ পেলে শুধু সমাজ বা রাষ্ট্রের কল্যাণ হবে তা নয়; ব্যক্তিগতভাবেও অনেকটা নির্ভার মানুষ মনে হবে নিজেকে। আমার আলো অভিমুখী প্রতিজ্ঞার আভা আমি ছড়িয়ে দিতে পারবো আগামী প্রজন্মে, আমার সন্তানদের মধ্যেও। অনেক বছর আগে আমি নিজের সাথেই একটা বাজি ধরেছিলাম। সময় হলো, সেই বাজি জেতার। কিছু অদৃশ্য তারের উপর দিয়ে যেন হাঁটা শুরু করেছিলাম আমি, যার গতিপথ আমার জীবনের গতিপথকে বদলে দিয়েছিল। হতে পারে সেই পরিবর্তন আমি কখনো কল্পনা করিনি কিংবা পছন্দ করে বেছে নিইনি। কিন্তু এখন আর থেমে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। পেছনে ফেরারও সকল পথ বন্ধ হয়ে গেছে। নিজের বিশ্বাস আর সংকল্পের থেকে সরে যাওয়াটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না আর। আমাকে শুধু পথিক হয়ে এগিয়ে যেতে হবে, আমাকে শুধু দেখে যেতে হবে, পথ আমাকে কোথায় নিয়ে যায়।
ফারহানা আনন্দময়ী : কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক