জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার চিত্র পর্যবেক্ষণ বিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে (জানুয়ারি–আগস্ট) সারা দেশে ৩৯০ কন্যাশিশু ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম আট মাসে শিকার হয়েছিল ২২৪ জন। এছাড়া নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৫৪ কন্যাশিশু। শিশু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১০৪টি। এ সময়ে ৩৪ শিশু অপহরণ ও পাচারের শিকার হয়েছে, যা ২০২৪ সালের দ্বিগুণ। প্রেস ক্লাবে প্রকাশ করা এই প্রতিবেদনে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২৫ সালের প্রথম আট মাসে মোট ৫৪ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়, যা গত বছরের একই সময়ের দ্বিগুণ। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ২৮। তবে ২০২৩ সালে ছিল আরো বেশি (১১৭ জন)। এসব যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে পথেঘাটে, যানবাহনে, বাজারে, পাবলিক প্লেসে, এমনকি শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বাসাবাড়িতে। চলতি বছরের এ সময়ে ৩৯০ জন কন্যাশিশু ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ৪৩ জন গণধর্ষণ ও ২৯ জন প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু। ধর্ষণ ও গণধর্ষণের পর ১৫ জন কন্যাশিশু খুন হয়েছে ও পাঁচজন আত্মহত্যা করেছে। ২০২৪ সালের একই সময়ে ২২৪ জন ও ২০২৩ সালে ৪৯৩ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়।
এছাড়া পারিবারিক সহিংসতা, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, স্বামী–স্বামীর পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন এবং পরিবার, শিক্ষক, সহপাঠী ও অন্যদের উপহাসের কারণে একজন করে মোট চারজন আত্মহত্যা করে। গত বছর প্রথম আট মাসে ১৩৩ জন কন্যাশিশু আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
এছাড়া ৫০ কন্যাশিশুর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি। ২০২৪ সালের জানুয়ারি–আগস্ট ২০ কন্যাশিশুর রহস্যজনক মৃত্যু হয়, যাদের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যায়নি। গত আট মাসে ১৯ কন্যাশিশু নিজ গৃহে ও স্বামীগৃহে সহিংসতার শিকার হয়।
আসলে আমাদের সমাজে ভিকটিম যদি নারী বা কন্যা শিশু হয় তাহলে ‘ভিক্টিম ব্লেইমিং‘ যেন একটি অতি সাধারণ ব্যাপার। আর শিশু যদি ভিক্টিম হয় তাহলে এটা আরও বেশি ঘটে। কারণ শিশুরা শক্তভাবে প্রতিবাদ করতে পারে না। কিন্তু, নির্যাতিত ব্যক্তির উপর দায় চাপানোর এই চর্চা আমাদের দ্রুত বন্ধ করা উচিত।
বিলম্বিত বিচার এবং তদন্ত প্রভাবিত হওয়ার কারণে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। একাধিক আইনজীবীর মতে, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অনেক সময় নথিপত্রে তথ্য–প্রমাণাদি সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন না। ফলে বিচার প্রক্রিয়া বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকে, যা বাদীপক্ষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং সমাজে এক ধরনের ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ তৈরি করে। যখন অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয় বা অপরাধী পার পেয়ে যায়, তখন অন্যান্য সম্ভাব্য অপরাধী উৎসাহিত হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ধর্ষণ প্রতিরোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। নারীর নিরাপত্তা মানে সমাজের নিরাপত্তা। প্রতিটি শিশু, প্রতিটি নারীকে নিরাপদ রাখা রাষ্ট্র ও সমাজের মৌলিক দায়িত্ব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কন্যাশিশুরাই বড় হয়ে এক দিন মা হবে। তাই যত্ন দিয়ে, নিরাপত্তা দিয়ে তাদের বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে না পারলে সমৃদ্ধ জাতি গঠনে তারা সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হবে। কন্যাসন্তানকে সুশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলে যোগ্য পাত্রের হাতে তুলে দিতে হবে। শুধু আইন দিয়ে নয়, সম্মিলিতভাবে সরকার ও সুশীলসমাজকে এ নিয়ে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পরিবার, প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের দায়িত্ব অপরিসীম। যৌন হয়রানি রোধে অবাধ ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। শিশু ধর্ষণ রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি মানুষের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। পাড়া–মহল্লার বিভিন্ন সমাজিক সংগঠনকে কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা সুরক্ষার জন্য কাজে লাগাতে হবে। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা ছাড়া শিশু নির্যাতন বন্ধসহ কন্যাশিশুদেরর নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা যাবে না।