শত বৎসরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় মানবকুল ক্রমাগতভাবে জড়বাদী সভ্যতার দিকে এগিয়ে গেছে। এই জড়বাদী সভ্যতা মানুষকে ভোগবাদী করে তুলেছিল। তারা মনে করলো ভোগেই শান্তি। মানুষ এ ভ্রান্ত ধারণার বশীভূত হয়ে যায় এবং মরীচিকার পেছনে ধাবিত হয়। পথভ্রান্ত মানুষ সে ভোগের মধ্যে প্রকৃত সুখের সন্ধান পায়নি। পরিণামে জীবনে অনেক অপরাধ দানা বাঁধে এবং লোভ, অর্থ আত্মসাৎকারী অপরাধী হিসাবে দেশে সমাজে গণ্য হয়। বিপর্যন্ত হয় জীবন, সম্মানবোধটুকু আর থাকে না। প্রকৃত শান্তি কোথায় অবোধ মানুষ আজও বুঝল না। তারা আত্মতৃপ্তিকে, আত্মবোধকে মূল্যায়ন করল না। মানুষ শুনেও শোনে না। জানেও জানে না। কথায় আছে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও সুখী যে নিজের অবস্থায় সদা সন্তুষ্ট থাকে। শত বৎসরের সেই চিরন্তন বাণী আজও নীরবে নিভৃতে কাঁদে ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’ বিগত বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে যা উঠে এসেছে রাগব বোয়ালদের ভয়াবহতা। বেশিরভাগ মানুষ অপরিণামদর্শী। তাই তাদের পরিণাম সুখকর নয়। বেশ কিছু লোক আছে তারা খুব দানশীল হিসাবে পরিচয় দিতে চায়, কিন্তু সেই দানের অর্থ অনেকাংশে অবৈধভাবে উপার্জিত ও লুণ্ঠিত। মানব জীবন অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসর কিন্তু ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ব্যাপক। স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে মানুষের প্রচেষ্টা অসাধ্যসাধনে শক্তি যোগায়। চরিত্রবান সৎ মানুষ বিষাদ ক্লিষ্ট, কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে শান্তি খুঁজে নিরবচ্ছিন্ন জীবন যাপনের জন্য। অন্যদিকে কিছু লোক সহজভাবে অবৈধ পথে পেশীশক্তি ও প্রতিপত্তি খাটিয়ে লুণ্ঠন করে নেয় জাতীয় ও সাধারণ নাগরিকের সম্পদ। কিন্তু তারা ভুলে যায় উপরওয়ালা তাদের জন্য রাখে ভয়াবহ পরিণতি। তাই বারে বারে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। প্রতিটা মানুষের ধর্ম পরিচয় রয়েছে। যার যার ধর্ম তার কাছে মহান, এটার দ্বিমত নেই। কিন্তু তত্ত্বজ্ঞান অর্জন করে তা বিতরণের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কূপমণ্ডকতা পরিহার করে একটি অসাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃত্ববোধ সম্পন্ন সভ্য সমাজ গঠন করা খুবই সম্ভব। অবশ্য সেখানে পরধর্ম সহিষ্ণুতা খুবই আবশ্যক। বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব মেলবন্ধনের কথা চিন্তা করে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। ম্যাডাম হেলেনা পেট্রোভনা ব্লাডাটস্কি ১৮৭৫ সালে ১৫ নভেম্বর নিউইয়র্ক শহরে একটা সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। তার দর্শন ছিল জীবনকে সহজ বোধ্য করে ন্যায় ও প্রেমের পথ প্রদর্শনপূর্বক জীবনকে ক্রমবিকাশের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কোনো বিশেষ মতের প্রতি শ্রদ্ধা বা বিশ্বাস এই মেলবন্ধনের হেতু নয়। তিনি বলেন সত্যকে জানার জন্য অনুশীলন, মননশীলতা, চিত্তশক্তি ও উচ্চ আদর্শ দরকার। এ সত্যগুলো অনুশীলনে মানবের প্রভূত কল্যাণ হবে। তাতে হিংসা, দ্বেষ বা বিরোধের কোনো অবকাশ থাকবে না। সুতরাং প্রতিটা মানুষের আত্ম–উপলব্ধি দরকার। সেটা বড় একটা দেখা যায় না। বড় আকারে চর্চাও হয় না। আজকের সমাজে দেশে দেশে মানুষ খুব বেশি অস্থির আচরণ করছে। হয়ে উঠেছে অমানবিক। মানতে চায় না বিধি নিষেধ। এই বেপরোয়া স্বভাবটা সমাজের জীবনে নিয়ে আসছে বিশৃঙ্খলা ও আইন বহির্ভূত কর্মকাণ্ড। আতঙ্কগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। তারা চায় কঠোর আইনের প্রয়োগ। আইনের প্রয়োগ না হলে স্থিতিশীলতা কখনো ফিরে আসবে না। তাই সাধারণ নাগরিকের আস্থা ফিরে আসবে না। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজমান থাকবে। ব্যক্তি জীবনে শুদ্ধ মানুষ হতে নিজেকে তৈরি করতে হবে। লালন ফকিরের সহজ সরল মানুষ আজ হারিয়ে গেছে। মানুষের ভোগবাদী চিন্তা চেতনার ফলে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া দুর্নীতি এমনভাবে বাসা বেঁধেছে তার মূল উৎপাটন করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। তার ওপর রাজনৈতিক সহযোগিতা, আশ্রয়ে–পশ্রয়ে ব্যাপ্তি ঘটায়। এই মজ্জাগত দুর্নীতি সাধারণ মানুষ মোটেই চায় না। তারা চায় ভাত, কাপড়, সংস্থান হলেই যথেষ্ট। কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা যেন তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া না হয়। তাই সবার ঊর্ধ্বে সত্যের পথে চলাটা হোক মুখ্য।
লেখক
প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিওলস্টি, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।