প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে ভারতের রাজনীতি

কাজী রুনু বিলকিস | মঙ্গলবার , ১ মার্চ, ২০২২ at ১০:১৪ পূর্বাহ্ণ

‘দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি
দেবদারু কেটে নিচ্ছে নরম কুঠার
তাও রাজনীতি
গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে
তাও রাজনীতি।
মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি
মানুষ মরছে তাও রাজনীতি’!

কবিতাটা আবুল হাসানের। খুব মনে ধরেছে বলে কয়েকটা লাইন এখনো স্মরণে আছে। রাজনীতির এই অশুভ বিস্তার মানুষের সব শুভ বোধকে খেয়ে বসে আছে! অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, মানুষের ক্ষতি করার যার যত বেশী শক্তি তার প্রভাব, প্রতিপত্তিও তত বেশি! সেই নেতৃত্ব দিচ্ছে সমাজের, রাজনীতির! ভালো মানুষ, মেধাবী মানুষ রাজনীতি বিমুখ। তরুণ সমাজের কাছেও রাজনীতির সংজ্ঞা বদলে গেছে। প্রায় সারা পৃথিবীতে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। আদর্শভিত্তিক রাজনীতি বলতে আমরা যা বুঝতাম তা পইপই করে খুঁজলেও আর পাওয়া যাবেনা। প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছাঁয়ার নীচে এখন পৃথিবী জুড়ে মানুষের বসবাস। অন্তত বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক গল্প তাই বলছে। সাম্প্রদায়িকতার উপর ভিত্তি করে দেশ ভাগাভাগির পর বাঙালি মুসলমানদের আরও বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পূর্ব পাকিস্তানের উপর শাসক পশ্চিম পাকিস্তানের ক্রমাগত শোষণ, নিপিড়নের কারণে অবিরাম সংগ্রামের মাধ্যমে হিন্দু মুসলিম বিদ্বেষটা তেমন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠার সুযোগ পায়নি। সাধারণ মানুষের মনে একটা সম্প্রীতির ভাব চলে এসে ছিল। আন্দোলন সংগ্রামের লক্ষ্য এক এবং শত্রু ও অভিন্ন হওয়ায় জাতি ধর্ম নির্বিশেষে একটা গভীর ঐক্য গড়ে উঠেছিলো। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে একটি অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। মানুষের মন-মানসিকতায় ও সামপ্রদায়িকতার তেমন কোনো প্রভাব ছিলনা। এটা আমার বিশ্বাস। আমার দেখা তখনকার চারপাশের বাস্তবতা থেকে বলছি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ৭৫ পরবর্তী রাজনীতি আবারও ক্লেদাক্ত হয়ে উঠলো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে আসলো পরবর্তী সরকারগুলো প্রতিযোগিতা দিয়ে। ধর্মাশ্রিত রাজনীতির কাছে নতজানু হয়ে পড়লো। ধূর্ত রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতার স্বার্থে তা চালু রাখলো। ফলে যা হবার তাই হলো। পূজা পার্বণ এলে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিয়ে কিছু প্রান্তিক মানুষের ক্ষতি সাধন করে বিভিন্ন অজুহাতে। তাদের ভাতের হাঁড়িটা, ডালের হাঁড়িটা, মাথা গুজার আশ্রয়টুকু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার রেওয়াজ শুরু হলো। ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যাওয়ার মত সব শেষ হলে প্রশাসনের লোকজন আসে, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আসে, রাজনৈতিক নেতারা আসেন, অশ্রুপাত করেন। মামলা হয় কিন্তু সেই মামলা আর শেষ হয় না। লাভের লাভ তাৎক্ষণিক কিছু ক্ষতি পূরণ পাওয়া যায়। এ-ই হচ্ছে বাংলাদেশের অবস্থা। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায়ই প্রতিটি দেশ এখন প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার অন্ধকারে। এই উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ ভারত। তার একটি উদার গণতান্ত্রিক ধর্ম নিরপেক্ষ চেহারা ছিল কিন্তু বিজেপি সরকারের নির্লজ্জ, সাম্প্রদায়িক উস্কানি ভারতের মৌলিক চরিত্র বদলে দিয়েছে দুঃখজনকভাবে। যে চরিত্রের ভিত্তি ছিল সহনশীলতা, সম্প্রীতি ও ধর্ম নিরপেক্ষ মূল্যবোধ। বহুমত, বহুপথের ঐতিহ্যকে গুড়িয়ে দিয়ে নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনী আনা এবং সারাদেশের জন্য এন আর সি তৈরির অঙ্গিকার সত্যিই বিপদজ্জনক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। ভারতীয় লেখক আকার প্যাটেল তাঁর বই ‘প্রাইস অব দা মোদি ইয়ারস’ বইতে লিখেছেন, মোদির জনপ্রিয়তার কারণ হচ্ছে সংখ্যালঘু বিদ্বেষ। রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ আর এস এস এতকাল যে স্বপ্ন দেখে এসেছে মোদি তা বাস্তবায়ন করেছে। মুসলমানদের রাজনৈতিক দিক থেকে পরাস্ত করা, প্রান্তবাসী করে আইন ও নীতির বেড়ি পড়ানো এই স্বপ্ন ছিল আর এস এস এর। মোদিকে দিয়ে তা তারা করতে সফল হয়েছে। আজকের ভারতের ২৮ রাজ্যের কোথাও মুসলমান মুখ্যমন্ত্রী নেই। ১৫ রাজ্যের একজনও মুসলমান মন্ত্রী নেই। ১০ রাজ্যে মুসলমান মন্ত্রী রয়েছেন বটে যাদের অধিকাংশের দায়িত্ব সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। বিজেপির এই জাতি বিদ্বেষ হিন্দু সমাজের বড় একটা অংশের সমর্থন রয়েছে। ভারত শাসিত কাশ্মীরে কি পরিমাণ নৃশংসতা চলছে তা আমরা জানি। প্রায় নিয়মিত ভাবে উত্তর প্রদেশে হামলা হচ্ছে। নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে হামলার ঘটনাও তত বাড়ছে। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ প্রবল হিন্দুত্ববাদী নেতা। তার সরকার রাজ্যে মুসলমান শাসকদের নাম, স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার কাজে নেমেছেন। এমনকি জায়গার নাম পর্যন্ত বদলে দিচ্ছে। তাজমহলের শহর আগ্রায় ‘মোগল থীম’ নামক একটা মিউজিয়ামের নাম বদলানোর এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘মোঘল বাদশাহরা কখনো ভারতের নায়ক হতে পারেনা। ‘ভারতের মহারাষ্ট্রের স্কুলের পাঠ্যবই বই থেকে মোঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস বাদ দেওয়া হয়ছে। ভারতের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, সৌধ মোঘল আমলের তৈরি। বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার নজর পড়েছে এখন এই ঐতিহাসিক স্থাপনার দিকে। ভারতের ইতিহাসবিদেরা বলছেন, দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের কোণঠাসা করার এটি একটি সুপরিকল্পিত নকশার অংশ। এছাড়া রাজ্যে রাজ্যে আইন এনে গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করছে। সম্প্রতি এক মুসলমানের ১০ বছরের কারাবাস হয়েছে। অভিযোগ তিনি তাঁর মেয়ের বিয়েতে গরুর মাংস খাইয়েছিলেন! আবার নতুন করে সামনে আনা হয়েছে হিজাব বিতর্ক। এটাও হয়তো মুসলিম নারীদের প্রান্তিকীকরণের নতুন কৌশল! ভারতের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে বহু মত ও বিশ্বাসের মানুষের বসবাস। তারা নিজের বিশ্বাস মতে বহু ধরনের ধর্মীয় প্রতীক ধারণ করেন। সবাইকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র মুসলিম মেয়েদের হিজাব বিবেচনায় নেওয়া নিছক বৈষম্য এবং সংবিধানের পরিপন্থী।
বর্তমান ভারতের রাজনীতি একেবারে আনুষ্ঠানিকভাবে মিশে গেছে ধর্মের সাথে। ভোটের রাজনীতির কারণে ভারতের সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ধর্মের এই বিভেদ ঘৃণার যে বাতাবরণ তৈরি করছে তা ভবিষ্যতে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এই অঞ্চলের প্রগতিশীল ব্যক্তিরা একসময় ভারতকে প্রগতির ও গণতন্ত্রের ধারক বাহক হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কালের পরিক্রমায় মহাত্মা গান্ধীর দেশ এখন সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে নিজদের প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে! জিডিপি তরতর করে নিচে নামছে ক্ষতি নেই, কৃষক মরছে ক্ষতি নেই, বেকারত্ব বাড়ছে ক্ষতি নেই, দরিদ্র মানুষ আরও দরিদ্র হচ্ছে দুবেলা আহারের সংস্থান করতে পারছেনা ক্ষতি নেই। অতিমারী সবক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ধস নামিয়েছে ক্ষতি নেই। সামনে ভোট তাই ধর্ম নিয়ে খেলাধূলা চালু রাখাটাই এখন অনেক জরুরি। সেটা মুসলমানদের সাথে হলে ভালোই জমে। ব্রিটিশদের এই বিভাজনের শিক্ষা রাজনীতিতে আজও কার্যকরী মহৌষধ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রদ্ধায়-স্মরণে বেগম মুশতারী শফী
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল