ভোট উৎসবে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে এবং আগামী ৭ জানুয়ারী ২০২৪ ভোটের তারিখ নির্ধারণ করেছেন নির্বাচন কমিশন। বিগত কয়েক সপ্তাহে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে চারদিনই অবরোধ ডেকে চলছে বিএনপি, জামায়াত জোট। সপ্তাহে দু’দফা করে অবরোধ ডাকা হচ্ছে। অবরোধের দিনগুলোতে তো বটেই, অবরোধ আহ্বানের দিন সন্ধ্যায় ও রাতে যানবাহনে আগুন দেওয়া হচ্ছে। ইতিপূর্বে অবরোধের দিনগুলোতে পুলিশি পাহাড়ায় দূর পাল্লার যানবাহনগুলো চলাচলের সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। বর্তমানে অগ্নিসন্ত্রাসের ভয়ে দূর পাল্লার যোগাযোগ ব্যবস্থা থমকে গেছে। আমরা আশা করব, যে কোনো মূল্যে অগ্নি সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করা হবে। তাদের পাকড়াও করে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা চাই। যাতে দেশের চলমান উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও অর্থনীতির ধারাবাহিকতা নষ্ট না হয় এবং অভ্যান্তরীণ বিষয়ে বিদেশীদের নাক গলানোর জন্য ধর্ণা দিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে।
সকল প্রকার বাধা ও ষড়যন্ত্র থাকার পরও বাংলাদেশ দুরন্তগতিতে এগিয়ে চলছে। আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে যে যাত্রায় বিশ্বসভায় পৌঁছে দিচ্ছেন তাতে এদেশের মানুষ গৌরবাম্বিত জনহিতকর নানা কাজের নান্দনিকতায় উদ্ভাসিত। আলোকের ঝরনাধারায় বাংলাদেশের নিত্য নতুন চলমান প্রক্রিয়া যেন সময়ের অনন্য যাত্রাপথ। অবকাঠামোর উন্নয়নশৈলী দেশের জন্য অবধারিত কর্মপ্রকল্প। যুগোপযোগী এসব মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পাশাপাশি যাতায়ত ব্যবস্থাও ক্রমেই হয়ে উঠছে আধুনিক গতিশীল।
দেশের রেলপথ নেটওয়ার্কের সঙ্গে ৪৮ তম জেলা হিসেবে যোগ হলো কক্সবাজার। নর্বনির্মিত দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শৈলীতে আকর্ষণীয় সমুদ্রের তরঙ্গের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি হয়েছে ঝিনুক আকৃতির ছয় তলা বিশিষ্ট সুবিশাল আইকনিক রেল স্টেশন। এ স্টেশনে আবাসিক সুবিধা থেকে শুরু করে ক্যান্টিন, লকার, টিকিট কাউন্টার, শপিংমল, রেস্তোরাঁ, শিশুযত্ন কেন্দ্র, মসজিদ, পোস্ট অফিস, ট্যুরিস্ট বুথ, কনভেনশন হল সহ ১৭টি বাণিজ্যিক কার্যক্রমের আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ সুবিধা।
১৩৩ বছর আগে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কঙবাজার পর্যন্ত রেলপথ নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেও অগ্রসর হতে পারেনি। পাকিস্তান সরকারও ব্যর্থ হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর একের পর এক মেগা প্রকল্পের আওতায় এবং অগ্রযাত্রায় যুক্ত করা হয়েছে কঙবাজারকে।
২৮ অক্টোবর বন্দর নগরী চট্টগ্রাম উৎসারিত আলোর নবদ্যুতিতে ঝলমল করে উঠে। এক নতুন যাত্রাপথের অংশীদারিত্বে চট্টগ্রাম অনন্য শোভায় দক্ষিণ এশিয়াকেও চমক লাগিয়েছে। নদীমাতৃক বাংলার কর্ণফুলীর তলদেশে এ যুগের মহাসন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধু টানেলটি সারাদেশকে চমক লাগিয়ে দিয়েছে। সম্ভাবনাময় এক মাইলফলকে চট্টগ্রামবাসী পেয়েছে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী যাত্রাপথ।
কঙবাজারের মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর যা মিয়ানমার–ভারত সহ এশিয়ান দেশগুলোকে সংযুক্ত করে দেশের আমদানি–রপ্তানী বাণিজ্যে তৈরি হবে নতুন সম্ভাবনা। এ বন্দরে বেশি ধারণ ক্ষমতার বাণিজ্যিক জাহাজগুলো নোঙর করতে পারবে। মাতারবাড়িতে ইতিমধ্যে প্রসস্থ ও দীর্ঘ চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে। পণ্য আমদানি–রপ্তানির জন্য বিশাল সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হয়ে উঠবে এ বন্দর। যা দেশের অর্থনীতিতে কাজ করবে মাইল–ফলক হিসেবে।
আমার মনে আছে, ৮০ দশকের দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তা ফরিদ আহমদ সে সময়কালে মহেষখালিতে গভীর সমুদ্র বন্দরের স্বপ্ন নিয়ে পরিকল্পনা ও রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। যা সে সময় পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ ৪০/৫০ বছর পর আজ বঙ্গবন্ধু কন্যার হাত ধরে তা বাস্তবায়নের পথে। অবহেলিত দ্বীপ মাতারবাড়ি এখন স্বপ্ন দেখাচ্ছে দেশের অর্থনীতিকে বদলে দেওয়ার। সেখানে আজ গড়ে উঠেছে গভীর সমুদ্র বন্দর। ২০২৬ সালের মধ্যে বন্দর চালুর টার্গেট থাকলেও এরই মধ্যে সেখানে ভিড়েছে বড় বড় জাহাজ। একের পর এক মাদার ভেসেল নিয়ে আসছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা। বন্দর অবকাঠামো পুরোপুরিভাবে তৈরির আগেই প্রস্তুত হয়ে গেছে চ্যানেল। গভীর সমুদ্র বন্দর বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের একটি স্বপ্ন বা বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। জল, স্থল এবং রেলপথে সংযুক্ত থাকবে মাতারবাড়ি। বর্তমান সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় এটি আরেকটি মাইল ফলক। মাতারবাড়ির বিপুল সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলার রূপকার হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম পেলো মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী সিডিএ ফ্লাইওভার। লালখান বাজার থেকে মাত্র ২০ মিনিটে যাওয়া যাবে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শেখ হাসিনার দেওয়া চট্টগ্রামবাসীর জন্য আরেকটি উপহার যা আরেকটি বড় সফল স্বপ্নের বাস্তবায়ন। আসলে আজকে চট্টগ্রামে যত উন্নয়ন সব কিছুর অবদান একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তাঁর বিকল্প নেই। যার আন্তরিকতা, দৃঢ়তা ও দূরদর্শী পরিকল্পনায় স্বপ্নযুগে প্রবেশ করেছে চট্টগ্রাম।
দেশে বর্তমানে ২৮ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম মাধ্যমে কয়লা, গ্যাস ও তেল। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা। বাংলাদেশ ও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সবুজ জ্বালানির পথে অগ্রসর হচ্ছে। প্রথমবারের মতো দেশের সমুদ্রে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের যৌথ উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ও ডেনমার্কের তিনটি প্রতিষ্ঠান। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুশক্তি থেকে ১৩৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা নির্ধারণ করেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রতিনিয়ত বাড়ছে কল কারখানা, যা বিদ্যুৎ ছাড়া প্রায় অচল। ফলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিভিন্ন উৎসে আরো বেশি মনোযোগ দিতে হবে জ্বালানি বিভাগকে। দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমে এ বিভাগকে শক্তিশালী করা এখনি জরুরি প্রয়োজন।
সবকিছুর পরও বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহাসড়কে দ্রুতগতিতে অগ্রসরমান। ১৯৭২ সালের ৮০০ কোটি ডলারের ক্ষুদ্র জিডিপি এখন ৩৪ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। মাথাপিছু আয় ছিল ১৯৭২ সালে ৮৫ মার্কিন ডলার এখন তা ২ হাজার ৫৫৪ মার্কিন ডলারে। বিগত এক দশকে সামাজিকভাবে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। পজেটিভ বাংলাদেশ গঠনে বছরের পর বছর হরতাল–অবরোধ ও হাঙ্গামাবিহীন অর্থনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে। পজেটিভ বাংলাদেশ যেখানে আমাদের দেশ ও দেশের বাঙালিদের কাম্য। পথ লম্বা, পথ অসীম। আজকের বিশ্ব বাস্তবতায় নানা ধরণের প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন যাতে সুষ্ঠ, অবাধ ও শাস্তিপূর্ণ হয় সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহ প্রকাশের পাশাপাশি নানা চাপও সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় দূতবাসের শীর্ষ কূটনীতিক বিভিন্ন পর্যায়ে দৌড়ঝাঁপ করে চলেছেন। আমাদের আজকে ভাবার সময় এসেছে এ শক্তি কি কখনো বাংলাদেশের বন্ধু ছিল? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার বার বলেছেন, ‘এসব বিষয়ে তিনি কোনো চাপ অনুভব করছেন না। কোনো অশুভ শক্তির কাছে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাথা নত করবে না’। নির্বাচন হবে যথাসময়ে এবং সংবিধান মেনে। আমরা আশা করছি যারা দেশের অগ্রযাত্রাকে রুখে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে এবং দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় আনার স্বপ্ন দেখছে দেশের স্বার্থে দেশের জনগণের স্বার্থে বিশেষ করে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে তাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। দেশ ও দেশের জনগণের জন্য তারা কাজ করবে এটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক–শিল্পশৈলী